কবরের আজাব : কুরআন-সুন্নার আলোকে

735
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
কুরআন ও হাদীস দ্বারা সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ার কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ইজমা হচ্ছে- কবর আযাব এবং মুনকার নকীর কর্তৃক কবরে তিনটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার প্রক্রিয়া হক। এর প্রতি ঈমান আনা জরুরী। ইমান আবু হানীফা থেকে শুরু করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সকল ইমামগণের এটাই সর্বসম্মত আক্বীদা।
কবর আযাবের প্রতি ঈমান আনতে সর্বপ্রথম অস্বীকার করে যে বাতিল ফিরকা, তারা হচ্ছে খারেজী সম্প্রদায়। পরবর্তী পর্যায়ে আরেকটি বাতিল ফিরকহা মু’তাযিলা সম্প্রদায় এ বিষয়ে বিভিন্ন মনগড়া যুক্তির অবতারণা করে কুরআন-হাদীসের বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করার দুঃসাহসন দেখায়। মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল যুক্তি। তথাকথিত যুক্তিতে না টিকলে কুরআন হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করা বা অর্থ বিকৃত করতে তাদের আপত্তি ছিলনা। অপরপক্ষে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আক্বীদা হচ্ছে যেখানে কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে, তা কোন যুক্তির মোকাবেলায় প্রত্যাখ্যান করার প্রশ্নই আসেনা। যুক্তি বড় না কুরআন সুন্নাহ বড়। যুক্তিই যদি চ‚ড়ান্ত ফায়সালাকারী হতো, তাহলে আল্লাহ তা’য়ালা যুগে যুগে নবী-রাসূল বা ওয়াহী প্রেরণ করার কি প্রয়োজন ছিল? বিভিন্ন বাতিল ও গোমরাহ ফিরকা যুগে যুগে এসব বিতর্ক ও ফিৎনা সৃষ্টি করে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হলেও মাঝে মধ্যেই তাদের প্রেতাত্মাকে কিছু উর্বর মস্তিষ্কের উপর ভর করতে দেখা যায়। মুসলিম উম্মাহর মূল স্রোতধারা বিগত দেড় হাজার বৎসর ধরে এ বিষয়ে কোন শোবাসন্দেহের শিকার হয়নি বরং সকল আক্বীদার কিতাবে এটিকে ইসলামী আক্বীদার অন্যতম বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সে ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে। তাহলে এমন একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয়ে নতুন করে কলম ধরার দরকার কি? আসা স্বাভাবিক।
সম্প্রতি এক ভাই এসে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন জনৈক লেখকের ‘ক্ববর আযাব’ শিরোনামে এক লেখার প্রতি। যা ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিকীতে প্রকাশিত হয়েছে। সাপ্তাহিকীটির ইসলামী পরিচিতি থাকলে সম্ভবত সম্পাদক খেয়াল না করার কারণেই এমনটি ঘটে গেছে। পত্রিকাটি ব্যাপকভাবে ইসলামী মহলে পঠিত বিধায় আশংকা রয়েছে হয়তো বা কেউ অযথা এ বিষয়ে সংশয়ের শিকার হয়ে যেতে পারেন। এ অনুভ‚তি থেকেই কলম দরার এ প্রয়াস। অবশ্য এ বিষয়ে সংশয়ের শিকার হয়ে যেতে পারেন। এ অনুভ‚তি থেকেই কলম ধরার এ প্রয়াস। অবশ্য এ বিষয়ে আমি নতুন কোন গবেষণা শুরু করছিনা। ইমাম আবু হানীফা থেকে শুরু