কাজিরবাজার ডেস্ক :
বছরটি প্রায় শেষ হতে চলেছিল! দিন যতো গড়াচ্ছিল সন্দেহ, কৌতুহল ঘনীভূত হতে হতে ক্ষোভ জমাট বাঁধতে শুরু করেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের। ‘হীন রাজনৈতিক আপস হয়েছে’ বলেও অনেককে সমালোচনা করতে দেখা গেছে এ সময়। শেষ পর্যন্ত সকল আলোচনা-সমালোচনায় পানি ঢেলে কাক্সিক্ষত রায়ই দিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে নিজামীকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে। বছরের শেষ ভাগে এসে জনকাক্সিক্ষত এ রায় হলেও এটিই ছিল বিদায়ী ২০১৪ সালের প্রথম রায়।
বিচারিক নানা বাধ্য-বাধকতা কাটিয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার পর গত ২৪ জুন রায় ঘোষণার দিনক্ষণ ঠিক হলেও বদর প্রধানের নাকি সেদিন রক্তচাপ (কারা ডাক্তারের বক্তব্য মোতাবেক) বেড়ে গিয়েছিল! নিন্দুকেরা এর আগে থেকেই নানা কথা বলাবলি করে আসছিলেন। উচ্চ রক্তচাপের এ আকস্মিক ঘটনায় নিন্দুকদের নিন্দা নতুন মাত্রা পায়।
শেষ পর্যন্ত গত ২৯ অক্টোবর হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের দেশান্তরকরণ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের এ মহা খলনায়ককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ক্ষ্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
দশ মাসে এসে বছরের প্রথম রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। সেই থেকে শুরু। সব মিলিয়ে বিদায়ী বছরে মোট ৬ যুদ্ধাপরাধীর রায় ঘোষিত হয়েছে, যারা সবাই পেয়েছেন মৃত্যুদণ্ডাদেশ।
বদর প্রধান নিজামীর রায়ের তিনদিন পর ২ নভেম্বর চট্টগ্রামের বদর কমান্ডার জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর মামলার রায় হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মীর কাসেম আলীকেও মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি জান্তারা আদর করে তাকে ডাকতো ‘খান সাহেব’ নামে। আর ‘বাঙালি খান’ নামে কুখ্যাতি ছিল তার মুক্তিকামী বাঙালি জাতির কাছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত একাত্তরের ছাত্রসংঘ বা আলবদর বাহিনীর উত্তরসূরী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন চট্টগ্রামের এই বদর কমান্ডার। চট্টগ্রামে পাকিস্তানিদের আদর সেবাযতœ যা করার তিনিই করতেন। মীর কাসেম আলী ‘খান সাহেব’ নামের অবিচার করেনি এতোটুকু।
আশির দশক থেকে জামায়াতকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভীতের ওপর দাঁড় করান এই মীর কাসেম আলীই। যোগ্যতার বলেই সর্বশেষ দলের কর্মপরিষদ ও কার্যনির্বাহী সদস্যপদ লাভ করেন।
২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল যখন এ বদর কমান্ডারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা করেন তখন এজলাসকক্ষের কাঠগড়ায় বেশ ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিলেন দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম।
রায় পর পর বিচারকদের উদ্দেশ্য করে মীর কাসেম আলী ‘মিথ্যা ঘটনা’, ‘মিথ্যা সাক্ষী’, ‘কালো আইন’, ‘ফরমায়েশি রায়’ ইত্যাদি মন্তব্য করেন, যা সুস্পষ্টভাবে আদালত অবমাননা। আদালতের রায়ে কোনো পক্ষ বিক্ষুব্ধ হলে আইনানুগভাবেই তার প্রতিবাদ জানাতে পারেন। উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন। কিন্তু সেটি কোনোভাবেই আদালতকে চ্যালঞ্জ বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারেন না।
অথচ মীর কাসেম আলী সেই কাজটিই করেছেন। তিনি কেবল আদালত নয়, আইন, বিচারক, সাক্ষী সবার প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। একটি অনলাইন বার্তা সংস্থার খবর অনুযায়ী তিনি ‘শয়তান’ ‘শয়তান’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠেন।
যাক, চিৎকার, চেঁচামেচিতে তো আর বিচারের রায় পরিবর্তন হয়ে যায় না?
রায়ের অপেক্ষার পরে সিরিয়ালে ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা ও জামায়াতের সাবেক রোকন মোবারক হোসেনের মামলাটিও। তিনিও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পান ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে। সামাজিক বা রাজনৈতিকভাবে এই অপরাধী ততোটা ডাকসাইটে না হলেও একাত্তরে স্থানীয় পর্যায়ে ছিলেন ভীষণ কুখ্যাত।
বছরের শেষ মাসে এসে অল্প সময়ের ব্যবধানে দেওয়া হয় আরো তিনটি রায়। এ তিনজনও পান ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ।
১৩ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ঘোষণা করা হয় ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার সাবেক মেয়র জাহিদ হোসেন খোকন রাজাকারের মামলার রায়। ঠিক ১০ দিনের মাথায় সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ কায়সারের মামলার রায়।
ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের হওয়ার আভাস পেয়েই ফরিদপুরে বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা খোকন রাজাকার দেশ থেকে লাপাত্তা। পরে এই অপরাধীর অনুপস্থিতিতেই বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। যদিও পরবর্তীতে সুইডেনে হদিস মেলে স্বঘোষিত এই রাজাকারের। তবে এখন পর্যন্ত এই দণ্ডিত অপরাধী ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এর পরেই আসে কায়সারের পালা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় অপরাধ সংঘটিত করতে হবিগঞ্জ এলাকায় নিজের নামেই বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী। কায়সার এবং তার বাহিনীর অপরাধ ছিল রোমহর্ষক। কিন্তু পরবর্তীতে পতিত স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে প্রতিমন্ত্রী হয়ে উপযুক্ত পুরস্কার(!) লাভ করেন।
রাজনৈতিকভাবে পুরস্কৃত হলেও আইনি প্রক্রিয়ায় এতোটুকু ছাড় পাননি একাত্তরের হিংস্র কায়সার। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-২।
ফাঁসির এ দড়ি গলায় না জড়ানোর জন্য চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না কায়সারের পক্ষ থেকে। সময় মতো ‘অসুস্থ’ হয়েছেন, প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, তিনি শারীরিকভাবে অক্ষম। বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে এজলাসকক্ষে অনবরত হাত কাঁপানোর মতো ভেকও ধরেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হয়নি কায়সারের। আইনের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি কোনো ছল-ছাতুরিতেই।
বছরের শেষ রায়টি এলো ২০১৪ সালের শেষ দিনের ঠিক আগের দিন। ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। বিদায়ী বছরের শেষে এসে এ রায়ে দেশের মানুষ যে বেশ উল্লসিত, তা রায়ের পর বিভিন্ন মহলের উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়াতেই বোঝা গেছে!
একাত্তরে রংপুর জেলা আলবদর বাহিনীর কমান্ডার এ টি এম আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে ও সহযোগিতায় একাত্তরে আলবদর, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা রংপুরে এক দিনে ১ হাজার ২২৫ জনসহ মোট ১২৫৭ জন মানুষকে হত্যা করে, গণহত্যা চালায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর। এসব অপরাধের দায়ে আজহারুলকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
মীর কাসেম আলীর মতো এটিএম আজহারও রায় ঘোষণাকালে ট্রাইব্যুনালে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন, অভিসম্পাত করেছেন বিচারকদের উদ্দেশ্য করে। উদ্ধত হয়ে রায়কে ‘ফরমায়েশি রায়’ বলেছেন।
ট্রাইব্যুনাল অবশ্য রায় ঘোষণার আগেই বলে দিয়েছিলেন, এখানে কোনো রাজনেতিক বা ধর্মীয় নেতার বিচার হচ্ছে না। সাক্ষ্য-প্রমাণ, আইন-সংবিধানের আলোকে বিচার হচ্ছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের। সেই অপরাধী কোন রাজনেতিক দলের কোন পর্যায়ের নেতা বা কোন পর্যায়ের ধর্মীয় নেতা তা বিবেচ্য বিষয় নয়।
যদিও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে কুখ্যাত জামায়াত আসামূীপক্ষের আইনজীবীরা বরাবরের মতোই দাবি করেছেন, ‘রাজনৈতিক হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতেই’ তাদের সব ‘নির্দোষ নেতাদের’ নামে ‘মিথ্যা মামলা’ সাজানো হয়েছে। আর সাজানো মামলার রায়ে তাদের একের পর এক নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এ নিয়ে দু’টি ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৫টি মামলার রায় দিলেন। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-১ সাতটি ও ট্রাইব্যুনাল-২ আটটি মামলার রায় দিয়েছেন। দুই ট্রাইব্যুনালে আরও একটি করে দু’টি মামলা রায়ের অপেক্ষায় আছে।
নতুন বছরে অপেক্ষমান এ দু’টি মামলায়ও কাক্সিক্ষত রায় পাবেন বলেই বিশ্বাস প্রসিকিউশনের।