কাজির বাজার ডেস্ক
দেশের প্রায় সব কারাগারেই বন্দির সংখ্যা ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি। কাশিমপুরে একমাত্র মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের মোট ধারণক্ষমতা ২০০ হলেও আটক আছেন প্রায় ৬৫০ বন্দি। এতে একদিকে যেমন থাকা-খাওয়ার কষ্ট, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পেতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত তাদের। অতিরিক্ত বন্দির চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষকে। খাবারসহ অন্যান্য খাতে গুনতে হচ্ছে বাড়তি ব্যয়ও। রাজনৈতিক মামলায় আটক ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই মূলত কারাগারে বন্দির সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে বিচারের অপেক্ষায় আটক রয়েছেন প্রায় ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ বন্দি। সে প্রেক্ষাপটে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৮ নম্বরে।
বিভিন্ন দেশের কারাগারের ধারণক্ষমতা ও বন্দিদের নিয়ে কাজ করে থাকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড প্রিজন ব্রিফ (ডবিøউপিবি)। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যের বরাত দিয়ে বাংলাদেশের কারাগারের ধারণক্ষমতা নিয়েও একটি জরিপ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫৫টি জেলা কারাগার এবং ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগারে ৪২ হাজার ৬২৬ বন্দির ধারণক্ষমতা রয়েছে। এর বিপরীতে বন্দির সংখ্যা ৭৭ হাজার ২০৩ জন, যেখানে নারী হার ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। সব মিলিয়ে ধারণক্ষমতার ১৯০ দশমিক ৪ শতাংশ বন্দি রয়েছেন দেশের কারাগারগুলোয়। গত বছরের ২৫ নভেম্বরের তথ্য তুলে ধরে সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশে ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশই আটক রয়েছেন বিচারের অপেক্ষায় বা জিজ্ঞাসাবাদ পর্যায়ে।
মিথ্যা ও গায়েবি মামলার কারণে দেশের কারাগারগুলোয় বিচারের অপেক্ষাধীন বন্দির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, ‘ইদানীংকালে গ্রেফতার ও মামলা দেয়া রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে গেছে। মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় হাজার হাজার মানুষকে জেলে রাখা হচ্ছে। অথচ সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ২০ শতাংশেরও কম। বাকি ৮০ ভাগই বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে আটক। দীর্ঘ সময় কারাবাসের পর ওই বন্দি যখন নির্দোষ প্রমাণিত হন, তখন আর তার সামাজিক অবস্থান থাকে না। অথচ পুলিশ ও সরকারের দায়িত্বশীল ভ‚মিকার মাধ্যমেই এ সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব।’
ডবিøউপিবির হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে দেশের কারাগারগুলোয় বিচারের অপেক্ষায় থাকা বন্দির সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ৩৬৮ জন, যা মোট কারাবন্দির ৭৪ দশমিক ৬ শতাংশ। সে হিসাবে দেশের প্রতি লাখ মানুষের ৩৪ জনই তখন বিচারের অপেক্ষায় কারাবন্দি ছিলেন। ২০০৩ সালে কারাগারগুলোয় বিচারের অপেক্ষাধীন বন্দি ছিল ৪৫ হাজার ১৭৩ জন, মোট বন্দির ৬৭ দশমিক ১ শতাংশ। বিচারের অপেক্ষাধীন বন্দির সংখ্যা ২০০৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ হাজার ৩৫৪ জনে, যা ওই বছরের মোট বন্দির ৬৭ দশমিক ১ শতাংশ। ওই বছর প্রতি লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে বিচারের অপেক্ষাধীন বন্দি ছিলেন ৩৩ জন। ২০১০ সালে কারাগারগুলোয় মোট বন্দির ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ বা ৫০ হাজার ৫৭৬ জন বিচারের অপেক্ষাধীন ছিলেন। বিচারের অপেক্ষাধীন বন্দির সংখ্যা ২০১৫ সালে আরো বেড়ে ৫২ হাজার ৮৭৬ জনে দাঁড়ায়, যা মোট বন্দির ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ওই বছরগুলোয় প্রতি লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে ৩৩ জন কারাবন্দি ছিলেন সাজা ছাড়াই। আর ২০২২ সালে বিচারের অপেক্ষায় থাকা বন্দি ছিলেন ৬১ হাজার ৩৬৭ জন, যা মোট কারাবন্দির ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ওই বছর দেশের জনসংখ্যার প্রতি লাখের বিপরীতে বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে আটক ছিলেন ৩৫ বন্দি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কারাগারগুলোয় অনেক বন্দি রয়েছেন, যাদের আইনি সেবা পাওয়ার সামর্থ্য নেই। দিনের পর দিন তাদের কারাগারেই কাটাতে হয়। এসব বন্দিকে খুঁজে বের করে প্রয়োজনী আইনি সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া কোনো বন্দি বিনা কারণে কারাগারে রয়েছেন কিনা, কারা কর্তৃপক্ষকে তা নিয়মিত যাচাই করে দেখতে হবে। তবে