করে সম্মানিত ইমামগণ এ বিষয়ে যথেষ্ট লেখালেখি করে গেছেন। যে সমস্ত মৌলিক গ্রন্থ বক্ষ্যমান এ নিবন্ধের মূল রসদ যুগিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- আল ফিকহুল আকবার, মূল ইমাম আবু হানীফা (মৃত্যু ১৫০ হিঃ), ব্যাখ্যা আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (মৃত্যু ১০১৪ হিঃ), আল আক্বীদাহ আল তাহাওয়ীয়াহ, মূল ইমাম তাহাওয়ী, (মৃত্যু ৩২১ হিঃ) ব্যাখ্যা- ইমাম আবুল ইয্য্ আল হানাফী (মৃত্যু ৭৯২ হি.) আল ইবানাহ আন উছুল আদ্দীয়ানাহ, রচনা- ইমাম আবুল হাসান আল আশয়ারী (মৃত্যু ৩২৪ হিঃ) এবং মিনহাজুল মুসলিম, রচনা- শায়খ আবু বকর জাবের আল জাযায়েরী।
প্রথমেই দেখা যাক পবিত্র কুরআনে এ বিষয়ে কি আছে। আল্লাহ তা’য়ালা ফিরআউনের ব্যাপারে বলেছেন, ‘‘ফিরাউন ও তার অনুচরদেরকে শোচনীয় আযাব গ্রাস করে ফেলল। সকাল সন্ধ্যায় তাদেরকে আগুনের সামনে পেশ করা হয়। আর যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন আদেশ করা হবে, ফেরআউন ও তার দলবলকে কঠিনতর আযাবে দাখিল কর।’’-(সূরা আল মু’মিনঃ ৪৫-৪৬)
উপরোল্লিখিত আয়াতগুলোতে কঠিনভাবে আযাব বলতে হাশরের ময়দানে চ‚ড়ান্ত ফায়সালার পর জাহান্নামে নিক্ষেপ বুঝানো হয়েছে। আর সকাল সন্ধ্যায় আগুনের সামনে পেশ করার ব্যাপারটা বরযখের (কবরের) জিন্দেগীতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মুফাসসেরীনে কেরাম বলেছেন, কবরের আযাব যে সত্য উপরোক্ত আয়াত তার প্রমাণ (দেুখনঃ তাফসীরে কুরতুবী, ইবন কাছীর, সূরা ঃ আল মু’মিন ঃ ৪৫-৪৬)।
আল্লাহ তা’আলা আরও এরশাদ করেছেন, “তাদেরকে ছেড়ে দিন সেদিন পর্যন্ত, যেদিন তাদের মাথায় বজ্রাঘাত পতিত হবে। সেদিন তাদের চক্রান্ত তাদের কোন উপকারে আসবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না। গুনাহগারদের জন্য এ ছাড়াও শাস্তি রয়েছে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানেনা।”-(সূরা আৎতুর : ৪৫-৪৭)
উপরোল্লিখিত আয়াতগুলোতে ‘‘এছাড়াও শাস্তি রয়েছে” বলে কবরের আযাবের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। (দেখুন-আক্বীদা তাহাবিয়া, পৃ: ১৩৩, শরহু আল ফিকহুল আকবার, পৃ: ১৭১)। আরকবরে সওয়াল জওয়াবের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “আল্লাহ তা’আলা ঈমানদারদেরকে মজবুত বাক্য দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাতের মজবুত রাখেন এবং যালিমদেরকে পথভ্রষ্ট করেন। আর আল্লাহ যা চান তা করেন।” -(সূরা ইবরাহীম: ২৭)। বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে এসেছে এ আয়াতে আখেরাত বলতে বরযখ অর্থাঃ কবরের জগৎ বুঝানো হয়েছে (দেখুন- মাআ’রেফুল কুরআন, পৃ: ৭১৭, শারহুল ফিকহুল আকবর, পৃ: ১৭০)। আল্লাহ তা’আলা মুনাফিকদের শাস্তির ব্যাপারে আরও এরশাদ করেছেন, “আমি তাদেরকে দু’বার আযাব প্রদান করবো। তারপর তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে বৃহত্তম আযাবের দিকে।” -(সূরা তাওবা: ১০১)। এখানে বৃহত্তম আযাব বলতে হিসাব-নিকাশের পর জাহান্নামের আযাব, আর প্রথম দু’বারের আযাব বলতে মু’মিনদের হাতে নিহত হওয়া এবং বরযখ অর্থাৎ কবরের আযাবের কথা বুজানো হয়েছে। (দেখুন- আল ইবানাহ, পৃ: ৮৮)
