মেওয়াত থেকে তুরাগ তীর ॥ তাবলীগ জামাত এবং বিশ্ব ইজতেমা

210

॥ মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী ॥

আ ল্লাহর দেয়া জীবন, সম্পদ এবং সময় আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে এর সঠিক ব্যবহার পদ্ধতি শিক্ষা-জানা এবং বাস্তব জীবনে এর সঠিক প্রয়োগ করার পাশাপাশি আল্লাহ ভোলা মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক করে দেয়ার মেহনত করাই হলো তাবলীগের উদ্দেশ্য। আর এটাকেই বলা হয় ‘ঈমানের দাওয়াত। এ দাওয়াত নিজের সংশোধন তথা গোটা মানবজাতির মুক্তির দাওয়াত। প্রকৃত তাবলীগ অনুসারী মুসল্লিগণ কোনো বৈষয়িক লাভের আশা না করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দ্বীনের মেহনত করেন। বলা চলে- তাওহিদের শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার জন্যই বাংলাদেশে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। এই তাবলীগের দাওয়াতের সূত্র ধরেই মুসলিম ঐতিহ্যের স্পেনের মাটিতে ৫০০ বছর পর মসজিদের মিনারে আজানের সুমধুর আওয়াজ ধ্বনিত হয়। ক্রমেই তাবলীগের কার্যক্রম বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের গন্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বিশ্বের সর্বত্র। নিম্নে তাবলীগ জামাত  ও বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হলো।
‘তাবলীগ’ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো প্রচার করা, প্রসার করা, পৌঁছানো প্রভৃতি। পরিভাষায় একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানো বা শিক্ষা দেয়াকে তাবলীগ বলা হয়। তাবলীগ  নবীদের পুণ্যময় কাফেলা। শেষ নবীর তিরোধানের পর এ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তাঁর সব অনুসারীর কাঁধে। কোরআনে আল্লাহ নবীদের কাজ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের প্রতিপালকের পয়গাম পৌঁছাই এবং আমি তোমাদের বিশ্বস্ত হিতাকাক্সক্ষী।’ (সূরা আরাফ : ৬৮)। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমার কাছে যদি কোনো বাণী থাকে তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’ উদ্ধৃত আয়াত ও হাদিসে আরবি তাবলীগ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
বিশ্ব ইজতেমা : ‘ইজতেমা’ শব্দের অর্থ সভা-সমাবেশ বা সম্মেলন। পারিভাষিকভাবে এটি বাংলাদেশে ধর্মীয় সমাবেশ বিশেষত তাবলীগের সম্মেলনে অধিক ব্যবহৃত ও পরিচিত। ইসলামে সুন্দর মানবিক আদর্শ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে তুলে ধরার মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এ মহাসম্মেলনে সমবেত হন। একইসঙ্গে মিলিত হন বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশ থেকে আগত হাজার হাজার তাবলীগ অনুসারী ঈমানদার মুসল্লি। তারা কোনো বৈষয়িক লাভের আশা না করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দ্বীনের মেহনত করে ইজতেমা ময়দানকে মুসলিম মহামিলনের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন। বলা চলে- তাওহিদের শক্তিতে বলীয়ান হতে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় এই বিশ্ব ইজতেমা। বিশ্ব ইজতেমা তাবলীগ জামাতের সবচেয়ে বড় সম্মেলন। আবার অন্যদিক থেকে (লোক সমাগমের দিক দিয়ে) হজের পর ইসলামী দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জমায়েত। বিশ্ব ইজতেমায় পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ থেকে মুসলমানরা অংশগ্রহণ করেন। নানা মাজহাব এবং মত ও পথের মুসলমানরা এখানে হাজিরা দেন। আকাশের নীচে একই শামিয়ানার নিচে অবস্থান করেন। এই সমাবেশের মাধ্যমে মুসলমানদের শান-শওকত বৃদ্ধি, নিজেদের মধ্যে ঐক্য আরো সুদৃঢ় করার বার্তাই আমরা পেয়ে থাকি। কুফুরী শক্তির সামনে মুসলমানদের শক্তি প্রর্দশন, সাহস-মনোবল শাণিত হয়। সর্বোপরি মহান আল্লাহর রজ্জুকে অভিন্ন  ভাবে আঁকড়ে ধরার এক চেতনা জাগ্রত হয়। আল্লাহর দেওয়া জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বের হতে শিক্ষা দেয়। মানব কল্যাণে জীবন বির্সজন দিতে তাবলীগ এক অনুপম দৃষ্টান্ত। শেষ রাতে মাওলায়ে হাক্বিকির দরবারে আপাদ মস্তক লুটিয়ে দিতে এবং  খেদমতে খালক এর অনুশীলনের এক উৎকৃষ্ট প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র হলো  তাবলীগ ও ইজতেমা!
