কাজিরবাজার ডেস্ক :
বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) দুর্যোগে টিকে থাকা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশাকে সামনে রেখে আগামী অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। যার মাধ্যমে চলমান অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে পূর্বের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতে এক নতুন অর্থনীতির ভিত রচিত হবে।
অর্থমন্ত্রী তার এবারের বাজেটের শিরোনাম দিয়েছেন ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যত পথ পরিক্রমা’। অর্থাৎ করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করে দেশকে আবার আগের মতো উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যেতে চান। তিনি আশা প্রকাশ করেন বলেন, এই বাজেটের হাত ধরেই আমরা অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে পূর্বের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতের কাক্সিক্ষত নতুন অর্থনীতির ভিত রচনা করব। আইএমএফ ঘোষণা করেছে, আগামী বছর আমাদের প্রবৃদ্ধি হবে ৯.৫ শতাংশ। যে আমানিশার অন্ধকার আমাদের চারপাশকে ঘিরে ধরেছে, তা একদিন কেটে যাবেই। ইতিহাস সাক্ষী, বাঙালি জাতি শৌর্যবীর্যের এক মূর্ত প্রতীক। জাতীয় জীবনে কালক্রমে যেসব সঙ্কট দুর্যোগ এসেছে, বাঙালি জাতি সম্মিলিত শক্তির বলেই সেসব থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে। জাতির পিতা নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সবাই এক পরিবার হয়ে একে অপরের সাহায্যে করোনাভাইরাস মোকাবেলার যুদ্ধেও আমরা জয়ী হবো, ইনশাআল্লাহ।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি অব্যাহত রাখার জন্য অর্থমন্ত্রী এবার রাজস্ব প্রশাসনে শুধু সংস্কারের পদক্ষেপই গ্রহণ করেননি, রাজস্ব ব্যবস্থাপনায়ও বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন। করোনার কষ্ট থেকে দেশবাসীকে লাঘব দেয়ার জন্য দীর্ঘ ৫ বছর পর করমুক্ত আয়ের সীমা তিনি বাড়িয়েছেন। আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বনিম্ন করমুক্ত আয়ের সীমা তিনি ৩ লাখ টাকা করেছেন। দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য ছাড় দিয়েছেন কর্পোরেট কর হারে। দীর্ঘ ৬ বছর পর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ৩৫ শতাংশ থেকে আড়াই শতাংশ হ্রাস করে ৩২.৫ শতাংশ করেছেন। পুঁজিবাজার, আবাসনসহ কয়েকটি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা (অপ্রদর্শিত অর্থ) সাদা করার সুযোগ দিয়েছেন। বিশেষ করে, আগামী অর্থবছরে এক কোটি দরিদ্র মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা বাজেটের একটি মাইলফলক উদ্যোগ।
অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সংসদ অধিবেশনে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে অর্থমন্ত্রী তার দ্বিতীয় বাজেট উপস্থাপন করেন। যার সিংহভাগই ডিজিটার ব্যবস্থার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। কিছু অংশ তিনি নিজে মুখে বাজেট বক্তৃতার বই থেকে পাঠ করেন। রেকর্ড স্বল্প সময়ে অর্থাৎ মাত্র ৪৫ মিনিট সময়ে অর্থমন্ত্রী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। এই সময়ের মধ্যেই তিনি অর্থনীতি ও সমাজ জীবনে কোভিড-১৯ এর প্রভাব এবং তা থেকে উত্তরণে তার নীতি ও পদক্ষেপগুলো তুলে ধরেন। এসময় তিনি কোভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলোও জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন।
এ প্রসঙ্গে স্মারণ করিয়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘করোনার প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় জরুরী স্বাস্থ্যসেবা খাতের ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার প্রায় ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।’
বাজেটের বৈশিষ্ট্য : প্রস্তাবিত বাজেটে জরুরী, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী সব ধরনের পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যাতে করে করোনায় যা ক্ষতি হয়েছে তা কমানো যায়। এ বাজেট করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এবং দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কাজ করবে। অর্থাৎ প্রস্তাবিত বাজেটের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে- দেশের মানুষের জীবন রক্ষা করা এবং সচল রাখা। পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়ানো ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগও রয়েছে বাজেটে।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসকে সঠিকভাবে মোকাবেলা ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব দৃঢ়তার সঙ্গে কাটিয়ে ওঠার স্বার্থে আমরা গতানুগতিক বাজেট হতে এবার কিছুটা সরে এসেছি। সেকারণে এবারের বাজেটে সরকারের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতকে এবার সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এবং করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ, প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, কৃষি হচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত। আমরা অধিক খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ ও বীজে প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসনে জোর প্রদান এবং সারের ওপর ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখব।
