আগামী নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেই ভোটের মাঠ গোছাচ্ছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরই সর্বাত্মক ‘নির্বাচন যুদ্ধে’ ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতিও গুছিয়ে এনেছে দলটি। সেই সঙ্গে বিএনপি ও তার মিত্রদের আন্দোলনের নামে সহিংসতা-নৈরাজ্য মোকাবিলার কর্মসূচি আরও জোরদারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
সরকারবিরোধীদের অবরোধ কর্মসূচি ঘিরে সর্বস্তরের নেতাকর্মীর চলমান সতর্ক পাহারা আরও সক্রিয় করে তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া হবে। কয়েকজন নেতা অবশ্য বলেছেন, সারাদেশে এরই মধ্যে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিএনপি ও তার মিত্রদের আন্দোলন তেমন দানা বাঁধতেও পারছে না। আরেক দিকে নাশকতা-সন্ত্রাসের মামলা-মোকদ্দমায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীর সিংহভাগ গ্রেপ্তার অথবা আত্মগোপনে রয়েছেন।
ফলে রাজপথ ও নির্বাচনের মাঠে অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ। এই অবস্থা ধরে রেখে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত সময় পার করতে কোনো সমস্যা হবে না। তারপরও আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে গুরুতর নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে নির্বাচনী প্রস্তুতির পাশাপাশি নেতাকর্মীকে চলমান প্রতিরোধ কর্মসূচি আরও জোরদার করার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। এদিকে, রাজপথে আন্দোলন মোকাবিলার পাশাপাশি নির্বাচনকেন্দ্রিক নানামুখী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। আন্দোলনরত বিএনপি ও তার মিত্রদের নির্বাচনে আসা না আসার বিষয়টিকে মাথায় রেখে এই পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। বিএনপি না এলেও যাতে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে সেজন্য ছোট-বড় অন্য রাজনৈতিক জোট ও দলগুলোকে নির্বাচনে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিএনপিবিহীন নির্বাচন হলে ভোটার উপস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব যাতে না পড়ে সে লক্ষ্যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কমপক্ষে ৬০ ভাগ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ভোটের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি নির্বাচনী প্রচারে জনগণকে সচেতন করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে বিএনপি নির্বাচনে আসুক বা না আসুক, গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের মতো এবারও আওয়ামী লীগ তার ১৪ দলীয় জোটকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবেই নির্বাচন করবে।
গত বৃহস্পতিবার দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন ও সন্ত্রাস-নৈরাজ্য প্রতিহত করে দলের নির্বাচনী প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। দলের নেতাদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না- এটা ঠিক নয়। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করাসহ ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো মনোনয়নবাণিজ্য করতে তারা এবারও নির্বাচনে আসবে। তাই বিএনপি নির্বাচনে আসবে এমনটা ধরে নিয়েই নির্বাচনী প্রস্তুতি জোরদার করতে হবে।
দলের কয়েকজন নীতিনির্ধারক নেতা বলছেন, বিএনপি ও তার মিত্রদের আগামী নির্বাচনে আসার প্রশ্নে সংশয় থাকলেও উদ্বিগ্ন নন তারা। কেননা আরও অনেক দল নির্বাচনে আসবে। জনগণও নির্বাচনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ফলে সরকারের প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যেমন নিশ্চিত করা হবে, তেমনি অনেক দল ও জনগণের অংশগ্রহণে ওই নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ হিসেবে দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতাও পাবে।
শুক্রবার দলীয় ফোরামের এক সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের তপশিল দ্রæতই হয়ে যাবে। এখন আওয়ামী লীগের সামনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হাতে আছে। একটি নির্বাচনের প্রস্তুতি। আরেকটি বিএনপির নেতৃত্বে আন্দোলনের নামে চোরাগোপ্তা হামলা প্রতিহত করা ও নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রাখা।
তপশিল ঘোষণার অপেক্ষা : নির্বাচন কমিশন থেকে ১৩ অথবা ১৪ নভেম্বর আগামী জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার কথা জানানো হয়েছে। এর পরপরই আওয়ামী লীগের চ‚ড়ান্ত পর্যায়ের ‘ভোটযুদ্ধ’ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন নীতিনির্ধারক নেতারা। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে চেয়ারম্যান এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে সদস্য সচিব করে গঠিত দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির তত্ত¡াবধানে নির্বাচনী কর্মকাÐ চলবে। এ জন্য আরও ১৪টি উপকমিটি পূর্ণাঙ্গ করার প্রস্তুতি চলছে, যারা নির্বাচন পরিচালনা কমিটিকে সার্বিক সহযোগিতা দেবেন।