প্রচলিত তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন ভারতবষের্র মুসলমানদের এক ক্রান্তিকালে বিংশ শতাব্দীর ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাধক হযরত মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলভী (১৮৮৫-১৯৪৪ খ্রি.)। রাজস্থানের মেওয়াত নামক এলাকা থেকে শুরু হওয়া এই কাজের তিনি  মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর জীবদ্দশায়ই এই মহৎ কার্যক্রম ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তাবলীগ জামাতের রূপকার মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.) দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সময় শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলভীও এই কার্যক্রমের প্রাণপুরুষ ছিলেন। মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.) পরবর্তীকালে তাবলীগ জামাতের অন্যতম আমির ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মুখ নিঃসৃত শাশ্বত বাণী: ‘তোমার কাছে যদি কোনো বাণী থাকে, তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’ এ দাওয়াতি আহ্বানকে কেন্দ্র করেই পর্যায়ক্রমে তাবলীগের বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসার ঘটে। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত আজকের তাবলীগ জামাতের সার্থক রূপকার মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) বলেছেন, দাওয়াত ও তাবলীগের উদ্দেশ্য হলো ‘ঈমানের দাওয়াত। এ দাওয়াত নিজের সংশোধন তথা গোটা মানবজাতির মুক্তির দাওয়াত। ঈমানের এই দাওয়াতের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর দেয়া জীবন, সম্পদ এবং সময় আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে এর সঠিক ব্যবহার পদ্ধতি শিক্ষা-জানা এবং বাস্তব জীবনে এর সঠিক প্রয়োগ করার পাশাপাশি আল্লাহ ভোলা মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক করে দেয়ার মেহনত করা।’ মানবজীবনে আজ এই দাওয়াতের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তিনি তৎকালীন ধর্ম-কর্মহীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমানদের দ্বীনের পথে আনার জন্য সর্বপ্রথম এ মেহনত চালু করেন। ১৯১০ সালে ভারতের প্রত্যন্ত এলাকা মেওয়াত থেকে সামান্য ক’জন মানুষ নিয়ে তিনি প্রচলিত তাবলীগের কাজ শুরু করেন, যা এখন গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) সারাজীবন পথহারা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে এই দাওয়াত ও তাবলীগ জামাত তথা বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের ঐক্যের প্রতীক বিশ্ব ইজতেমাকে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এক সুদৃঢ় মজবুত ও শক্তিশালী অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি স্থাপন করে ১৯৪৪ সালের ১৩ জুলাই ৫৯ বছর বয়সে ইহকাল ত্যাগ করেন।
মরহুম ইলিয়াস  (রহ.) অনুধাবন করেছিলেন যে, জনগণের বৃহত্তর অংশে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সুদৃঢ়করণ ও তার বাস্তব অনুশীলন না হলে মানবসমাজে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। বরং সাধারণ মানুষের জীবনে দ্বীন ইসলাম না আসলে মু’মিন হতে পারে না। তাই তিনি ১৩৪৫ হিজরিতে দ্বিতীয় হজ্ব থেকে ফিরে এসে তিনি তাবলীগ গাশ্ত শুরু করলেন, জনসাধারণের মাঝে কালেমা ও নামাযের দাওয়াত দিতে লাগলেন। তাবলীগ জামাত বানিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বের হওয়ার দাওয়াত দিলেন। এভাবে গ্রামে গ্রামে কাজ করার জন্য জামাত তৈরি করে দিতেন। কয়েক বছর মেওয়াতে এ পদ্ধতিতে কাজ অব্যাহত থাকলো। শুধু ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে সামগ্রিক জীবন পাল্টে দেয়া বা জাহেলী বিশ্বাসকে পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়। তাই একমাত্র উপায় হিসেবে তাদের ছোট ছোট জামাত আকারে ইলমী ও দ্বীনি মারকাজগুলোতে গিয়ে সময় কাটানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন এবং ধর্মীয় পরিবেশে তালিম দিতে আরম্ভ করলেন। সেই ধর্মীয় মজলিসে উলামা-মাশায়েখদের ওয়াজ-নসিহতের পাশাপাশি তাদের দৈনন্দিন জীবনের নিয়মনীতি বাতলে দেয়া হতো। দ্বীনদার পরহেজগার লোকদের জীবনযাপন, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চাল-চলন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। ধর্মীয় মৌলিক বিশ্বাস ও ইবাদতের অনুশীলনের পাশাপাশি তিনি মুসলমানদের অনুসৃত প্রধান ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনের প্রয়োজনীয় কিছু সূরা- ক্বেরাত শিক্ষাদান, দোয়া-দরূদ, জরুরি মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে অবহিত করে তার তাবলিগ জামাতকে একটি ভ্রাম্যমাণ মাদরাসাতে রূপান্তরিত করেন। প্রথম ইজতেমা সম্পর্কে হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী তার ‘একটি নূরানী ইজতিমা’ ও ‘হযরত মাওলানা ইলিয়াস (রাহ.) ও তাঁর দ্বীনি দাওয়াত’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন,৮, ৯ ও ১০ জিলক্বদ ১৩৬০ হিজরি, মোতাবেক ২৮, ২৯ ও ৩০ নভেম্বর ১৯৪১ খৃস্টাব্দে প্রথম দিল্লীর নিজামুদ্দীন মসজিদের ছোট এলাকা মেওয়াতের নূহ মাদ্রাসায় যে তাবলীগ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়, মেওয়াতভূমির মানুষেরা এত বড় সমাবেশ ইতিপূর্বে আর দেখেনি। বাস্তবানুগ ধারণা মতে লোকসংখ্যা ছিল বিশ/পঁচিশ হাজার। এদের একটা বিরাট অংশ নিজের সামান ও নিজের খাবার-দাবার কাঁধে করে ত্রিশ/চল্লিশ ক্রোশ পথ হেঁটে হাজির হয়েছিলেন। বহিরাগত বিশিষ্ট মেহমানদের সংখ্যাও হাজারের কাছাকাছি ছিল। তারা মুঈনুল ইসলাম মাদরাসার ভবনে শানদার মেহমানদারিতে ছিলেন। মজমার সুপ্রশস্ত শামিয়ানার নিচে জুম্মার নামাজ পড়িয়েছিলেন শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (র)। জামে মসজিদসহ প্রায় মসজিদে নামায হওয়া সত্ত্বেও প্রধান জামাতের কাতারের কারণে সড়ক চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ছাদে ও বালাখানার উপরেও শুধু মানুষ আর মানুষ দেখা যাচ্ছিল।’
বাংলাদেশে তাবলীগ : অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোজাহেদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) ও হযরত মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ.)-এর মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে বাংলাদেশে তাবলীগের কাজ শুরু হয়। হযরত মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ.)-এর প্রথম আমির ছিলেন। বার্ষিক ইজতেমার প্রয়োজন অনুভব করে হযরত মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.) মুরব্বীদের নিয়ে পরামর্শ করেন। বৈঠকে বাংলাদেশের নাম বেরিয়ে আসে। তাবলীগ জামাতের সদর দফতর দিল্লীতে থাকা সত্ত্বেও এর বার্ষিক সমাবেশের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেয়া হয়। আর সেই থেকেই বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের প্রতীক মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ সমাবেশ ও মহাসম্মেলন বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশে এসে নয়া দিগন্তে পৌঁছে। বিশ্ব ইজতেমাকে উপলক্ষে করে যে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সমাগম ঘটে তা হঠাৎ করে হয়নি। নিবেদিত প্রাণ তাবলীগ অনুসারীদের নিরলস প্রচেষ্টায় বিশ্ব ইজতেমা আজকের রূপ লাভ করেছে। অতঃপর ১৯৪৬ সালে বিশ্ব ইজতেমা সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় কাকরাইল মসজিদে। পরে ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্পে। এরপর ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে, তারপর ১৯৬৫ সালে টঙ্গীর পাগারে এবং সর্বশেষ ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৭ সালে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমার স্থান নির্ধারণ করা হয়।  সেই থেকে এ পর্যন্ত এখানেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ইজতেমা ।তখন থেকেই বিশ্ব ইজতেমা প্রকৃত অর্থেই বিশ্ব ইজতেমা এবং দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশস্থলে পরিণত হয়। ইজতেমায় দেশি-বিদেশি ধর্মপ্রাণ মানুষের উপস্থিতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার টঙ্গীর ইজতেমাস্থলের জন্য সরকারি জমি বরাদ্দ করে এবং বিশ্ব ইজতেমার পরিধি আরো বড় হয়ে ওঠে। বিগত ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখিত জায়গায় বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবার লিখিত অনুমতি প্রদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সরকার এই জায়গায় ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয় এবং অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন করে।  ১৯৬৭ সাল থেকে বর্তমান অবধি (২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে) ‘বিশ্ব ইজতেমা’ টঙ্গীর কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদের উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু মিলিয়ে রাজউকের ১৬০ একর জায়গার বিশাল খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।  