আমাদের তৃতীয় অগ্রাধিকার খাত হচ্ছে দীর্ঘ সাধারণ ছুটি ও লকডাউনজনিত কারণে দরিদ্র কর্মজীবী মানুষের কষ্ট লাঘবে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা সম্প্রসারণ। আর সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকা- আংশিক বন্ধ থাকায় শিল্প উৎপাদন, এসএমই, সেবা খাত ও গ্রামীণ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মহীনতা এবং কর্মহীন হয়ে দেশে ফেরত আসা প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য ব্যাপক কর্মসৃজন ও পল্লী উন্নয়ন হতো চতুর্থ অগ্রাধিকার খাত।
প্রবৃদ্ধি নিয়ে আবারও স্বপ্ন : প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবৃদ্ধি নিয়ে দেশবাসীকে আবারও স্বপ্ন দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি করোনা পরিস্থিতির মাঝেও নতুন ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করেছেন। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ হচ্ছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার। যা সংশোধিত জিডিপির তুলনায় নতুন জিডিপি ৩ লাখ ৬৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা বেশি। চলতি বাজেটে (সংশোধিত) জিডিপির আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ লাখ ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫.২ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, জাতির পিতার শতবার্ষিকীকে আমরা সবাই পুরোপুরি প্রত্যয়ী ছিলাম এ বছর আমরা আমাদের অর্থনীতিতে দেশের সেরা প্রবৃদ্ধিটি জাতিকে উপহার দেব। এক্ষেত্রে আমাদের ইপ্সিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮.২ থেকে ৮.৩ শতাংশ। আমরা শুরু করেছিলাম সুন্দর আশাদীপ্তভাবে অসাধারণ গতিতে। অর্থবছরের প্রথম ৮ মাস পর্যন্ত আমরা অর্থনীতিতে একটি শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছিলাম। কিন্তু করোনার প্রভাব সারা বিশ্বের মতো আমাদের অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশও উলট-পালট করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, বিগত এক দশক ধরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত হারে বেড়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমকি ১৫ শতাশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, যা এশিয়ার সব দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী দীর্ঘসময় ধরে চলা লকডাউনের কারণে রফতানি কমায় এবং প্রবাস আয়ে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জিত না হওয়ায় চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সংশোধন করে ৫ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে করোনা পরবর্তী উত্তরণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সময় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হবে বলে আশা করছি।
বাজেটের আকার : প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৭.৯ শতাংশ। এ বাজেট ব্যয়ের সিংহভাগই যাবে অনুন্নয়ন খাত তথা পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয়ে। বাজেটে মোট পরিচালন ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন ব্যয় হচ্ছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এই ব্যয় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি। টাকার অঙ্কে যা ৬৬ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা বেশি। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হলেও পরবর্তীতে সংশোধিত বাজেটে এর আকার দাঁড়ায় ৫ লাখ ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা।
পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে অন্যতম ব্যয় হচ্ছে বেতন-ভাতা ও ঋণের সুদ পরিশোধ। এসব খাতে ব্যয় হবে ৩ লাখ ১১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। অপরদিকে উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে অন্যতম ব্যয় হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি)। এডিপিতে মোট ব্যয় হবে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা।
এডিপিতে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হবে মানব সম্পদ খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য)। এ খাতে ব্যয় হবে মোট এডিপি বরাদ্দের ২৮.৫ শতাংশ অর্থ। সার্বিক কৃষি খাতে (কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান, পানি সম্পদ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) ব্যয় হবে ২২ শতাংশ অর্থ। এছাড়া বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে ১৩ শতাংশ, যোগাযোগ (সড়ক, রেল, সেতু ও যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) খাতে ২৫.৪ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ১১.১ শতাংশ অর্থ ব্যয় হবে।
রাজস্ব বাজেট : করোনাভাইরাসের থাবায় থমকে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য। দেশে ৬৬ দিন লকডাউন থাকার পর এখন সীমিত আকারে অফিস আদালত খুললেও করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগবে বলেই দেশীয় ও বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস থেকে জানা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেও সরকারের আয়ের মূল উৎস রাজস্ব আদায় তলানিতে ঠেকলেও বেড়েছে ব্যয়ের খাত। তাই বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে সরকার বৈদেশিক অনুদান পাবে ৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা। ফলে সবমিলিয়ে আগামী অর্থবছরে সরকারের আয় দাঁড়াবে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৩ কোটি টাকা।
এর মধ্যে করসমূহ থেকে পাওয়া যাবে ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। করসমূহের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত করসমূহ থেকে রাজস্বে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কর ব্যতীত রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
আবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আদায়ের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)। আগামী অর্থবছরে ভ্যাট থেকে আয় হবে ১ লাখ ২৫ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। এছাড়া আয়কর থেকেও আসবে বড় অঙ্কের অর্থ। এক লাখ ৩ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা পাওয়া যাবে আয়কর থেকে। সম্পূরক শুল্ক থেকে আসবে ৫৭ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা, আমদানি শুল্ক থেকে পাওয়া যাবে ৩৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। এছাড়া রফতানি শুল্ক বাবদ ৫৫ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে ৩ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর থেকে পাওয়া যাবে এক হাজার ৫৩০ কোটি টাকা।
রাজস্ব আয়ের এ লক্ষ্যমাত্রা অজন নিয়ে শুরুতেই অনেক সংশয় দেখা দিয়েছে। এমনকি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানও বলেছেন এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। তবে অর্থমন্ত্রী আশাবাদী। তিনি মূলত সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জন করতে চান। এ প্রসঙ্গে তিনি বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, আমরা সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন শুরু করেছি। কিন্তু অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে কোভিড-১৯ এর প্রভাবে আমরা সেগুলো সফলভাবে শেষ করতে পারিনি। তাই গৃহীত এ সকল সংস্কারমূলক কার্যক্রম আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত রাখতে চাই।
বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৬ শতাংশ : আয় ও ব্যয়ের এ বিশাল ফারাকের বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ৬ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রথম বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যদিও আশির দশক ও নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে জিডিপির ৫.৫ থেকে ৬ শতাংশ বাজেট ঘাটতি ছিল নিয়মিত ব্যাপার। তবে বর্তমান সরকারের আগের বছরগুলোতে সাধারণত জিডিপির ৫ শতাংশ হারে ঘাটতি ধরেই বাজেট প্রণয়ন করা হয়ে আসছিল। করোনা মহামারীর কারণে অর্থনীতি সচল করাই হলো আসল কথা। এক্ষেত্রে ঘাটতি কত হলো তা বিবেচ্য বিষয় নয়।
এ বিশাল ঘাটতি পূরণে সরকার কোন খাত থেকে কত টাকা ঋণ নেবে অর্থাৎ কিভাবে ঘাটতি অর্থায়ন করবে তারও একটি ছক তৈরি করেছেন অর্থমন্ত্রী। ছক অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরের ঘাটতি পূরণে সরকার বৈদেশিক উৎস থেকে ৮০ হাজার ১৭ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে।
অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ঘাটতির বড় একটি অংশ পূরণ করতে চায় সরকার। ব্যাংক খাত থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে যা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। এছাড়া সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে ৫ হাজার ৩ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করা হবে।
সংশোধিত বাজেট : চলতি অর্থবছরের বাজেটে সর্বমোট সরকারী ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এ ব্যয় ২১ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা হ্রাস করে ৫ লাখ ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। মূল বাজেটের সঙ্গে সঙ্গে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আকারও ২ লাখ ২ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা হতে ৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা হ্রাস করে ১ লাখ ৯২ হাজার ৯২১ কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে কোভিড-১৯ এর কারণে স্বাস্থ্য খাতে এবং বিভিন্ন প্রণোদনা বাস্তবায়নে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় সাশ্রয় করে পরিচালনাসহ অন্যান্য ব্যয়ের প্রক্কলন ১১ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা হ্রাস করা হয়েছে। ফলে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের পরিচালনা ব্যয় ৩ লাখ ১০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা থেকে হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯৫ হাজার ২৮০ কোটি টাকা।
ফলে বাজেট ঘাটতি এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫০৮ কোট টাকা। যা জিডিপির ৫.৫ শতাংশ। এই ঘাটতি বৈদেশিক উৎস থেকে নীট ৫২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৯৭ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই ঋণ গ্রহণ করা হবে ৮২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা।
মন্ত্রী সভায় বাজেট অনুমোদন : অপরাহ্ন ৩টায় জাতীয় সংসদে এ বাজেট উপস্থাপনের আগে মন্ত্রী সভা তা অনুমোদন দেয়। বৃহস্পতিবার (১১ জুন) দুপুরে জতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এক বিশেষ মন্ত্রী সভার বৈঠকে এ বাজেটের অনুমোদন দেয়া হয়।
এরপর নিয়মানুযায়ী আগামী অর্থবছরের এই প্রস্তাবিত বাজেটে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ অনুমোদন দিয়ে স্বাক্ষর করেন বলে সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে। পরে বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সংসদ অধিবেশনে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী।
এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সরকারের ১০ মন্ত্রী। তারা হলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, স্থানীয় সরকার বিভাগ মন্ত্রী তাজুল ইসলম, শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এবং পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান।