কাজিরবাজার ডেস্ক :
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়ার প্রতিবাদে আজ বুধ ও বৃহস্পতিবার দুইদিনের হরতাল ডেকেছে দলটি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মঙ্গলবার দুপুরে এই রায়ে আজাহারুলকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেয়।
তারই প্রতিবাদে দলের পক্ষ থেকে এই হরতাল ডাকা হয়েছে। রায় ঘোষণার পরপরই এক বিবৃতিতে এ হরতাল ঘোষণা দেয় জামায়াত।
আজহারুলের ফাঁসি : জামায়াত নেতা ও একাত্তরে রংপুরের বদর কমান্ডার ও জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। তার বিরুদ্ধে আনা ছয় অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিই প্রমাণিত হয়েছে।রংপুরের বদরগঞ্জে লুণ্ঠন ও ১৫ জনকে হত্যার অভিযোগ ছাড়াও ঝাঁড়ুয়াবিলে ১২শ লোককে হত্যার নেতৃত্ব দেয়ার যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা প্রমাণিত হয়েছে।এ ছাড়া কারমাইকেল কলেজে চার শিক্ষককে অপহরণ করে হত্যার অভিযোগটিও প্রমাণিত হয়েছে।একটি বাদে সব অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে।তার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে ফাঁসি এবং একটিতে ২৫ বছরের জেল এবং একটিতে ৫ বছরের জেল এবং বাকি একটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সেটিতে তিনি খালাস পেয়েছেন।এটিএম আজহারুল সেই সময় রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়াশুনা করতেন।
প্রমাণিত ৫টি অভিযোগের মধ্যে ২, ৩ ও ৪ নং অভিযোগ (তার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগ নিচে দেয়া হলো) প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ৫ নং অভিযোগে তাকে ২৫ বছর জেল ও ৬ নং অভিযোগে ৫ বছরের জেল দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে ১ নং অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে রংপুর অঞ্চলে ১২শ ২৫ ব্যক্তিকে গণহত্যা, ৪ জনকে হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণ, ১৩ জনকে আটক ও নির্যাতন এবং শতশত বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ- এই ছয়টি অভিযোগ আনা হয়।
চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মঙ্গলবার সকাল সোয়া এগারটায় রংপুরের বদর নেতা এটিএম আজহারের রায় পড়া শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে ১৫৮ পৃষ্ঠার রায় সারসংক্ষেপ আকারে পাঠ করা হয়।
এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে ট্রাইব্যুনালের এজলাসে নেয়া হয়।এর কিছুক্ষণের মধ্যেই রংপুরের বদর কমাণ্ডারের রায় পাঠ শুর হয়।এর আগে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনা হয় এবং তাকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় রাখা হয়। এ দিকে ট্রাইব্যুনালের আশপাশে নিরাপত্তা জোরদার কর হয়েছে। নিরাপত্তা পরিস্থিতি সরেজমিন দেখার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ আদালত চত্বরে যান এবং দায়িত্বরত অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেন।
মঙ্গলবার সকাল নয়টার দিকে কারাগার থেকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে এনে আজহারকে রাখা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায়। এর আগে সকাল পৌনে নয়টার দিকে কারাগার থেকে বের করে তাকে নিয়ে ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্যে রওনা হয় প্রিজন ভ্যানটি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর জেলা আলবদর বাহিনীর কমান্ডার আজহারের মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আজ।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেবেন।
আজহারের বিরুদ্ধে আনা ছয়টি অভিযোগের বিস্তারিত দেয়া হলো-
প্রথম অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২৭ মাচের্র মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাসানী (ন্যাপ) নেতা ও রংপুর শহরের বিশিষ্ট আয়কর আইনজীবী এ ওয়াই মাহফুজ আলীসহ ১১ জনকে অপহরণ, আটক শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এরপর তাদের ৩ এপ্রিল রংপুর শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে গণহত্যা চালানো হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, আসামি একাত্তরের ১৬ এপ্রিল তার নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ধাপপাড়ায় ১৫ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে গুলি করে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেন।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, এ আসামি একই বছরের ১৭ এপ্রিল নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিল এলাকায় এক হাজার ২০০ বেশি নিরীহ লোক ধরে নিয়ে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেন। চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, ১৭ এপ্রিল কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপক পত্মীকে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অপহরণ করে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন।
পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে রংপুর শহর ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মহিলাদের ধরে এনে টাউন হলে আটকে রেখে ধর্ষণসহ শারীরীক নির্যাতন চালান। একই সঙ্গে মহিলাসহ নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের অপহরণ, আটক, নির্যাতন, গুরুতর জখম, হত্যা ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এ আসামি।
ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ায় একজনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। একই বছরের ১ ডিসেম্বর রংপুর শহরের বেতপট্টি থেকে এজনকে অপহরণ করে রংপুর কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে নিয়ে আটক রেখে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন ও গুরুতর জখম করেন।
মামলার ধারাবাহিক কার্যক্রম : মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ১-এর আদেশে ২০১২ সালের ২২ আগস্ট নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় এটিএম আজহারুল ইসলামকে। সেই থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
গত বছরের ১২ নভেম্বর এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, নির্যাতন, আটক, অপহরণ, গুরুতর জখম ও অগ্নিসংযোগের ৬টি অভিযোগ আনা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রংপুর অঞ্চলে ১ হাজার ২২৫ ব্যক্তিকে গণহত্যা, ৪ জনকে হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণ, ১৩ জনকে আটক ও ১৩ জনকে নির্যাতন এবং শত শত বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের সঙ্গে আজহার জড়িত ছিলেন বলে এসব অভিযোগে বলা হয়। এ ছাড়া ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়েও অভিযুক্ত হয়েছেন তিনি।
২৭ আগস্ট থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আসামীপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আজহারের আইনজীবী আবদুস সুবহান তরফদার ও শিশির মোহাম্মদ মুনির। ১৮ আগস্ট থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত ও বৃহস্পতিবার আজহারের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ও তাপস কান্তি বল।