কমলগঞ্জে বন্যায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন

0

পিন্টু দেবনাথ, কমলগঞ্জ
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় টানা বৃষ্টি, ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ধলাই নদীতে ভাঙনে সৃষ্ট বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। পানিতে বিভিন্ন এলাকায় নিম্ন আয়ের প্রায় শতাধিক পরিবারের কাঁচা ও আধা কাঁচা বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি-ঘরের মালিকদের কেউ কেউ এখনও বসবাস করছেন খোলা আকাশের নিচে। অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আর্থিক সংকটের কারনে ধ্বসে পড়া ঘর মেরামত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঘর নির্মাণের জন্য বিত্তবানদের দ্বারে দ্বারে কেউ কেউ ধর্ণা দিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বন্যার পানিতে ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ১৪টি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। এতে প্লাবিত হয় উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার বিস্তির্ণ এলাকা। প্রায় ১৪৫টি গ্রাম নিমজ্জিত হয়। পানিবন্দি হয় ৪১ হাজার ৬শ’ ৬১টি পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ। পানিতে তলিয়ে যায় সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর আমনক্ষেত ও আউশ ফসল। ২ হাজার পুকুর, ফিশারি ও জলাশয়ের সব মাছ পানিতে ভেসে যায়। পানির তোড়ে ভেঙ্গে যায় আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদের রাস্তাঘাট। এলজিইডি আওতাধীন ৮০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রত্যন্ত এলাকার প্রায় শতাধিক কাঁচা বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত ও আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ভেসে উঠেছে এই ক্ষতের চিত্র।
উপজেলার সীমান্তবর্তী ইসলামপুর ও আদমপুর ইউনিয়নের ৫৫টি পরিবারের টিনশেডের মাটির কাঁচা বসতঘর বানের স্রোতে লন্ডভন্ড হয়েছে। আদমপুর ইউনিয়নের বনগাঁও এলাকার আনোয়ার মিয়া, তাজ মিয়া, সুন্দর মিয়া, সাবিহা বেগম, আজাদ মিয়া, নাজমা বেগম, রজব আলীসহ কমপক্ষে ২০টি বসতঘর ভেঙে পড়েছে। চাম্পারায় চা বাগানের গহুর বুনার্জী, অছয় সূর্যবংশী, অনিরুদ্ধ তংলা, দেওয়ান মুন্ডা, সুমেশ রায়, উত্তম রাজভর, গুপেশ গড়, সুবাস কর্মকার, রাজু গড়, ইছামতির দুলাল কর্মকার সহ কমপক্ষে ২৫টি বসতঘর ভেঙে পড়েছে। একইভাবে কুরঞ্জি এলাকায় গকুল রজক ও নকুল রজকসহ কমপক্ষে ১০টি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়া বন্যায় উপজেলার শমসেরনগর, আলীনগর, পতনঊষার ও মুন্সীবাজার ইউনিয়নে অসংখ্য ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আউশ ফসল, আমন ক্ষেত, শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সাবিহা বেগম বলেন, মাথা গোঁজার শেষ সম্বল বন্যার পানিতে ভেঙে গেছে। আমরা এখন কোথায় যাবো? যেখানে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে ঘর ঠিক করবো কী করে? নাজমা বেগম বলেন, এমনিতেই তিন বেলা খেতে পারিনা, এর মধ্যে বন্যায় ঘর ভেঙ্গে ফেলেছে। এখন পেটে ভাত দিবো না ঘর মেরামত করবো? এই চিন্তায় আছি। কেউ যদি সাহায্য করতো, তাহলে কোন রকম জান বাঁচাতে পারতাম।
সাম্প্রতিক বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ উপজেলার কৃষি খাত।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, বন্যায় ১ শত হেক্টর আউশ ও ৩ হাজার হেক্টর আমনের ফসল ও সবজ্বি ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। এতে উপজেলার প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এছাড়া কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়ের ছাইয়াখালী হাওর, পতনঊষার ইউনিয়নের কেওলার হাওর এলাকা সবচেয়ে নিচু হওয়ায় ও বন্যার পানি স্থায়ী হওয়ায় সেখানকার কৃষক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পাশাপাশি আমনের চারা না থাকায় কৃষকরা পাশের উপজেলা থেকে অধিক মূল্যে চারা সংগ্রহ করছেন।
কৃষক মসুদ মিয়া, সামসু মিয়া, আবুল খায়ের জানান, আমনের চারা রোপণ করার কয়েক দিন পর থেকে বন্যা শুরু হয়। বন্যার পানির নিচে থাকায় জমির আমনের রোপিত চারা পচে নষ্ট হয় যায়। এখন বন্যার পানি কমলেও নতুন করে চাষ করার মতো সময় নেই। তাছাড়া সার, বীজ এবং শ্রমিকের মজুরি বাবদ যে অর্থ খরচ হবে সেটাও ব্যয়ভার বহন কঠিন। সরকারিভাবে সহযোগিতা না করলে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব, এখন অনেক কৃষকের অবস্থাই তাদের মতো।
কমলগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার রায় জানান, বন্যায় উপজেলার সাড়ে ৬ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হয়েছে। কৃষকদের মাঝে দ্রæত সময়ে আমনের ৭৫ ও বীনা -১৭ জাতের বীজ সরবরাহ করা হবে। যা দ্রæত সময়ে রোপন করা যাবে, এতে কিছুটা হলেও কৃষক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে।
আদমপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবদাল হোসেন ও ইসলামপুর ইউ চেয়ারম্যান সুলেমান মিয়া জানান, বন্যায় বেশকিছু ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলেও দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষের। বসতঘরের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় গৃহহীন হয়েছেন অনেক পরিবার। বসতঘর হারানো এসব মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর দিনযাপন করছেন।
এ ব্যাপারে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, আমরা পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ পেয়েছি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তালিকা তৈরি করে দ্রæত পুনর্বাসনের কাজ শুরু করা হবে।