॥ আতিকুর রহমান নগরী ॥
চারিদিকে আজ নির্যাতিত মুসলমানের কান্না শুনা যাচ্ছে। মুসলমানের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে পড়েছে। কি ব্যাপার? অধিক সংখ্যক মুসলমানের দেশে মুসলমানরা কেন নির্যাতিত। সত্যিই তো! এর কারণ কি? তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশত বছর পূর্বে শান্তির বার্তাবাহক মহানবি (সা.) বলেছিলেন, ‘এমন এক সময় আসবে যখন মুসলমানরা সংখ্যায় অধিক হবে, তদুপরি তারা কাফের-মুশরিক, নাস্তিক-মুরতাদ তথা বিধর্মী পরাশক্তির ফেলা জালে আবদ্ধ হয়ে নানা বিপদের সম্মুখীন হবে।’ এর কারণ হবে তারা ঐক্যের বন্ধনে থাকবে না।
ঐক্য। যার গুরুত্বের অন্ত নেই। অপরিসীম গুরুত্বের অধিকারি বিষয়টি হচ্ছে ঐক্য। মহান সৃষ্টিকর্তা মহাগ্রন্থ আল কোরআনে সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ থাকার তাগিদ করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে অর্থাৎ “তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর, আর পরস্পর পৃথক হয়ো না।” (সূরাঃ আল্-ইমরান, আয়াতঃ ১০৩) হাদিস শরিফে মহানবি হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) ইরশাদ করেন, অর্থাৎ ‘আল্লাহর নুসরাত তথা সাহায্য দলবদ্ধ জামাতের উপর।’ যেখানে ঐক্য নেই সেখানে খোদায়ি সাহায্য আশা করা আকাশ কুসুম ছাড়া কিছুই নয়। এ থেকেই আমরা অনুভব করতে পারি মুসলমানদের অধঃপতনের পিছনে মূল রহস্য কী?
মুসলিম উম্মাহর পতনের কারণ :
হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ভবিষ্যতে মানুষের সামনে এমন একটা যুগ আসবে যখন নাম ব্যতিরেকে ইসলামের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, আল-কোরআনের আক্ষরিক তেলাওয়াত ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। তাদের মসজিদ গুলো হবে বাহ্যিক দিক দিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হবে হেদায়াত শূন্য। আর তাদের আলেমগণ হবে আকাশের নিচে জমিনের উপরে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। কারণ তাদের মধ্য থেকে ইসলাম/দ্বীন সম্পর্কে ফিতনা প্রকাশ পাবে। অত:পর সে ফিতনা তাদের দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে।” (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান অধ্যায়)
আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যা :
এ হাদীসের মধ্যে রাসূল (সা.) মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে নিম্নোক্ত ভবিষ্যৎবাণী করেছেন।
১. ইসলামের নামটা ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকবে না :
রাসূল (সা.) এই পৃথিবীতে এসেছিলেন সকল মতবাদের উপরে ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্যদ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সকল দ্বীনের উপর তা বিজয়ী করে দেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” (সূরা আস-সফ, আয়াত ৯)
ইসলামকে বিজয়ী আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ অবর্ণনীয় কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করেছেন। এক পর্যায়ে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (সা.) এর মাধ্যমে দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিআমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে।” (সূরা মায়েদা, আয়াতঃ ৩)
মানবতার কল্যাণে যে ইসলাম বা জীবন ব্যবস্থা পৃথিবীতে এসেছে সেই ইসলামের বাস্তব প্রতিফলন সমাজে থাকবে না। শুধু নামে থাকবে ইসলাম। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে দলে দলে বিভক্ত হওয়ার বিষয়ে সতর্কবাণী উল্লেখ পূর্বক খুবই সুক্ষèভাবে ঘোষণা করেছেন, “তারপর লোকেরা তাদের মাঝে তাদের দ্বীনকে বহুভাগে বিভক্ত করেছে। প্রত্যেক দলই তাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে উৎফুল্ল।” (সূরা মুমিনুন, আয়াতঃ ৫৩)। “যারা নিজদের দ্বীনকে বিভক্ত করেছে এবং যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে (তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না)। প্রত্যেক দলই নিজদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত।” (সূরা আর-রূম, আয়াতঃ ৩২)