তপশিল ঘোষণার পর শেখ হাসিনা সিলেট থেকে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচার শুরু করবেন। এর পর তিনি আরও কয়েকটি জেলায় নির্বাচনী জনসভা অথবা ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে দলের পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেবেন।
নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালনায় দলের তিনটি কার্যালয়কে পুরোপুরি প্রস্তুত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং তেজগাঁওয়ের ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের মাধ্যমে সার্বিক নির্বাচনী কার্যক্রম চলবে। তপশিল ঘোষণার পরপরই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হবে। মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমা নিতে সেখানে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য দুটি করে এবং বাকি ছয়টি বিভাগের জন্য একটি করে মোট ১০টি বুথ স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি এবারই প্রথম অনলাইনে ফরম সংগ্রহ ও জমা দেওয়ার প্রক্রিয়াও চালু করবে আওয়ামী লীগ।
এ ছাড়া ধানমন্ডির কার্যালয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের নেতৃত্বে দলের ওয়েব টিম ছাড়াও আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার ব্যাপক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সারাদেশের দলীয় কার্যালয়ে ‘স্মার্ট কর্নার’ স্থাপন ও ছয় লাখ প্রশিক্ষিত প্রচারকর্মী তৈরির কাজও করছে তারা। তেজগাঁওয়ের ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বসে নির্বাচন পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদসহ অন্যরা।
সেই সঙ্গে এগিয়ে চলছে দলের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের কাজও। নির্বাচনে জয়ী হলে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলাকে মূল অঙ্গীকার হিসেবে রেখে এই ইশতেহারের খসড়া প্রণয়নের কাজ করছে দলের সভাপতিমÐলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটি। এরই মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মতামত নেওয়ার পাশাপাশি কয়েকটি বৈঠক করে ইশতেহার প্রণয়নের কাজ গুছিয়ে এনেছেন তারা। খসড়া প্রণয়ন শেষে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের অনুমোদনের পর ভোটের কয়েকদিন আগে এই ইশতেহার ঘোষণার কথা রয়েছে।
কঠোরভাবে আন্দোলন মোকাবিলা : দলের কয়েকজন নেতা বলেছেন, আন্দোলনের নামে বিএনপি ও তার মিত্রদের সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে। কিছুতেই ছাড় দেওয়া হবে না। আগামী দিনে বিএনপি যত কঠোর কর্মসূচি দেবে, আওয়ামী লীগও সেই কর্মসূচি মোকাবিলায় আরও কঠোর হবে। গত বৃহস্পতিবার দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক থেকেও এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এসেছে।
রাজধানীতেও প্রতিরোধ কর্মসূচি জোরদার : রাজধানী ঢাকায়ও বিএনপির আন্দোলন প্রতিহত করার কর্মসূচি ক্রমেই জোরদার করার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ঢাকার রাজপথ নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে সারাদেশের নির্বাচনের মাঠেও এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে বিএনপির আন্দোলন জোরালো করা সম্ভব হবে না। এ কারণে রাজধানীর রাজপথ নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঢাকার দুই প্রান্ত মহানগর দক্ষিণ ও উত্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আন্দোলন-সংগ্রামে অভিজ্ঞ আওয়ামী লীগের দুই সভাপতিমÐলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম এবং অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানককে।
এ বিষয়ে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম বলেন, আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা আরও জোরদার করেছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগেরও ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে কোনো মূল্যে বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই দেশকে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথে এগিয়ে নেওয়া হবে।
অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, বিএনপি ও তার সহযোগীরা নির্বাচন বানচালে দেশে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য চালাতে চায়। এ থেকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীও সজাগ ও সতর্ক রয়েছেন। বিএনপি সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করলে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে।