মো. আব্দুল হাছিব
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিলেট নগরী, উপজেলা এবং মহাসড়কে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে ছিনতাই ও ডাকাতি। রাতে পুলিশের স্বাভাবিক টহল না থাকার সুযোগে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী ও ডাকাতদের উপদ্রবে অনেক পরিবার হচ্ছেন নিঃস্ব। সিলেট অঞ্চল প্রবাসী অধ্যুষিত, স্বাভাবিকভাবেই প্রবাসীরা বিভিন্ন সময় দেশে আসেন। ছিনতাই-ডাকাতি বেড়ে যাওয়ায় প্রবাসী ও সাধারণ মানুষের মাঝে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা বাড়ছে। গত প্রায় দুই মাসে যতগুলো ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে তার সবই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা না থাকার জন্য বলে মনে করছেন সচেতন মহল। কয়েকটি ঘটনা অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছিনতাইকারীরা মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ছিনিয়ে নিচ্ছে নগদ টাকা ও মোবাইল ফোনসামগ্রী। এছাড়াও ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার পথে ছিনতাইয়ের স্বীকার হচ্ছেন অনেকেই। ছিনতাইকারিদের জন্য নিরাপদে নেই দিন ও রাতের নগরী। গত ২ নভেম্বর শাহজালাল উপশহর এলাকায় দিনেদুপুরে ছিনতাইকারীরা ফুলকলি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড এর ১লাখ নব্বই হাজার টাকা নিয়ে যায়। এ ঘটনায় শাহপরাণ থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। লিখিত অভিযোগ করেছেন, ফুলকলি ফুডপ্রোডাক্টস লিমিটেড সিলেট বিভাগরে ডিজিএম মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।
অভিযাগের বিবরণে জানা যায়, শনিবার ফুলকলির নিজস্ব গাড়ি চালক মোঃ আবু সালেহ চৌধুরী (৪২) প্রতিষ্ঠানের চন্ডিপুল শাখা থেকে ১লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা এবং লালা বাজার শাখা থেকে ষাট হাজার গ্রহণ করে ফের গাড়ি যোগে খাদিম নগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। শিবগঞ্জ আসা মাত্র গাড়িটি বিকল হয়ে যায়। পরে শিবগঞ্জস্থ শিবলী মটরসে গাড়ি রেখে যন্ত্রাংশ ক্রয় করার জন্য তিনি সুবহানীঘাটে আসেন। সেখানে ক্রয় শেষে বেলা ১২টার দিকে উপশহর রোজভিউর সামনে থেকে লোকাল সিএনজি যোগে শিবগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। এ সময় গাড়িতে উঠে আরো তিন যাত্রী।
শাহজালাল উপশহরের বি-বøকের নার্সিং কলেজের সম্মুখে আসামাত্র ওই তিন যাত্রী অভিনব কায়দায় একলক্ষ নব্বই হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে দ্রæত পালিয়ে যায়।
এর আগে ২ অক্টোবর ফিল্মি স্টাইলে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এক ব্যাংক কর্মচারীর কাছ থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারিরা।
ছিনতাইয়ের শিকার শাহীন আহমেদ গোলাপগঞ্জের বাঘা এলাকার মাসুক মিয়ার ছেলে। তিনি আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক গোলাপগঞ্জ শাখার অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত। শাহীন আহমেদ জানান, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লালদীঘিরপাড় শাখা থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা উত্তোলন করে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে গোলাপগঞ্জ ফিরছিলেন তিনি। কদমতলী ওভারব্রিজের কাছে যাওয়ার পর ৩ মোটরসাইকেলে ৬ ছিনতাইকারী এসে ধারালো অস্ত্রেও মুখে তার কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। ছিনতাইকারীদের মাথায় হেলমেট ও টুপি ছিল।
গত ৭ নভেম্বর নগরীর দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশের অভিযানে চার ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসময় তাদের কাছ থেকে ছিনতাই করা দুটি মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে।
কদমতলীস্থ রেলস্টেশন গেইট এলাকা থেকে তিনজনকে ৮ নভেম্বর গোলাপগঞ্জ উপজেলার দত্তরাইল গ্রাম থেকে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সিলেট মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃতরা সংঘবদ্ধ হয়ে পথচারীদেরকে আটক করে চাকু দিয়ে ভয় দেখিয়ে ও জোর করে মোবাইল, টাকা, স্বর্ণালঙ্কাকারসহ মূল্যবান মালামাল ছিনতাই করতো। এঘটনায় দক্ষিণ সুরমা থানায় মামলা করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন শাহীরুল ইসলাম জীবন (১৯), তানভীর হোসেন (১৮), রিমন আহমদ (১৮) ও শাকিল আহমদ (১৯)। তাদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ সুরমা থানায় মামলা দায়ের করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বেশি আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে ডাকাতি। উপরাপুর কয়েকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে সিলেট নগরীতে। গত ৩ অক্টোবর নগরীর মেজরটিলা (ইসলামপুর) মোহাম্মদপুর আবাসিক এলাকার বøক-সি’র প্রত্যাশা-৮নং বাসায় রাত ৪টার সময় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতরা বাসার গ্রিল কেটে ঘরে প্রবেশ করে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বাসার মালিক ও তার স্ত্রীকে বেঁধে স্বর্নালংকার, ২টি মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনার ৪ থেকে ৫ দিন পর সকাল ৯টার সময় নোহা লাইটেসযোগে একদল ডাকাত নগরীর ২৭নং ওয়ার্ডের আলমপুর গ্রামে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আব্দুর নূরের মুদির দোকান থেকে নগদ টাকাসহ মালামাল নিয়ে যায়। একই ওয়ার্ডে ৩ দিনের মাথায় পৈত্যপাড়ার ব্যবসায়ী পিযুষ পালের বাসায় দুর্গাপূজায় নবমীর রাতে ঘরের তালা ভেঙে ১৫ ভরি স্বর্ণালংকারসহ নগদ টাকা নিয়ে যায় একদল ডাকাত। অপরদিকে ৭ই নভেম্বর নগরীর ৪১নং ওয়ার্ডের পশ্চিমভাগ আবাসিক এলাকায় আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে আরেকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় ওয়্যারড্রপে থাকা ৮০ হাজার টাকা, দেড় ভরি সোনা, ৩টি মোবাইল ফোন ও একটি পালসার মোটরসাইকেল (সিলেট মেট্রো ল ১১৭৬৪৫) নিয়ে যায়।
সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায়ও নিয়মিত ডাকাতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিয়ানীবাজার ইনার কলেজ রোড সংলগ্ন কাজী রেজাউল কবিরের বাড়িতে ভোর রাতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
গত ২০ আগস্ট দিবাগত রাত ৩ টার দিকে পৌর শহরের নিদনপুর গ্রামের হাজীপাড়ায় সালেহ আহমদের বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এসময় পরিবারকে জিম্মি করে অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কারসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিয়ে যায় ডাকাতরা।
গত ২০ সেপ্টেম্বর ভোররাতে গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ী পূর্বপাড়ার মাসুম আহমেদের (৭০) বসতঘরে সশস্ত্র অবস্থায় হাফপ্যান্ট পরিহিত মুখোশধারী ডাকাতদল হানা দেয়। এ সময় নগদ টাকা, ৪ ভরি ওজনের ১টি স্বর্ণের ব্রেসলেট, ৮টি স্বর্ণের কানের দুল, ২টি স্মার্টফোন লুটে নেয়। ১৭ই আগস্ট সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার দিঘালীগ্রামে প্রবাসী আব্দুল কাইয়ুমের বাড়ীতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ডাকাতরা দেশীয় অস্ত্র ও পিস্তল নিয়ে বাড়ির লোকজনদের জিম্মি করে মারধর করে নগদ ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা, ৪ ভরি স্বর্ণালংকার, মোবাইল, আইপড, ট্যাবসহ প্রায় ৭ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
একের পর এক ডাকাতির ঘটনায় জনমনে দেখা দিয়েছে ভয়। অনেকে জীবনের ভয়ে ঘরে যা কিছু আছে, তুলে দিচ্ছেন ডাকাতদের হাতে। পুলিশী টহল কমে যাওয়া, চেকিং না থাকাসহ নানা কারণে ডাকাতি, ছিনতাই করে নিরাপদে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা।
এসব ডাকাতির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন ভুক্তভোগীরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর সিলেট সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশের কার্যক্রম পূর্বের মত শক্তিশালী অবস্থায় না থাকায় সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। এ কারণে সিলেট অঞ্চলে ছিনতাই ও ডাকাতি বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশের টহল ও নজরদারী বৃদ্ধি পেলে অনেকাংশেই এসব অপরাধ কমে যাবে বলে বিশ্বাস করি।
এ বিষয়ে সিলেট জেলা পুলিশের সহকারী সুপার সম্রাট তালুকদার বলেন, ৫ই আগষ্টের সময় আমাদের সিলেটের বিভিন্ন থানা ক্ষতিগ্রস্থ, ট্রান্সপোর্টের সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে পুলিশের স্বাভাবিক কার্যক্রমে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের যোগদানের পর তাঁর নেতৃত্বে পুলিশের সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠছে। বর্তমানে পুলিশ টহল ও নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমরা প্রতিদিনই সিলেটের বিভিন্ন জায়গা থেকে অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। ইতিমধ্যে ডাকাতদলের অনেক সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছে, অভিযান চলমান রয়েছে।
মেট্রোপলিটন এলাকায় ঘন ঘন ডাকাতি ও ছিনতাই নিয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ রেজাউল করিম পিপিএম (সেবা) বলেন, এসব ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশের চৌকস কর্মকর্তারা কাজ করছেন। ডাকাতির সাথে জড়িতরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে, যার কারণে তাদের গ্রেফতার করতে একটু সময় লাগছে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এসব ডাকাতির ঘটনা নিয়ে কাজ করছে, তবে দ্রæত জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন ছিনতাইকারী ও ডাকত দলের আটক করেছে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে ধারালো অস্ত্র ও লুটকৃত মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।