কাজির বাজার ডেস্ক
জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের মৎস্য খাতে। বিরূপ প্রভাবের কারণে কমেছে মাছের উৎপাদন। উৎপাদন কমায় মাছের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে ভোক্তারা পড়েছেন চরম বিপাকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ মাছ উৎপাদন হয় প্রাকৃতিক উৎস যেমন- জলাশয়, খাল-বিল, নদী-নালা থেকে। বাকি ৬০ শতাংশ মাছ উৎপাদন হয় চাষ থেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উভয় প্রকার উৎপাদনই ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে চাহিদার তুলনায় বাজারে মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। বেড়েছে দামও। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহফুজুল হক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক উৎস এবং চাষের মাধ্যমে মাছ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
‘আমাদের দেশে সাধারণত ডিম থেকে মাছের প্রজনন শুরু হয় ফেব্রæয়ারি থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাছ উৎপাদন হয় জুন থেকে আগস্টে। কিন্তু এ বছর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মে, জুন ও জুলাই মাস তীব্র খরার মধ্য দিয়ে পার হয়েছে। বৃষ্টি না হওয়ায় প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে মাছ কম উৎপাদন হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, চাষের মাধ্যমে মাছের উৎপাদনও কম হয়েছে। কারণ, এবার পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায়নি।’
জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে মাছের পোনা ও ডিমের উৎপাদন কমেছেÑ বলে স্বীকার করেছেন মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ মাহবুবুল হক। তিনি বলেন, গত ১৫ বছর ধরে পাঁচ শতাংশ হারে মাছের উৎপাদন বেড়েছে। পাশাপাশি মানুষের মাছ খাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। সর্বশেষ খানা জরিপে অনুযায়ী, দিনে মানুষ ৬৮ গ্রাম মাছ খাচ্ছেন।
‘আমাদের লক্ষ্য, মানুষ প্রতিদিন দিনে ৮১ গ্রাম করে মাছ খাবে। ২০৪১ সালে এ লক্ষ্যে আমরা পৌঁছে যাব। গত বছর মাছের উৎপাদন তিন শতাংশ বেড়েছে। এ অর্থবছরে (২০২১৩-২৪) হয়ত খুব বেশি প্রবৃদ্ধি হবে না। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে ফেব্রæয়ারি মাসের পর থেকে তাপমাত্রা বেশ গরম ছিল। ফলে, মাছের পোনা ও ডিম উৎপাদন কম হয়েছে।’ বাজারে মাছের দাম বেড়েছে কি নাÑ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় মাছের দাম বেশি। গত বছর যে পাঙাশ মাছ কিনেছি ১৫০ টাকা কেজি, এখন তার দাম আরও বেশি। দাম বাড়লেও চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি আছে বলে মনে করি।’ মহাপরিচালক মাহবুবুল হক বলেন, ‘জলবায়ুর পরিবর্তন শুধু আমাদের কারণে হচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের কারণে হচ্ছে। এ অবস্থায়ও আগামী দিনগুলোতে যাতে কম জায়গায় বেশি মাছ উৎপাদন করা যায়, সেই পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।’এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে মাছ কমে যাচ্ছেÑ এটা একদম সত্যি কথা। ছোট সময় দেখতাম বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ মাস আসার পরপরই বৃষ্টি শুরু হতো। বানের ডাক শোনার পর মাছগুলো পানি থেকে উজানে (পানি থেকে উপরে) উঠত।
‘বর্ষাকালে বৃষ্টি না হওয়ায় বোয়াল-চিতলসহ কোনো মাছই উপযুক্ত সময়ে প্রজনন করতে পারছে না। মাছগুলো উন্মুক্ত জলাশয়ে ডিম দিয়ে বাচ্চা ফুটায়। এখন সেটি হচ্ছে না। এছাড়া খাল-বিল, নদী-নালা ও জলাশয় কমে যাওয়ায় মাছও কমেছে। জলাশয় ভরাট করে এখন যাতে কোনো বাড়ি কিংবা কলকারখানা তৈরি না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে সরকারকে। পুকুর, খাল-বিল ও নদী-নালা রক্ষায় কাজ করতে হবে।