২. আল-কোরআনের আক্ষরিক তিলাওয়াত ছাড়া আর কিছুই থাকবে না :
মহাগ্রন্থ কোরআনে কারিম বিশ্ব মানবতার হেদায়াতের একমাত্র গাইডলাইন। পৃথিবীর যে কেউ হেদায়াত পেতে চাইলে তাকে এর ছায়াতলে আসতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “নিশ্চয় এ কোরআন এমন একটি পথ দেখায় যা সবচেয়ে সরল এবং যে মু’মিনগণ নেক আমল করে তাদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।” (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৯) আল্লাহ তা‘আলা আল-কোরআনে আরো বলেন, “অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে শান্তির পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে এবং তাঁর অনুমতিতে তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন। আর তাদেরকে সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।” (সূরা মায়েদা ১৫-১৬) এই কোরআনকে সম্পূর্ণভাবে মেনে চললে সকল সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, “আর আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা, হিদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ।” (সূরা আন-নাহল ৮৯)। বর্তমান সময়ের মুসলমানগণ এই আল-কোরআনকে তেলাওয়াত সর্বস্ব কিতাবে পরিণত করেছে। এ কথার দ্বারা এটা মনে করার সুযোগ নেই যে, কোরআন তেলাওয়াত করা যাবে না। বরং আল-কোরআন তেলাওয়াত করলে আপনি অবশ্যই প্রতি হরফে ১০টি করে নেকি পাবেন। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল কোরআন তেলাওয়াত করবে প্রতিটি হরফের তার জন্য রয়েছে ১০টি করে সওয়াব।” (আল-বুরহান ফি উলুমিল কোরআন) আল-কোরআনের হক হচ্ছে তাকে তেলাওয়াত করতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে, বাস্তব জীবনে কোরআনের বিধান মেনে চলতে হবে। এ সম্পর্কে আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,-
“যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা তা পাঠ করে যথার্থভাবে। তারাই তার প্রতি ঈমান আনে। আর যে তা অস্বীকার করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা বাকারা )কারণ এই আল-কোরআন কিয়ামতের দিন আপনার আমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, “আল কোরআন তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে।” (আহকামুশ-শরীয়াহ)
৩. হেদায়াতশূন্য জাঁকজমকপূর্ণ মসজিদ :
রাসূল (সা.) এর জামানায় মসজিদ ছিলো সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দু। সাড়ে নয় লক্ষ বর্গমাইলের প্রেসিডেন্ট রাসূল (সা.) তাঁর কোন রাজ সিংহাসন ছিলো না। ছিলো না গণভবন বা প্রেসিডেন্ট মহল। মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে অথবা বসে ইসলামী রাষ্ট্রের সকল কার্যাদি সম্পাদন করতেন। তখন রাষ্ট্রীয় সচিবালয় ছিলো মসজিদ। এখানে মানুষ নামাজ আদায় করত, খুৎবা/ভাষণ শুনতো, তালিম-তারবিয়াত হতো, পড়ালেখা হতো, বিচার-ফয়সালা করা হতো। কিন্তু আমাদের সমাজে নামাজ আদায় করা ছাড়া আর কোন কাজ করা হয় না।
