কাজির বাজার ডেস্ক
প্রাথমিক স্তরের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। কিন্তু কোন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে সে বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন বারবার তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে। ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত মূল্যায়ন নির্দেশনা ছিল ডায়েরি ১ ও ডায়েরি ২ পদ্ধতি ব্যবহারের। সেই পদ্ধতির আলোকে এরই মধ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণও সম্পন্ন করা হয়েছে।
কিন্তু সম্প্রতি এনসিটিবির ওয়েবসাইটে প্রাথমিক স্তরে পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর (পিআই) ভিত্তিক ভিন্ন পদ্ধতির মূল্যায়ন পদ্ধতির নির্দেশনা আপলোড করা হয়েছে। এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, ওয়েবসাইটে প্রকাশিত পিআইভিত্তিক নতুন এই মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করতে এনসিটিবি থেকে এরই মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। শিক্ষকরা আগের নিয়মের ওপর প্রশিক্ষণ পাওয়ার পরও তা বাস্তবায়ন করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন, সেখানে আচমকা নতুন ও অচেনা মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করায় মাঠপর্যায়ের প্রশাসন ও স্কুলে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, এই মূল্যায়ন পদ্ধতি চ‚ড়ান্ত নয়। কিন্তু চ‚ড়ান্ত না হলে সেটি কীভাবে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনসিটিবির ওয়েবসাইটে নির্দেশনা আপলোড করা হয় মূলত মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুমোদন লাভের পর। এ বিষয়ে কর্মকর্তারাও কোনো কিছু স্পষ্ট করেননি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত বছর নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণিতে। চলতি বছর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ডায়েরি-১ ও ডায়েরি-২ পদ্ধতির ওপর। সেই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন চালুও করা হয়েছে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শিখনফল ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে মূল্যায়ন করেছেন। ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে ‘ট্যানজেরিন টিচ’ নামে একটি অ্যাপও তৈরি হয়েছে। অ্যাপটি ব্যবহার করে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করতে শেখানোর জন্য অনেক টাকা ব্যয় করে দেশব্যাপী প্রশিক্ষক পুলও তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু নতুন এই মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হলে সেটি আর কার্যকর হবে না।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের জন্য প্রস্তুতকৃত নৈপুণ্য অ্যাপ প্রাথমিকের জন্যও ব্যবহার করতে চুক্তি হতে যাচ্ছে।
ধারাবাহিক মূল্যায়নের ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২০ সালে দেশের ১০০টি স্কুলে ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করে পাইলটিং করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে সেসব স্কুলের শিক্ষক ও মনিটরিং কর্মকর্তাদের সেই পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পাইলটিংয়ের ফলাফলে দেখা যায়, শিক্ষকরা সেটি বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। এরপর ২০২২ সালে নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর আরেকটি মূল্যায়ন ব্যবস্থা তথা নতুন পদ্ধতিতে ডায়েরি ১ ও ডায়েরি ২ চালু হলো। তার আলোকে ২০২৩ সালে প্রথম শ্রেণির শিক্ষক নির্দেশিকাও ছাপানো হলো। পাইলটিংয়ের ফলাফলে দেখা গেল, সেটিও শিক্ষকদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এরপর ২০২৪ সালে এসে সূচক তথা পারফরমেন্স ইন্ডিকেটরের মাধ্যমে আরেকটি মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বারবার পরিবর্তন প্রমাণ করে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষকদের বাস্তব পরিস্থিতি, ছাত্র-শিক্ষক সংখ্যা বিবেচনা, সম্ভাব্যতা যাচাই এসব না করেই ধারাবাহিক মূল্যায়নের নামে এসব কাÐ করা হচ্ছে। এতে সরকারের যে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হলো, তার দায় কে নেবে? পাইলটিং আর কতবার করা হবে?
