কাজির বাজার ডেস্ক
পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের পাশে চান আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থীরা। মান-অভিমান ভুলে ভোটের রাজনীতিতে তারা যাতে সরকার সমর্থক মেয়রপ্রার্থীদের পাশে থাকেন, এজন্য চলছে নানান দেনদরবার। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আলাপ-আলোচনাও চলছে উভয় পক্ষের মধ্যে। ইতোমধ্যে নির্বাচনি বৈতরণি পার হতে খুলনা ও বরিশাল সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে শরিক দলের মাঠ পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয়েছে। জানা যায়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী-২ আসনের সংসদ-সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করেন রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় মেয়রপ্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
এই বৈঠকে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন নৌকার জয়ে একসঙ্গে কাজ করার আহŸান জানালে ফজলে হোসেন বাদশা তাতে সায় দেন। এ সময় নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব কাটিয়ে আগামী দিনে রাজনীতির মাঠে একে অপরের পাশে থাকার প্রতিশ্রæতি দেন দুই নেতা।
সূত্র জানায়, এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এবং ফজলে হোসেন বাদশার মধ্যকার দূরত্ব দীর্ঘদিনের। গত বছর অক্টোবরে রাজশাহীতে ওয়ার্কার্স পার্টির ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্র মৈত্রীর রাজশাহী জেলা ও মহানগর সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে ফজলে হোসেন বাদশা প্রকাশ্যে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের তীব্র সমালোচনা করেন। এতে দুজনের মতবিরোধ ও দূরত্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। সিটি নির্বাচন সামনে রেখে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন সেই দূরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেন।
২ মে তিনি তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে ফজলে হোসেন বাদশাসহ ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বৈঠকে মেয়র পদে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের পক্ষে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন জোটের নেতারা।
বিপরীতে কাউন্সিলর পদে ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা আওয়ামী লীগের সমর্থন চান। বিশেষ করে রাজশাহী সিটির ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্কার্স পার্টির বর্তমান কাউন্সিলর মতিউর রহমানসহ আরও অন্ততপক্ষে ৫টি ওয়ার্ডে নিজেদের কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন চান জোটের শরিকরা। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। দ্রæত একটি সিদ্ধান্তে আসবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও রাজশাহী-২ আসনের সংসদ-সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বৃহস্পতিবার বলেন, আমরা ১৪ দলীয় জোটে আছি। এই জোট একটি আদর্শিক জোট। বিএনপি-জামায়াতসহ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির বিপরীতে রাজনীতি এবং নির্বাচনের মাঠে আমরা একসঙ্গে ছিলাম, আছি, থাকব।
তিনি বলেন, এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে আমরা ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই, মতভেদও নেই। আমরা সিটি নির্বাচন সামনে রেখে ১৪ দল জোটগতভাবে বৈঠক করেছি। আলাপ-আলোচনাও করেছি। আমরা নৌকার পক্ষে এই নির্বাচনে একসঙ্গে কাজ করব।
সিটি নির্বাচন সামনে রেখে ১৫ মে বরিশালে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত ১৪ দলীয় জোটের বরিশাল জেলা ও মহানগর নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও আওয়ামী লীগ বরিশাল মহানগর সহসভাপতি কেবিএস আহমেদ কবির।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ বরিশাল জেলার সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হাই মাহাবুব, বরিশাল জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন, ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য নজরুল হক নিলু, জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ-সদস্য অ্যাডভোকেট টিপু সুলতান, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ বিভাগীয় সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সুলতান প্রমুখ এ সময় বক্তব্য দেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দল দীর্ঘদিন একসঙ্গে রাজনীতির মাঠে সক্রিয়। আমরা মনে করি, এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবেই আগামী দিনে আমাদের ঐক্য যে কোনো মূল্যে অটুট রেখে পথ চলতে হবে।
আন্দোলন ও নির্বাচন উভয় ক্ষেত্রেই আমরা একে অপরের পরিপূরক হিসাবে কাজ করে যেতে চাই। তিনি আরও বলেন, বরিশালে যেহেতু ১৪ দলীয় জোটের কোনো শরিক দল মেয়রপ্রার্থী দেয়নি, তাই তাদের সঙ্গে বসেছি। তারা আমাকে সমর্থন দিয়েছে। পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। এই নির্বাচনে জয়ী হতে আমরা একসঙ্গে কাজ করব।
সম্প্রতি খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে ১৪ দলীয় জোটের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন সেখানকার সরকারদলীয় মেয়রপ্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক। জোটের অন্যতম প্রধান দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগরের সভাপতি খালিদ হোসেনকে প্রধান করে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয় ওই বৈঠকে। পাঁচ সিটির মধ্যে খুলনায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংকট অনেকটাই কম।
এ কারণে বেশ নির্ভার সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। তবুও নির্বাচন বলে কথা, কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে নারাজ তিনি। তাই আগেভাগেই জোটের শরিকদের নিয়ে বৈঠক সেরেছেন আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের প্রবীণ এই রাজনীতিক। নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করে সেই কমিটিতে শরিক দলের স্থানীয় নেতাদের জায়গা দিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন, ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেটে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ চলবে।
সব সিটি নির্বাচনে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন। ওইদিন নির্বাচন কমিশন সভা থেকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। সিটি নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ হবে এবং প্রতিটি কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে। ভোটগ্রহণের হালনাগাদ তথ্য কর্মকর্তারা ট্যাবের মাধ্যমে কমিশনকে জানাবে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণার পর ১৫ এপ্রিল পাঁচ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নির্বাচনের জন্য দলীয় প্রার্থী চ‚ড়ান্ত করে আওয়ামী লীগ। খুলনা সিটি করপোরেশনের জন্য তালুকদার আবদুল খালেক, সিলেট সিটি করপোরেশনের জন্য মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের জন্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, বরিশাল সিটি করপোরেশনের জন্য আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের জন্য অ্যাডভোকেট মো. আজমত উল্লা খানকে মেয়রপ্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
এর মধ্যে বরিশাল ও গাজীপুরে প্রার্থী বদল করে ক্ষমতাসীনরা, আর সিলেটে দেওয়া হয় নতুন মুখ। দুই সিটিতে প্রার্থী বদল এবং এক সিটিতে নতুন মুখ-অভ্যন্তরীণ সংকটে ফেলে দিয়েছে ক্ষমতাসীনদের। তিন সিটিতেই দলীয় বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে আওয়ামী লীগের।
এ কারণে নির্বাচনি যুদ্ধে এবারই প্রথম ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর স্থানীয় নেতাদের কাছে টানতে বেশ উদ্গ্রীব হয়ে আছে। নির্বাচনি বৈতরণি পার হতে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থীরা শরিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসছেন।
বিএনপিবিহীন এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গাজীপুরে সাবেক সচিব এমএম নিয়াজউদ্দিন, রাজশাহীতে মো. সাইফুল ইসলাম স্বপন, খুলনায় মো. শফিকুল ইসলাম মধু, বরিশালে প্রকৌশলী মো. ইকবাল হোসেন তাপস এবং সিলেটে মো. নজরুল ইসলাম বাবু জাতীয় পার্টির প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে ভোটের মাঠে লড়বেন।
অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বরিশালে, দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান গাজীপুরে, হাফেজ মাওলানা আবদুল আউয়াল খুলনায়, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হাফেজ মাওলানা মাহমুদুল হাসান সিলেটে এবং রাজশাহী মহানগর সহসভাপতি হাফেজ মাওলানা মুরশিদ আলম ফারুকী রাজশাহীতে হাতপাখা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।