কুরআনের পর আমরা দেখি এবার হাদীসে এ বিষয়ে কি এসেছে। কবরের আযাবের বিষয়ে এত সংখ্যক হাদীস এসেছে যে, শব্দের ঈষৎ তারতম্যের কারণে শব্দের দিক থেকে মুতাওয়াতির না হলেও মুল বক্তব্যের দিক থেকে তা মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌছে গেছে। ফলে এ বিষয়ে ঈমান আনা ওয়াজিব (দেখুন-আক্বীদা তাহাওয়ীয়া, পৃ: ১৩৬ ও শারহ্ আল ফিকহুল আকবার, পৃ: ১৭১)। তন্মধ্য থেকে নিম্নে কতিপয় হাদীস উল্লেখ করা হচ্ছে-
বারা বিন আযেব (রা:) কর্তৃক বর্ণিত একটি বিশাল হাদীসে এসেছে, নবী করীম (সা:) এরশাদ করেছেন, বাকী আল গারকাদ অর্থাৎ জান্নাতুল বাকীতে আমরা একটি জানাযায় এসেছিলাম। নবী করীম (সা:) আমাদের কাছে এসে বসলেন। আমরা তাঁকে ঘিরে বসলাম। সবাই এত চুপ যে মনে হয় মাথার উপর পাখী বসে আছে। কবর খোঁড়ার কাজ চলছে। তিনি তিনবার করে বলে উঠলেন, আমি আল্লাহর কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় চাই”—-(আহমাদ/ আবু দাউদ/ ইবনে মাযাহ/ হাকেম/ ইবনে হাব্বান/ আবু আওয়ানা)
ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা:) দুটো কবরের পাশ দিয়ে যাবার সময় বলছিলেন, তাদর কবর আযাব চলছে। তবে তেমন কোন বিরাট কারণে তাদের এ আযাব হচ্ছেনা। একজন প্রশ্রাব করার পর ভাল করে পবিত্র হতেন না। আর দ্বিতীয়জন চোগলখুরী করে বেড়াতেন। তারপর একটা তাজা ডাল নিয়ে দু’ভাগ করে দু’কবরে গ্রোথিত করে বললেন, আশা করছি এ দুটো ডাল না শুকানো পর্যন্ত তাদের আযাব কিছু লঘু করা হবে। -(বুখারী, মুসলিম)
আনাস বিন মালেক (রা:(বর্ণনা কনের, নবী করীম (সা:) এরশাদ করেছেন, যদি তোমরা দাফন-কাফন ছেড়ে না দিতে, তাহলে আল্লাহর কাছে চাইতাম, তিনি যেন তোমাদেরকে সরাসরি কবর আযাব শুনার ব্যবস্থা করে দেন। যা আমাকে শুনানো হয়েছে। -(মুসলিম, নাসাঈ, আহমদ)
নবী করীম (সা:) এরশাদ করেছেন, বান্দাকে যখন কবরে রেখে তার সাথীরা বিদায় নিয়ে চলে যায়, সে তাদের পায়ের জুতা/স্যান্ডেলের আওয়াজও শুনতে পায়। ঐ সময়েই দু’জন ফিরিশতা এসে তাকে বসিয়ে দেন। জিজ্ঞেস করেন, “এ লোকটি অর্থাৎ মোহাম্মদ (সা:) সম্পর্কে তোমার ধারণা কি? মু’মিন ব্যক্তি তখন বলে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তখন তাকে বলা হয়, তাকিয়ে দেখ, ঐ যে জাহান্নামে তোমার আসনটা, সেটার পরিবর্তে আল্লাহ তোমাকে জান্নাতের আসন বরাদ্ধ করে দিয়েছেন। উভয় আসনই সে দেখতে পাবে। মুনাফিক বা কাফিরকে যখন প্রশ্ন করা হবে, তুমি কি বলতে পারো এ লোকটা সম্পর্কে? সে বলবে, আমি তো কিছু জানিনা। লোকেরা যা বলতো, আমিও তাই বলতাম। তখন তাকে বলা হবে, তুমি তো জানতে চাওনি, অনুসরণও করনি। আর ঐ মুহ‚র্তেই বিশাল এক লৌহ হাতুড়ি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হবে। আঘাতের ফলে সে বিকট স্বরে আর্তচিৎকার করে উঠবে, যা তার আশেপাশে জিন, ইনসান এ দু’সৃষ্টি চাড়া আর সবাই শুনতে পাবে। -(বুখারী)