শিক্ষকদের কাছ থেকে জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাথমিকের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে শিক্ষকরা ডায়েরি-১ ও ডায়েরি-২ ব্যবহার করেন। যোগ্যতা ও শিখনফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান (কহড়ষিবফমব) এর জন্য (ক), দক্ষতা (ঝশরষষ) এর জন্য (ঝ) এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ (অঃঃরঃঁফব) এর জন্য (অ) সূচক ব্যবহার করা হয়। ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও ফলাবর্তন প্রদানের জন্য শিক্ষক ডায়েরি-১ পূরণ করেন। এরপর পাঠভিত্তিক অর্জন যোগ্যতার মানকে শতকরায় রূপান্তর করতে হয়। ধারাবাহিক মূল্যায়নে শিক্ষক প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সর্বশেষ ফলাফল সংরক্ষণ করেন এবং তা নির্দিষ্ট পাঠ শেষে ডায়েরি-২ এ লিপিবদ্ধ করেন। চলমান এই পদ্ধতি এখনো বাতিল করা হয়নি। এই পদ্ধতিতে ছাপানো ২০২৩ সালের প্রথম শ্রেণির শিক্ষক নির্দেশিকাও এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। এর মধ্যে আবার এনসিটিবির ওয়েবসাইটে নতুন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশিকা অনুযায়ী, প্রাথমিকেও মাধ্যমিকের মতো চিহ্ন বা নম্বরভিত্তিক মূল্যায়ন করা হবে।
নির্দেশিকায় শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতার সূচক রাখা হয়েছে তিনটি। এগুলো হলো ভালো (এড়ড়ফ বা এ), খুব ভালো (ঠবৎু এড়ড়ফ বা ঠ) এবং উত্তম (ঊীপবষষবহঃ বা ঊ)। পারদর্শিতার নির্দেশকের বিপরীতে পারদর্শিতার মাত্রানুযায়ী শিক্ষকদের মূল্যায়ন করা হবে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন তথ্য সংরক্ষণ করবেন শিক্ষকরা। শ্রেণিকক্ষে শিখনকালীন মূল্যায়ন শেষে শিক্ষার্থীর মূল্যায়নের তথ্য মূল্যায়ন নির্দেশিকার খালি ছকে সংরক্ষণ করতে হবে। এরপর ছকের তথ্য ‘মূল্যায়ন তথ্য সংরক্ষণ ও রিপোর্ট কার্ড প্রস্তুতকরণ’ অ্যাপে (প্রোগ্রামেবল এক্সেল ফাইল) ইনপুট দিতে হবে।
এদিকে মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে মাঠপর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন পড়েছে দোটানায়। কারণ, কখন কোন নিয়ম হচ্ছে তারা সেটি বুঝতে পারছে না। এর ওপর রয়েছে এনসিটিবির সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব। বছরের মাঝামাঝি ভিন্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন চালু হলে সেটি আয়ত্ত করা কষ্টসাধ্য হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।
শিক্ষকরা বলছেন, ডায়েরি ১ ও ২ শিক্ষকদের বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী বাস্তবায়নযোগ্য হয়নি। সে কারণে ডায়েরি দুটিকে সরল ও ব্যবহারযোগ্য করার দাবি ছিল শিক্ষকদের। কিন্তু তা না করে মূল্যায়ন পদ্ধতি আরও জটিল করা হচ্ছে। আবার নতুন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হলে এত টাকা দিয়ে শিক্ষক সহায়িকা ছাপানো হলো কেন? আবারও কি কোটি টাকা ব্যয়ে মূল্যায়ন প্রশিক্ষণ হবে? সেটি হলে এই টাকার দায় কে নেবে, দাতাগোষ্ঠী, পিইডিপি-৪ নাকি জিওবি ফান্ড?
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, ভিডিও দেখে প্রশিক্ষণ নেওয়া যায় না। অবশ্যই প্রশিক্ষণ লাগবে। তবে সেটি বছরের শুরু থেকে হলে ভালো হতো। আবার শিক্ষকরা মূল্যায়নের এক পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তা নিয়ে অভিযোগ ছিল। এখন নতুন পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ পেতেও ভোগান্তি কম হবে না। জগাখিচুড়ি অবস্থা দাঁড়াবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, মাধ্যমিকের মূল্যায়নের যে মানদÐ রয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। আমরা সে বিষয়ে মতামত দেব। এরপর মূল্যায়ন পদ্ধতি চ‚ড়ান্ত হবে। তবে আগে যেমন ছিল, তার জন্য শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। এখন পরিবর্তনের জন্যও তো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেক্ষেত্রে মূল্যায়ন পদ্ধতি চ‚ড়ান্ত হলে আমরা প্রশিক্ষণের দিকে যাব।
এনসিটিবি সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মোখলেস উর রহমান বলেন, ডায়েরি-১ ও ডায়েরি-২ পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষকদের আপত্তি থাকায় নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাথমিকের মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ জরুরি ছিল। সেজন্য এটি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে পাঠিয়েছি।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ডায়েরি ১ ও ২ পদ্ধতিতে মূল্যায়ন শিক্ষকদের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। প্রতিদিন তথ্য ইনপুট দিয়ে যোগ-বিয়োগ করা শিক্ষকদের জন্য কষ্টসাধ্য। পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন যেহেতু পিআইনির্ভর, সে কারণে প্রাথমিক থেকেই পিআইনির্ভর মূল্যায়ন চালু করা হচ্ছে।