একই স্থানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এবং মুসল্লীদের দুর্ভোগ লাঘবের সুবিধার্থে কয়েক বছর যাবত দুই পর্বের ছয় দিনে বিশ্ব ইজতেমা হয়ে আসছে। বিশ্ব ইজতেমা বলতে এখন বাংলাদেশের টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত তাবলীগ জামাতের ইজতেমাকেই বোঝায়। এই ইজতেমা আমাদের দেশের জন্য বয়ে এনেছে প্রভূত সম্মান। বিশ্ব ব্যাপী উজ্জ্বল করেছে দেশের ভাবমূর্তি। সাধারণত তাবলীগ জামাতের অংশগ্রহণকারীরা সর্বনিম্ন তিন দিন আল্লাহর পথে কাটানোর নিয়ত করে থাকেন। সে হিসেবে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় তিন দিন জুড়ে। এ তিন দিনের মধ্যে শুক্রবারকে রাখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। শুক্রবার ফজর নামাজের আম বয়ান বা উন্মুক্ত বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হয় ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা এবং রোববার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়। অনেকে শুধু জুম্মার নামাজ কিংবা আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেন আখেরি মোনাজাতে।
বিভিন্ন  দেশের অংশ গ্রহণ : ইজতেমা ময়দানের উত্তর পার্শ্বে টিনের ছাউনিযুক্ত কামরা সম্প্রসারণ করে প্রায় ৩০ হাজার বিদেশী মেহেমান অবস্থানের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যেসব দেশের মুসল্লিগণ ইজতেমায় অংশ গ্রহণ করে আসছেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, সুইডেন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, নরওয়ে, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিসর, শ্রীলংকা, কাতার, ইরান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, জর্দান, মরোক্কো, ওমান, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া, তিউনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন, জার্মানী, কানাডা, হংকং, আলজেরিয়া, কেনিয়া, বাহরাইন, জাম্বিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, ইটালী, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় ১০০টি দেশের মুসল্লিগণ বিশ্ব ইজতেমায় শরীক হয়ে থাকেন।
বিশেষ আকর্ষণ : বিশ্ব ইজতেমার বিশেষ একটি বিশেষ আকর্ষণ হলো যৌতুকবিহীন বিয়ে পড়ানো। প্রতিবছরই ইজতেমায় শত শত যৌতুকবিহীন বিয়ে পড়ানো। হযরত ফাতেমা (রাঃ) ও হযরত আলীর (রাঃ) বিয়ের দেনমোহর অনুসারে বিনা যৌতুকে এসব বিয়ে স¤পন্ন হয়ে থাকে। বয়ান শেষে বর- কনের অভিভাবকদের উপস্থিতে বিয়ে পড়ান হয়। পরে উপস্থিত দ¤পতিদের স্বজন ও মুসল্লিদের মধ্যে খুরমা-খেজুর বিতরণ করা হয়ে থাকে।
সেবা কার্যক্রম : ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান ইজতেমা ময়দানের উত্তর পার্শ্বে নিউ মন্নু কটন মিলের অভ্যন্তরে মেডিক্যাল ক্যা¤েপ চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে প্রতি বছরই। এসব চিকিৎসা ক্যা¤েপর মধ্যে রয়েছে হামদর্দ, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল লিঃ, জনকল্যাণ ফ্রি মেডিক্যাল সেন্টার, টঙ্গী পৌরসভা ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), হার্ট ফাউন্ডেশন, ইসলামী ফাউন্ডেশন উল্লেখযোগ্য। বিশ্ব ইজতেমা মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য লালন করে আসছে। আল্লাহ উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন। ইজতেমায় সে বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ইসলামের আদর্শ সামনে রেখে এখানে কোনো মুসলমানকে ছোট করে দেখা হয় না। আল্লাহর কাছে প্রত্যেক মুসলমানের মূল্য আছে- এখানে এটা ভালোভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। মুসলমানদের কোনো ভাগে বিভক্ত করা হয় না। এক মুসলমান যেন আরেক মুসলমানকে সম্মান করে সেজন্য জোর তাগিদ দেয়া হয়। কোনো মাজহাবের মুসলমানকে খাটো করা হয় না। বরং সবাইকে ঈমান ও আমলের মেহনতের প্রতি আহ্বান করা হয়। তারা একই প্লেটে খাবার খান, একইসঙ্গে ঘুমান। কারও মধ্যে কোনো হিংসা, ঘৃণা থাকে না। ধনি-দরিদ্র, সাদা-কালোর পার্থক্য থাকে না। সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ থাকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী সব মানুষের চাওয়া-পাওয়া এক হয়ে যায়। এই সমতা সত্যিই এক মহান দৃষ্টান্ত।
লেখক : সহসভাপতি-অনলাইন জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশন সিলেট (ওজাস)।