সবকিছুর আগে তাদের জন্য বিচার প্রক্রিয়াকে সহজ করা জরুরি। জুডিশিয়াল ব্যবস্থায় বিচারের অপেক্ষায় থাকা বন্দিদের বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার মধ্য দিয়ে কারাগারগুলো থেকে এ ধরনের বন্দি কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও মনে করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসান এ শাফি বলেন, ‘বিচারের অপেক্ষাধীন হয়েও যখন একজন বন্দি কারাগারে থাকেন, তখন তাকে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের সঙ্গে মিশতে হয়। এতে করে সেই বন্দির ওপর এক ধরনের শারীরিক ও মানসিক প্রভাব পড়তে শুরু করে। অপরাধীদের সঙ্গে থাকতে থাকতে একটা সময় তার মধ্যেও অপরাধপ্রবণতা তৈরি হয়। কেননা আমাদের দেশের কারাগারগুলো এখনো সংশোধনাগার হিসেবে তৈরি হতে পারেনি।’
শতভাগ বিচারের অপেক্ষায় থাকা বন্দি নিয়ে ডবিøউপিবির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে মধ্য ইউরোপের ক্ষুদ্র দেশ লিচেনস্টাইন। দ্বিতীয় অবস্থানে সান মারিনো। ইউরোপেরই ছোট্ট এ দেশটির কারাগারে থাকা বন্দিদের ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশই বিচারের অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন। ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ বিচারের অপেক্ষায় থাকা বন্দি নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র। এর পরই রয়েছে হাইতি, মোট বন্দির বিচারের অপেক্ষায় ৮১ দশমিক ৯ শতাংশ বন্দি দেশটির কারাগারে আটক। লেবাননের কারাগারে বিচারের অপেক্ষায় থাকা বন্দির হার ৮১ দশমিক ২ শতাংশ। তালিকার ষষ্ঠ অবস্থানে গ্যাবন। মধ্য আফ্রিকার দেশটির কারাগারে থাকা বন্দিদের ৮০ দশমিক ২ শতাংশই বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন। ডবিøউপিবির তালিকায় ৭ নম্বরে অর্থাৎ বাংলাদেশের আগের অবস্থানটি প্রতিবেশী ভারতের। ৭৭ দশমিক ১ শতাংশ বন্দি দেশটির কারাগারগুলোয় বিচারের অপেক্ষায় আটক রয়েছেন।
দ্রæত বিচার প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে দেশের বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা কমিয়ে আনার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। কারা কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, বিচারের অপেক্ষাধীন বন্দি কমিয়ে আনতে আইনি সেবা দেয়া ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বেশকিছু উদ্যোগ রয়েছে। এ বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএসএম আনিসুল হক বলেন, ‘দেশের কারাগারে বর্তমানে বন্দি রয়েছেন ৭৭ হাজারের মতো। এর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি ১৯ হাজার ৫০০। বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন ৫৭ হাজার ৭০০ বন্দি। এসব বন্দির বিষয়ে প্রতিটি জেলায় সরকারি পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। বন্দিদের মধ্যে যাদের আইনি সহায়তার প্রয়োজন, তাদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সেবা দেয়া হয়। এজন্য প্রত্যেক জেলের সুপারকে নির্দেশনাও দেয়া রয়েছে। তারা নিয়মিত বিষয়টি জেলা কমিটিকে রিপোর্ট করেন। তার ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হয়। এছাড়া কিছু বেসরকারি সংস্থাও বন্দিদের আইনি পরামর্শের জন্য কাজ করে থাকে।’
এদিকে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ বন্দির খাবারের সংকুলান করতে গিয়ে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের তথ্য উঠে এসেছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের প্রতিবেদনে। তাদের হিসাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রয়োজনের তুলনায় কারাগারে খাদ্যদ্রব্য বাবদ ৬ কোটি ১১ লাখ ২৩ হাজার ৯ টাকা বেশি ব্যয় করা হয়েছে। নিরীক্ষাকালে বিল ভাউচার, বিল রেজিস্টার, কারাবন্দির সংখ্যা, তাদের দৈনিক মিল হার পর্যালোচনা করে এ তথ্য তুলে এনেছে সরকারি এ নিরীক্ষা সংস্থাটি।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএসএম আনিসুল হক অবশ্য মনে করেন নিরীক্ষা সংস্থাটির প্রতিবেদনের সঙ্গে কারাগারের প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বন্দিদের খাবারের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণের কোনো অর্থ বেঁধে দেয়া হয় না। কেবল তাদের খাবারের বরাদ্দ ও পরিমাণ বেঁধে দেয়া হয়। সে অনুযায়ীই বন্দিদের খাবার সরবরাহ করা হয়। আর জেলকোড অনুযায়ী একজন বন্দির জন্য ৩৬ বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ থাকে। কিন্তু আমাদের বন্দিরা এ জায়গা পেয়ে থাকে শুধু রাতে ঘুমানোর জন্য। সেলের বাইরে দেশের কারাগারগুলোয় যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। বন্দিরা তাদের বরাদ্দের চেয়েও বেশি জায়গা ব্যবহারের সুযোগ পান।’