কাজির বাজার ডেস্ক
জাতীয় নির্বাচন মানেই প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনে সয়লাব শহর থেকে গ্রাম। বিভিন্ন দিবসে শুভেচ্ছা জানানো, ‘জনগণের দোয়া চাই’, ‘এমপি প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাই’, প্রচারে এলাকাবাসী কিংবা ওমুক আসনের জনগণ এরকম পোস্টার ব্যানার দেশের রাজনীতির সংস্কৃতি। বড় নেতা থেকে পাতি নেতা কেউই এসব থেকে দূরে থাকেন না। কিন্তু বিগত নির্বাচনের তুলনায় আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগ মুহ‚র্তে রাজনীতির চলমান এ সংস্কৃতির কমতি দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের তিন মাস বাকি থাকলেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের প্রচার-প্রচারণা খুব একটা চোখে পড়ছে না। গত নির্বাচনেও যতটা প্রচার চালিয়েছেন প্রার্থীরা, মাঠে-ঘাটে দৌড়ঝাঁপ করেছেন, নেতাকর্মীকে নিয়ে সময় দিয়েছেন, জনগণের দোরগোড়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেছেন এবার সেই চিত্রের অর্ধেকও দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সূত্র বলছে, এমপি প্রার্থীরা এবার দলের মনোনয়ন পেতে প্রচারের চেয়ে লবিংয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন। এলাকার নেতাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে না গিয়ে শুধু আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের নেতাদের কাছে যাচ্ছেন এবং মনোনয়ন পাওয়ার জন্য লবিং করছেন।
সূত্রগুলো বলছে, দলের মনোনয়ন পেলেই নির্বাচনে পাস এমন ধারণা থেকে মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা, শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করা, প্রচারণা চালানোর ওপর জোর না দিয়ে লবিংয়ে জোর দিচ্ছেন প্রার্থীরা। অনেক এমপি আছেন যাদের এলাকায় শক্ত অবস্থান নেই তারা মনোনয়ন পেয়েছেন, আবার যারা দীর্ঘদিন রাজনীতি করে
এলাকায় আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করেছেন তারা মনোনয়ন পাচ্ছেন না। তাই প্রচারণা, দলীয় রাজনীতির চেয়ে মনোনয়ন পাবার ক্ষেত্রে লবিংকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন এমপি প্রার্থীরা।
আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, বাংলাদেশে যে কোনো নির্বাচন এলেই এলাকার দেয়াল, বিদ্যুতের পিলার, গাছের ডাল, ফ্লাইওভারের পিলার, বাস, ট্রাক রিকশার গায়ে, দলীয় কার্যালয়ের সামনে পোস্টার, ফেস্টুনে থাকে ভরপুর। একজনের পোস্টারের ওপর আরেকজনের পোস্টার, এক জায়গায় দশজনের ফেস্টুন, কার ওপর কে লাগাবে তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। এক সময় দেওয়ালে দেওয়ালে নানা রং দিয়ে ‘চিকা লেখা’ ছিল রাজনৈতিক ট্র্যাডিশন। তবে এটি এখন আর দেখা যায় না।
নেতারা আরও বলেন, নির্বাচন এলেই বড় নেতা থেকে পাতি নেতা সবাই নিজেকে এমপি প্রার্থী হিসেবে প্রচার করেন। এলাকার অলি-গতিতে পোস্টার ফেস্টুন লাগিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, আলোচনায় আসার চেষ্টা করেন। যা নিয়ে সেই আসনের অনেক এমপি প্রার্থীও বিব্রত বোধ করেন। কিন্তু এবার প্রচারণা খুবই কম।
অনেকেই নামকাওয়াস্তে প্রচার করছেন। বেশি যোগাযোগ করছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে মনোনয়নের বিষয়ে বারবার বলার কারণে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে লবিং করছেন যেন- সেই প্রার্থীর নামে ভালো রিপোর্ট, জনপ্রিয় প্রার্থী হিসেবে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
এবার মনোনয়ন প্রত্যাশীদের প্রচারণা কম হওয়ার বিষয়ে প্রার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিচ্ছেন। গত নির্বাচনে দলের মনোনয়ন দেখে তারা হতাশ হয়েছেন। প্রার্থীরা বলেন, মাঠে-ঘাটে দৌড়ঝাঁপ করে, দলীয় কর্মীদের সংঘঠিত করে, জনগণের দোরগোড়ায় গিয়ে অবস্থান শক্ত করে কোনো লাভ হয়নি। যেসব এমপি দুর্নীতি করেছেন, দলে কোন্দল সৃষ্টি করেছেন, নেতাকর্মীদের নির্যাতন করেছেন, এলাকায় মাঝেমধ্যে যাতায়াত করেন, জনপ্রিয়তা নেই, বিতর্কিত সেসব এমপিও আবার মনোনয়ন পেয়েছেন। প্রার্থীরা আরও বলেন, যাদের এলাকায় কোনো অবস্থানই নেই, তারা হুট করে মনোনয়ন পেয়েছেন কিন্তু চলিস্নশ বছর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন, মাঠে শক্ত অবস্থান রয়েছে এমন ব্যক্তি মনোনয়ন পাননি।
এদিকে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে বারবার বলা হয়েছে, সেসব প্রার্থীকে জনপ্রিয়তা বেশি তারা মনোনয়ন পাবেন। বিতর্কিতরা মনোনয়ন পাবেন না, যারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন, দলে বিভাজন করেছেন দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে, জনবিচ্ছিন্ন এমন এমপিরা এবার মনোনয়ন পাবে না।
একজন প্রার্থী বলেন, গত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে যতটা বুঝেছি এলাকাতে জনপ্রিয়তা বা প্রচারণা দিয়ে মনোনয়ন পাওয়া যাবে না। এলাকায় টাকা খরচ করেও কোনো লাভ নেই। জায়গামতো টাকা খরচ করতে পারলে লাভ আছে, না হয় এলাকার জনপ্রিয়তা বা অবস্থান দিয়ে মনোনয়ন পাওয়া যাবে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন এমপি প্রার্থী বলেন, মনোনয়ন পেতে হলে খুব বড় জায়গা থেকে তদবির থাকতে হবে, না হয় বড় কোনো নেতা জোর দিয়ে পক্ষালবম্বন করতে হবে।
এদিকে, এবার সরকারি আমলাদের মাধ্যমে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করছেন কিছু প্রার্থী। দূতাবাস থেকেও এমপি প্রার্থীদের জন্য তদবির করা হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রের দূতাবাসে এমপি প্রার্থীরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। তবে এ নিয়েও রয়েছে মতের ভিন্নতা। একজন প্রার্থী বলেন, গত নির্বাচনে বাংলাদেশের একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দূতাবাসে এমপি প্রার্থীরা যোগাযোগ করতে বেশ দৌড়ঝাঁপ করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের এমপি প্রার্থী ঘোষণার পর তারা হতাশ হয়েছেন। তাই নির্দিষ্ট সেই দূতাবাসে এবার দৌড়ঝাঁপ কম প্রার্থীদের। এ ছাড়া অনেকেই গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষা করছেন। যদি গ্রিন সিগন্যাল পান তবে মাঠে নামবেন, নির্বাচনী প্রচারণা চালাবেন। গ্রিন সিগন্যাল না পেলে মাঠে নামবেন না। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান যায়যায়দিনকে বলেন, কোন প্রার্থী কিভাবে প্রচারণা চালাবেন এটা তার নিজস্ব বিষয়। তবে আমরা দল থেকে সরকারের উন্নয়নগুলো প্রচার করার জন্য এমপি প্রার্থীসহ সব নেতাকর্মীকে বলে থাকি।
আওয়ামী লীগের হাই-কমান্ডের নেতারা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি আসবে না, তা নিয়ে এমপি প্রার্থী মনোনয়নে নানা সমীকরণ কাজ করবে। নির্বাচন কঠিন হবে না সহজ হবে তার ওপর নির্ভর করবে প্রার্থী মনোনয়ন।