চুনারুঘাট প্রতিনিধি
অনাবৃষ্টি ও অতিরিক্ত গরমে রুক্ষ হয়ে গেছে চুনারুঘাটের সবক’টি চা বাগান। এতে চলতি মৌসুমে চা উৎপাদন কমার পাশাপাশি ব্যবসায় বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কায় আছে বাগান কর্তৃপক্ষ। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় বাগানের চারাগাছ মরে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে নানা রোগবালাই। এরই মধ্যে গত মৌসুমের তুলনায় চা পাতার উৎপাদন কমে গেছে তিন ভাগ। নতুন পাতা আর কুঁড়ি না আসায় চা শ্রমিকরাও নির্ধারিত পরিমাণ চা পাতা সংগ্রহ করতে পারছেন না। চা বাগান সূত্রে জানা গেছে, চুনারুঘাটসহ হবিগঞ্জ জেলার প্রায় ২৪টি বাগানের একই পরিস্থিতি। খরায় পাতা মোড়ানো রোগ ও রেড স্পাইডারের সংক্রমণ বেড়ে চলেছে। সবুজ চা পাতা লাল বর্ণ ধারণ করেছে।
চা শ্রমিক নেতা উজ্জ্বল কুমার দাস জানান, খরায় বেশি পাতা তোলা যাচ্ছে না। শ্রমিকরা ১০ থেকে ১২ কেজি করে পাতা তুলছেন। অথচ অন্য বছর এ সময় ৩০ থেকে ৪০ কেজি পাতা তুলেছেন তারা। আগের মতো কারখানাও ঠিকমতো চলছে না। কোনোমতে একবেলা চলে। প্রতিক‚ল আবহাওয়ায় চা উৎপাদনে দুর্দিন চলছে। সামান্য যে বৃষ্টি হয়েছে, তা চা গাছের জন্য যথেষ্ট নয়। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে চলতি মৌসুমে চা উৎপাদন ভয়াবহভাবে ব্যাহত হবে।
দীর্ঘ খরায় উল্লেখযোগ্য হারে চা উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নালুয়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক ইফতেখার এনাম। তিনি বলেন, গত বছর এ সময় ২৮ হাজার কেজির মতো পাতা সংগ্রহ করা হয়েছে। এ বছর মাত্র আট হাজার কেজি পাতা তুলতে পেরেছেন। এ ছাড়াও নানা রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে। তীব্র খরায় রেড স্পাইডারের সংক্রমণ দ্রæত ছড়াচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। দেউন্দি চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক ফরিদ উদ্দিন জানান, মৌসুমের শুরুতেই চা উৎপাদনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। বৃষ্টির অভাবে চা উৎপাদনে প্রতিক‚ল অবস্থা বিরাজ করছে।
গরমে শ্রমিকদের দুপুরে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া প্রচÐ খরায় চা উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে, যা শ্রমিকদের কাজের পরিধি সংকুচিত করেছে। গাছের কুঁড়ি শক্ত হয়ে যাওয়ায় পাতা তোলা যাচ্ছে না। এবার চা উৎপাদনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।
অতি গরমে চা বাগানের অবস্থা নাজুক বলে জানালেন আমু চা বাগানের ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, তীব্র গরমে বাগানে মশা ও অন্যান্য পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়েছে। চা উৎপাদনও কমেছে। অন্যবারের তুলনায় এবার উৎপাদন চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।
বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনাবৃষ্টির সঙ্গে অতি তাপে এমন অবস্থা। চা বাগানের জন্য যেমন ভারী বর্ষণ দরকার, তা এখনও হয়নি। সেচের পানি বেশি দিতে হচ্ছে বাগানগুলোতে। এতে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আছেন তারা। অনাবৃষ্টির জন্য এক একর জমি থেকে সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই হাজার কেজি কাঁচা চা পাতা পাওয়া যাচ্ছে। সেচ খরচ, সার, কীটনাশক মিলিয়ে প্রতি একর জমিতে খরচ পড়ছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা।
লালচান্দ চা বাগানের ম্যানেজার মোফাজ্জেল হোসেন জানান, চা বাগানের ভেতরে এমনিতেই তাপ বেশি। অতিরিক্ত গরমে শ্রমিকরা নিয়মিত কাজ করতে পারছেন না। তারা সকালে কাজে এসে দুপুরে চলে যাচ্ছেন। বর্তমানে চা বাগানের যতœ নেওয়া যাচ্ছে না সঠিকভাবে। তাপে ঝলসে যাচ্ছে গাছের কচি পাতা। বিশাল সবুজের সমারোহ এখন কালচে লাল। কুঁকড়ে বিবর্ণ হয়ে পড়েছে কুঁড়ি। চলতি মৌসুমের ফেব্রæয়ারিতে প্রথম ধাপের উৎপাদন ঠিক থাকলেও মার্চে এসে দ্বিতীয় ধাপের উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়েছে। চাহিদা অনুযায়ী চা পাতা না পেয়ে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বিপাকে পড়েছে মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষ। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহিদুল ইসলাম জানান, বৃষ্টি না হওয়ায় বেশির ভাগ চা বাগানে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে গেছে। খরায় চায়ের কিশলয় (কচি পাতা) বাড়ছে না। পাতা কুঁকড়ে লালচে হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মালিক ও শ্রমিকরা চরম বিপাকে পড়েছেন। বৈরী আবহাওয়ার কারণে চা বাগান ও মাঠে ময়দানে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছেন চরম বিপাকে। বাইরে বেরোলেই কাঠফাটা রোদ।
চা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রচÐ গরমে কাজ করতে গিয়ে নানা ঝুঁকি নিতে হচ্ছে তাদের। এই কঠিন সময় কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। অতিরিক্ত গরমে তারা অসুস্থ হলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ, স্যালাইন, ঠান্ডা পানিও পাচ্ছেন না।
উপজেলার বিভিন্ন চা বাগানে গিয়ে দেখা যায়, প্রচÐ গরমে শতাধিক শ্রমিক পাতা তুলছেন। গরমের মধ্যেই উঁচু টিলার ওপর কাজ করছেন তারা। এতে প্রচÐ রোদ সরাসরি এসে পড়ছে মাথার ওপর। এমন পরিস্থিতিতে কাজ চলছে দু-তিন শিফটে ভাগ করে। রপিন্দ্র ভৌমিক জানান, প্রচÐ গরমে কাজ করে অনেক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দেউন্দি চা বাগানের অপর্ণা মুÐা জানান, এই সময়ে সারা দিনে যেখানে ৩০ থেকে ৪০ কেজি পাতা তোলার কথা, সেখানে পাতা উঠছে ৮ থেকে ১০ কেজি। ফলে দৈনিক বাধ্যতামূলকভাবে যে পরিমাণ পাতা তুলতে হয়, সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না।
রঘুনন্দনের চা শ্রমিক আশিষ সাঁওতাল জানান, প্রচÐ রোদে সারাদিন কাজ করেও মেলাতে পারছেন না হাজিরা। মালিকপক্ষও সহযোগিতা করছে না।
স্থানীয় সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে চা শ্রমিকদের প্রতি সবার সহনীয় আচরণ প্রদর্শন করতে হবে। শ্রমিকরা যদি অতিরিক্ত কাজ করেন, তাদের অবশ্যই অতিরিক্ত মজুরি দিতে হবে। ইউএনও আয়েশা আক্তার জানান, শ্রমিকদের বিষয়টি খোঁজ নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সমাধান করা হবে।