এ বিষয়ে মৎস্য বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাইয়ূম বলেন, ‘মাছের প্রজননের সময় এ বছর বৃষ্টি কম হয়েছে। এ কারণে মাছ উৎপাদনও কমেছে। জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে তো আমাদের হাত নেই। কীভাবে কম সময়ে বেশি মাছ উৎপাদন করা যায় সেই গবেষণা চলছে। দেশের সব মানুষকে মাছ খাওয়ানোর চেষ্টা চলছে। এজন্য যা যা প্রয়োজন তা-ই করা হচ্ছে। মৎস্য অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের মাছের চাহিদা ছিল ৪২ লাখ ৩৮ হাজার টন। উৎপাদন হয়েছে ৪৭ লাখ ৫৯ হাজার টন। তবে, এবার আগের বছরের চেয়ে উৎপাদন কম হওয়ার শঙ্কা করছে মৎস্য অধিদপ্তর।
কম হওয়ার কারণ হিসেবে মহাপরিচালক খ মাহবুবুল হক বলেন, একদিকে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব, অপরদিকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে মাছের খাবারসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। এ কারণে চাষিদের বেশি দামে মাছ বিক্রি করতে হচ্ছে। ভোক্তাপর্যায়েও বেশি দাম দিয়ে মাছ খেতে হচ্ছে।’
মাছের বর্তমান বাজার : সরকারি বাজার মনিটরিং প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ- টিসিবির তথ্য মতে, বুধবার (৩০ আগস্ট) রাজধানীতে রুই মাছ বিক্রি হয়েছে ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি। যা এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের একই দিন বিক্রি হয়েছিল ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি। তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের একই সময়ে একই মাছ বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কেজিতে। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে ২০০ টাকার রুই মাছ ৪৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে ২৫০ টাকা বেড়েছে। আর এক বছরের ব্যবধানে কেজিতে রুই মাছের দাম বেড়েছে ২০০ টাকা। টাকার অঙ্কে দ্বিগুণ বেড়েছে দাম। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে দেশি মাছের।
রুই মাছের মতোই গরিবের খাবার বলে খ্যাত পাঙাশ ও তেলাপিয়া মাছেরও দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। দাম বৃদ্ধির দৌড়ে পিছিয়ে নেই চিংড়ি, ট্যাংরা, মলা, কই, শিং ও পাবদা। সমানভাবে দাম বেড়েছে চিতল, কাতল, মৃগেলসহ কার্ব জাতীয় মাছের।
কোন মাছের দাম কত : রুই ও কাতলা আকারভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকায়। ২০২২ সালের প্রথম দিকে ২৪০ থেকে ৩২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে এটি। পাঙাশ প্রকার ভেদে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে ২০২২ সালে। এখন বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৬০ টাকা কেজিতে। তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৭০ টাকা কেজিতে। যা ২০২২ সালে ছিল ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি। অর্থাৎ কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ১০০ টাকার বেশি।
৩৫০ টাকা কেজির শিং মাছ এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। ২৫০ টাকার কই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজিতে। ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজির চিংড়ি মাছ বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হওয়া ট্যাংরা মাছ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা কেজিতে। ৩০০ টাকা কেজির মলা মাছ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়।
দেশি কই মাছ আকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে। শিং মাছ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০ হাজার টাকায়। ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা কেজি। দেশীয় ছোট চিংড়ি মাছের কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। কাইকা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, বাইন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
জেলেরা পাচ্ছেন না মাছ, বদলাচ্ছেন পেশা : জেলে নির্মল চন্দ্র বর্মণ বলেন, জন্মের পর থেকে মাছ ধরি। কিন্তু গত তিন-চার বছর ধরে নদীতে মাছ ধরে পোষাইতে পারছি না। তাই খেয়াঘাট ইজারা নিয়েছি। এখান থেকে যে আয় আসে তা দিয়ে জীবন চালাই।
তার মতো ৪০ বছর ধরে নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন গফরগাঁও উপজেলার ভরপুর গ্রামের জগদিশ চন্দ্র বর্মণ। তিনি বলেন, বর্ষাকালে দিনে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার মাছ ধরা পড়ত জালে। এখন দিনে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার মাছ পাই না। গত তিন থেকে চার বছর আগেও নদীতে বাইন, চিংড়ি, বোয়াল, পুঁটিসহ বড় বড় মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন কাঁচকি ছাড়া আর কোনো মাছ জালে আসে না।
নির্মল ও জগদিশের মতো ভরপুর গ্রামের ৫০টি পরিবার নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরতেন। মাছ ধরে যা আয় হতো তা দিয়ে জীবন নির্বাহ করতেন। কিন্তু গত দুই থেকে তিন বছর ধরে নদীতে মাছ পান না। ফলে আশপাশের বিল (চুরুনতলা, মাজ বিল, উন্দার বিল ও কুড়ি) লিজ নিয়ে মাছ পালন করছেন। সেই মাছ বিক্রি করে জীবন চালাচ্ছেন তারা।
‘নদীতে জাল ফেললে মাছ আসে না। বিলেও মাছ পাওয়া যায় না। তাই ঋণ করে বিল লিজ নিয়ে মাছ চাষ করছি। পাশাপাশি ব্রিজ লিজ নিয়ে টোল আদায় করে জীবন চালাচ্ছি’Ñ বলেন জগদিশ চন্দ্র বর্মণ। গফরগাঁওয়ের ভরপুর গ্রামের মতো কাপাসিয়ার টোক ও পাকুন্দিয়া এলাকার মির্জাপুরের শত শত জেলে নদীতে মাছ ধরা বাদ দিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। বর্ষার মৌসুমে যখন অন্য কাজ থাকে না, তখন নৌকায় করে মাছ ধরতে নদীতে যান তারা।
রাজধানীর রামপুরা কাঁচাবাজারের ক্রেতা মইনুল আহসান বলেন, দাম বাড়ায় বড় মাছ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি ছয় মাস হলো। এখন ছোট মাছ খাচ্ছি তাও মাসের মধ্যে ৮ থেকে ১০ দিন। বাকি দিনগুলোর সবজি ও ডিম খাচ্ছি।
বাজারের মাছ ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মাছের দাম বাড়তি। এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় মাছ কম উৎপাদন হয়েছে। এ কারণে সরবরাহ কম। সরবরাহ কম থাকায় দাম একটু বেশি।
মাছচাষি-ব্যবসায়ীরাও একই কথা বলছেন। তাদের মতে, মাছের প্রজনন হয় বর্ষা মৌসুমে। সাধারণত ফেব্রæয়ারি মাস থেকে মাছের প্রজনন মৌসুম শুরু হয়। তবে মে, জুন ও জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি পোনা উৎপাদন ও বিক্রি হয়। কিন্তু প্রচÐ খরার কারণে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত পুকুর কিংবা মাছের ঘেরে চাষের উপযোগী পানি ছিল না। ফলে চাহিদা অনুযায়ী মাছের উৎপাদন হয়নি। আগস্টের প্রথম থেকে বৃষ্টি শুরু হলেও চাহিদা অনুযায়ী ডিম ও পোনা সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারি ১০২টি হ্যাচারিতে বিভিন্ন মাছের পোনা উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৭৯৯ কেজি। বেসরকারি ৮৭৪টি হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন হয় ছয় লাখ ১১ হাজার ৭৮৭ কেজি। এর মধ্যে ময়মনসিংহ জেলায় এক লাখ ৭৯ হাজার ৪১৬ কেজি পোনা উৎপাদন হয়। যশোরে হয় ৭০ হাজার ৭৪০ কেজি পোনা।
জানতে চাইলে ময়মনসিংহের রিলায়েন্স অ্যাকুয়া ফার্মসের স্বত্বাধিকারী ঋতিশ কুমার পÐিত বলেন, অনাবৃষ্টি ও তীব্র গরমের কারণে তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছের প্রজনন কমেছে। তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছের মতো অন্যান্য মাছেরও প্রজনন কমেছে। ফলে চাহিদা অনুসারে আমরা মাছ দিতে পারছি না।
একই এলাকার অপর ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম বলেন, একদিকে মাছের খাবারের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে অনাবৃষ্টি ও গরমের কারণে নতুন করে মাছ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ফলে আমার ছয়টি ঘেরের মধ্যে এখন চারটি বন্ধ করে দিয়েছি।