স্টাফ রিপোর্টার :
সকালের সোনাঝরা রোদ চারপাশে। সিলেট জেলা স্টেডিয়ামের মাঠের একপাশে শোকের মঞ্চ। এই মঞ্চেই কালো কফিনে শুয়ে আছেন হকি তারকা জুম্মন লুসাই। নরম রোদে যেন নীরবতা ছায়া ফেলল। সিলেটে জেলা ক্রীড়া সংস্থার পতাকা কফিনে রাখা হলো। এর পরেই জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢাকা হলো কফিন। এবার একে একে সবার পক্ষ থেকে ফুলে ফুলে ভালোবাসায় সিক্ত হলেন জুম্মন লুসাই। এভাবেই গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯ টার দিকে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে আশির দশকের কিংবদন্তি হকি তারকা জুম্মনকে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেষ বিদায় জানালেন ক্রীড়াঙ্গন ও রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতৃবৃন্দ, প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ সিলেটের সর্বস্তরের মানুষ।
এ সময় সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এজেড এম নুরুল হক, সিলেট জেলা ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি মাহিউদ্দিন আহমদ সেলিম, সিলেট জেলা আইনজীবি সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট আজিজুল মালীক চৌধুরী, সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক ফেরদৌস চৌধুরী রুহেল, কোষাধ্যক্ষ মিরাজ জাকির, ক্রীড়া সংগঠক শামসুল বাসিত শেরোসহ ক্রীড়াঙ্গনের নেতৃবৃন্দ। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জুম্মন লুসাইয়ের মরদেহ তার গ্রামের বাড়ি শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে কমলগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা জানিয়েছেন: শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় স্থান মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জিতে মঙ্গলবার দুপুরে সমাধিস্থ হলেন হকি তারকা জুম্মন লুসাই। মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির হেডম্যান (খাসিয়া মন্ত্রী) জিডিশন প্রধান সুচিয়াং জুম্মনের বাল্যবন্ধু আত্মীয়। ফলে প্রিয় স্থানেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় জুম্মনকে।
মঙ্গলবার দুপুরে কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জিতে গিয়ে তার বিদায় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন এর সাধারণ সম্পাদক খাজা রহমত উল্যা, আবাহনী ক্রীড়া সংস্থার কোচ মাহবুব হারুন সহ বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। কমলগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. রফিকুর রহমান, কমলগঞ্জ ইউএনও মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা, উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. হেলাল উদ্দিন, শ্রীমঙ্গল ইউএনও, শ্রীমঙ্গল উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা, বিশিষ্ট ক্রীড়া ব্যাক্তিত্ব জুম্মন লুসাইর বন্ধু মিলন দাশ গুপ্ত, বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের নেতৃবৃন্দ সহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া দিয়ে জুম্মন লুসাই’র প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সাবেক চীফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ এমপি’র পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করা হয়।
এর আগে মঙ্গলবার সকাল ১০টায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হিমাগার থেকে তার লাশ নিয়ে আসা হয় জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যালয়ের সামনে। এখানে ক্রীড়া সংস্থার নেতা ও ক্রীড়ামোদীদের পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়ায়। এ সময় জুম্মন লুসাইয়ের স্ত্রী থানপুই লুসাই ও তিন সন্তান রিচার্ড, কেলভিন ও ডেভিড উপস্থিত ছিলেন। স্ত্রী-সন্তানরা দেশের বাইরে থাকায় রবিবার পরপারে চলে যাওয়া হকি তারকা জুম্মন লুসাইয়ের লাশ সিওমেক হিমাগারে রাখা হয়েছিল। মারা যাওয়ার পর প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখায় থাকা বাগানবাড়িতে জুম্মন লুসাইকে সমাধিস্থ করার। সিলেট নগরীতে সমাধিস্থ করারও প্রস্তাব আসে। পরে জুম্মনের প্রিয় স্থান হিসেবে মাগুরছড়ায় সমাধিস্থ করা হয়। গত ১৬ জানুয়ারি হঠাৎ বমি করার পর অজ্ঞান হয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় হকি তারকা জুম্মনকে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার তিনি না-ফেরার দেশে চলে যান। এরপর সোমবার সন্ধ্যায় এ্যাম্বুলেন্সযোগে লাশ সিলেটে নিয়ে আসা হয়। সিলেটে লাশ গ্রহণ করেন জুম্মন লুসাইয়ের বোন মাম্মি লুসাই, ছোট ভাই জুবেল লুসাইসহ সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার নেতারা। প্রয়াত জুম্মন লুসাইয়ের সঙ্গে ঢাকা আবাহনী ক্লাবের ছিল নাড়ির বন্ধন। ভাই রামা লুসাই তাকে একবার মোহামেডানেও নিতে চেয়েছেন, কিন্তু রাজি হননি জুম্মন। আবাহনী ক্লাবে ১৯৮২-তে ক্যারিয়ার শুরু, শেষও একই ক্লাবে। তাও সেই ১৯৯৯ সালে খেলা ছেড়েছেন কিন্তু ক্লাব ছাড়েননি। থাকতেন ওখানেই। ১৬ জানুয়ারি বিকেলে ক্লাবের মাঠেই ছোট ছেলেদের সঙ্গে খেলছিলেন জুম্মন লুসাই। এরই মধ্যে হঠাৎ করে বমি শুরু হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। এরপর তিনি আর সুস্থ হয়ে উঠেননি। জুম্মনের পূর্বপুরুষরা মিজোরাম থেকে এসেছিলেন। জুম্মনের বাবা চাকরি করতেন পুলিশে।