মুসলিম জাতির আদর্শিক পিতা হযরত ইবরাহীমের (আ.)’র আদর্শ অনুসরণ করত: রাসূল (সা.) একটি সুসংগঠিত জাতি তৈরী করেছিলেন। আমরা আজ সে আদর্শে উদাসীন হয়ে নানা দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। এ যেন নিম্নোক্ত হাদীসের জলন্ত প্রমাণ। রাসূল (সা.) বলেছেন, “বনি ইসরাঈলরা বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিলো আর আমার উম্মতরা তেহাত্তর দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। তন্মধ্যে একটি ছাড়া বাকিরা জাহান্নামে যাবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন সে দল কোনটি? রাসূল (সা.) বললেন, ‘আমি আমার সাহাবীদের নিয়ে যে কাজ করেছি এ কাজগুলো যারা করবে তারাই হবে জান্নাতি’। (সূনানে আত-তিরমিযি) এ সকল দলগুলো তৈরী হয়েছে খোলাফায়ে রাশেদীনের পর থেকে অদ্যাবধি সমাজের এক শ্রেণীর আলেমগণের মাধ্যেমে। রাসূল (সা.) প্রায় সাড়ে নয় লক্ষ বর্গমাইল এলাকার রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে একটি অবিভাজ্য দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। রাসূল (সা.)’র পর তাঁর উত্তরসূরী হযরত উমর (রা.) বারো লক্ষ বর্গমাইলের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অনুরূপ একটি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অথচ বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবীর মুসলমানরা নানা দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এটাই মুসলিম বিশ্বের পতনের বহুবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ। একজন মুসলমান আর একজন মুসলমানকে বরদাস্ত করতে পারে না। বাংলাদেশেও বর্তমানে সবচেয়ে বেশী অনৈক্য, দলাদলি ও বিভেদ রয়েছে মুসলমানদের মধ্যে। এমতাবস্থায় আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে কোরআন-সুন্নাহ, রাসূল (সা.)’র সীরাত, ও সাহাবায়ে কেরামদের জীবনালেখ্য অধ্যয়ন করে সরাসরি আমল করতে হবে। এছাড়া আমাদের দেশের আলেমগণের পারস্পারিক বিরোধিতাপূর্ণ ফতোয়া দান বন্ধ করে, তাদের মধ্যকার ছোট-খাটো বিভেদ নিরসন মধ্যদিয়ে ভ্রাতৃত্বের সাঁকো তৈরী করে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যে জাতি পৃথিবীর বুক স্পেশাল এক পাওয়ার নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতো। যে জাতির সাহসি হুংকারে বাতিলরা ভয়ে কাঁপতো। যে জাতির নাম শুনলে আবু জেহেল, উতবা, শাইবার মত শীর্ষ কাফের নেতারা লেজ গুটিয়ে পালাতো। যে জাতি পৃথিবীর অন্যান্য জাতির নেতৃত্ব দিত আজ সেই জাতি তার পুরনো ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে জাতির বিবেক উলামায়ে কেরামই দায়ী। ছোট মুখে বড় কথা হলেও বলতে হবে। কেউ হয়তঃ আমায় বেয়াদব উপাধিতে ভূষিত করার কথা ভাবছেন। যে যাই বলুন না কেন? আমাকে আমার বাক স্বাধীনতায় বলতে দিন। কলমকে স্বাধীন ভাবে লিখতে দিন। এই দিশেহারা মুসলিম জাতির, সিরাতে মুস্তাক্বিম থেকে পথ বিচ্যুত জাতির, মুনিব ভোলা মুনিব জাতির, আত্মভোলা মুসলিম উম্মাহর, পরিচালনার গুরুদ্বায়িত্ব ধারাবাহিকতার পালাক্রমে উলামায়ে কেরামের উপরই অর্পিত হয়েছে। হাদিস শরিফে আপনাদেরকেই তো “ওরাসাতুল আম্বিয়া’’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তবে কেন আমাকে দোষারূপ! পঙ্গপালের মত ছোটাছুটি করছে জাতি, উত্থানের দেখা না পেয়ে অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে মুসলিম জাতি আপনাদের সামনে। এখনো কি নীরব বসে থাকবেন। এখনো কি মসজিদ-মাদ্রাসা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাবেন। এখনো কি দারস-তাদরিস, তালিম-তাআল্লুম নিয়ে দিবানিশী সময় পার করবেন। আপনাদেরকেই যে হাল ধরতে হবে জীর্ণ-শীর্ণ ঘূণে ধরা মুসলিম জাতির। বে-শক আপনারাই পারবেন এ জাতিকে অধঃপতনের রেল লাইন থেকে উদ্ধার করতে। তবে আর শংকা কীসের? আজই নেমে পড়–ন তাসবিহ হাতে ময়দানেতে।
পরিশেষে মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে প্রার্থনা করি তিনি যেন মুসলিম উম্মাহকে সকল ইখতিলাফ আর বিবাদ ভুলে গিয়ে ঐক্যের প্লাটফর্মে হাজির হওয়ার তৌফিক দান করেন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।