কাজির বাজার ডেস্ক
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ পরিবর্তন করে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’-এর চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ পরিবর্তনের ফলে অনেকগুলো ধারায় সাজা কমছে। এছাড়া বেশকিছু অজামিনযোগ্য ধারা জামিনযোগ্য হচ্ছে। তবে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলাগুলো সেই আইনেই চলবে বলে খসড়া আইনে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে আইন পরিবর্তনের সুফল পাবেন না হাজার-হাজার মামলার আসামি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া এসব মামলা ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। তাই শাস্তি ‘সামঞ্জস্য’ করার বিষয়ে ‘সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন’ বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
গত ৭ আগস্ট সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে নীতিগতভাবে অনুমোদন পায়। পরে সেটি ভেটিংয়ের জন্য লেজিসলেটিভ ডিভিশনের আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। গত ২৮ আগস্ট এ আইনের খসড়ার চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।
সাড়ে চার বছরে ৭ হাজার ১টি মামলা : গত সাড়ে চার বছরে ‘বিতর্কিত’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে এ আইনে সাত হাজার একটি মামলা দায়ের হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে মামলা হয়েছে প্রায় সাড়ে চারটি। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে এ তথ্য জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
আগের দায়ের হওয়া মামলা চলবে পুরোনো আইনে : সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চলমান মামলার সাজা কীভাবে হবে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নতুন আইনের খসড়া অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত হলেও অনিষ্পন্ন মামলাগুলো পুরোনো আইনেই চলবে।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, আগের মামলাগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুসারেই চলবেÑ সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে এ কথাটা উল্লেখ রয়েছে। তবে, ওই সব মামলার সাজা কীভাবে কম দেওয়া যায়, সেই চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। ‘এ ব্যাপারে আমরা অনেক চিন্তাভাবনা করেছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আমরা যদি ২১ ধারা ধরি, এ ধারায় ১০ বছর সাজা। নতুন আইনে অর্থাৎ সাইবার নিরাপত্তা আইনে বলা হচ্ছে পাঁচ বছর। তাহলে এ আইন পাস হওয়ার আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বলবৎ থাকার সময় যে অপরাধ হয়েছে, তাহলে সংবিধান মতে ওই ১০ বছর সাজা কিন্তু বিজ্ঞ আদালত দিতে পারেন। সেখানে যাতে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, আমরা এমন একটি ব্যবস্থা করতে চাচ্ছি।’
দরকার সরকারের সদিচ্ছা : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পরিবর্তন করে এখন সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে। তার মানে কী? নতুন আইনে সরকার অপরাধের যে সংজ্ঞা দিচ্ছে এবং যে শাস্তি নির্ধারণ করেছে, এর অর্থ তারা সেখান থেকে সরে আসছে। তা যদি হয়ে থাকে…, আগের আইনে দায়ের করা মামলাগুলো তো ক্রিমিনাল কেস। এগুলো শেষ পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সেগুলোকে অ্যাটাচ না করলেই পারে, অর্থাৎ হালকাভাবে দেখলেই চলে। রাষ্ট্র চাইলে অতীতের মামলাগুলো নিয়ে আর সামনের দিকে অগ্রসর না-ও হতে পারে।
‘অপরাধী যে শাস্তির সম্মুখীন হবেন সেগুলো তো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে। কারণ, ওই মামলাগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা। কিন্তু নতুন আইনে সেই একই ধারার শাস্তি কমে যাচ্ছে। কেন কমল? কারণ, সরকার আইন করছে তা-ই এবং অনেকগুলো ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। আগে কিন্তু সেটি ছিল না। এটা যদি হয়ে থাকে…, এর মানে হচ্ছে এ আইনের ব্যাপারে সরকার পলিসি পরিবর্তন করে ফেলেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া যে মামলাগুলো চলছে, এগুলোর ব্যাপারে সরকার অগ্রসর না হলেও পারে। নতুন আইনে যে মামলা দায়ের হবে, সেগুলো নতুন আইনে চলবে। পুরোনো মামলা নিয়ে এত মাতামাতি করার কিছু নেই। রাষ্ট্রপক্ষ যদি প্রেস না করে তাহলে সব আদালত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত আসামিদের জামিন দিয়ে দেবেন।’
নিজের অভিমত ব্যক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের এ আইনজীবী আরও বলেন, ‘আমি মনে করি অতীতের আইনের (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) মামলাগুলো অত্যন্ত বিতর্কিত। সেগুলো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পরিচালনা করা উচিত নয়। দ্বিতীয় কথা হলো- রাষ্ট্রের আইনজীবী ও পিপি থাকেন। আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সারা বাংলাদেশে যারা পিপি হিসেবে আছেন, মামলাগুলো যারা দেখেন, তাদের আইন মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া উচিত যে, অতীতের আইনে করা মামলাগুলো যেন তারা বর্তমান আইনের আলোকেই দেখেন। অর্থাৎ জামিনযোগ্য এবং কম সাজাÑ এভাবেই যেন তারা দেখেন। কারণ, সরকার তো তার পলিসি পরিবর্তন করছে। সরকারের পলিসি আগে এক রকম ছিল, এখন পরিবর্তন করে ফেলেছে। আগের পলিসির কারণে অনেক লোক বেশি সাজাপ্রাপ্ত হবেন! সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে, তারা তাদের আইনজীবীদের বলে দিলেই পারে।’
সরকার চাইলে আইনের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারে : সুপ্রিম কোর্টের অপর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আইন যেভাবে হবে সেভাবেই সবকিছু চলবে। যখন অপরাধ ঘটে তখন যে আইন থাকে সে আইনের শাস্তিই তাকে ভোগ করতে হয়। এখন নতুন আইন করে সাজা কমানো হচ্ছে। তবে, দুই বছর আগে যে মামলা দায়ের হয়েছে, আগের আইন অনুযায়ীই তাকে সাজা ভোগ করতে হবে। এটা হলো নীতি। তবে, আইনের মধ্যে পরিবর্তন আনতে চাইলে আনতে পারে। পরিবর্তন আনার পর সেটি নিয়ে আদালত কী করবেন, তা ভবিষ্যতের ব্যাপার। আদালত যদি মেইনটেইন না করেন, সেটি তখন হতে পারে…। তবে, সরকার চাইলে সেটি আনতে পারে। আর যদি পরিবর্তন না আনে, সেক্ষেত্রেও বলা যাবে না তারা সঠিক কাজ করেননি। কারণ, ওটা তো আইনের একটি বেসিক প্রিন্সিপালস।