অন্যান্য হাদীসে এসেছে, প্রথম প্রশ্ন হবে, তোমার রব কে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হবে, তোমার দ্বীন কি? তৃতীয় প্রশ্ন থাকবে রাসূলুল্লাহ (সা:) সম্পর্কে। এ ব্যাপারে এত প্রচুর সংখ্যক সহীহ হাদীস রয়েছে, সবগুলোর উল্লেখ এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। প্রচুর সংখ্যক সহীহ হাদীস এসেছে নবী করীম (সা:) নামাযের ভেতরে সালাম ফেরানোর পূর্বে আল্লাহর কাছে যে কয়টা বিষয় থেকে সব সময় পানাহ চাইতেন এবং উম্মতকে পানাহ চাইতে তাকিদ করে গেছেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কবরের আযাব। উদাহরণ হিসেবে নিম্নোক্ত হাদীসটি উল্লেখ করা হচ্ছে-
রাসূলুল্লাহ (সা:) দোয়া করেছেন, “হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই, কবর আযাব থেকে, জীবন-মৃত্যুকালীন সকল ফিৎনা থেকে, আর মসীহ দাজ্জালের ফিৎনা থেকে”- (বুখারী)।
যেখানে সহীহ হাদীসে সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা:) কবর আযাব থেকে পানাহ চেয়েছেন, সেখানে এ বিষয়ে শোবা সন্দেহ প্রকাশ করা হাদীস অস্বীকার করার পাঁয়তারা নয়কি? এমন দুঃসাহসই করা হয়েছে শুরুতে উল্লেখিত লেখকের নিবন্ধে। নিবন্ধকার আযাব সংক্রান্ত হাদীস সমুহের সনদের বিশ্বস্ততা স্বীকার করার পরও বলতে পিছপা হননি “তা যতই সহীহ ও নির্ভরশীল হোক কুরআনের মোকাবেলায় তা সব বর্জনীয়।”
উপরোক্ত বক্তব্যের আলোকে আমরা বলতে চাই, প্রথমত কবর আযাব সংক্রান্ত হাদীস সমূহ কুরআনের বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ কুরআনের কোন আয়াতে বলা হয়েছে, “কবর আযাব বলতে কিছু নেই” যার ফলে বলা যাবে যে, হাদীসগুলো কুরআনের আয়াতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বরং তার উল্টো আমরা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি। কুরআনের একাধিক আয়াত কবর আযাবের প্রতি সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করেছে। এমন কি এমন যদি হতো যে, কুরআনে কবর আযাব সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। শুধু হাদীসেই বলা হয়েছে এবং হাদীসের বিশুদ্ধতা প্রমাণিত হয়ে যায়, তাহলে তার প্রতি ঈমান আনা ওয়াজিব হয়ে যায়। কুরআনে নেই এ যুক্তি দিয়ে হাদীস বর্জন করার ভয়াবহ পরিণতি থেকে প্রিয় নবী (সা:) উম্মাতকে সতর্ক করে গেছেন।
সাহাবী মিকদাম বিন মা’দীকাবর (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, অচিরেই এমন লোকের আবির্ভাব ঘটবে যে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে বসে থাকবে (অর্থাৎ কষ্ট করে হাদীসের জ্ঞান অর্জন করবে না), আমার হাদীস সম্পর্কে তাকে বলা হলে সে বলবে, তোমাদের আর আমাদের মধ্যে ফায়সালার জন্য আল্লাহর কিতাবই (কুরআন) যথেষ্ট। তাতে যা হালাল হিসেবে বলা আছে, সেটাকেই আমরা হালাল মনে করব, আর তাতে যা হারাম হিসেবে বলা হয়েছে, শুধু সেটাকেই আমরা হারাম মনে করব। সাবধান, আল্লাহর রাসূল যা হারাম করবেন, সেটা আল্লাহ কর্তৃক হারাম করার মতই। – (আবু দাউদ/ তিরমিযী/ ইবনে মাযাহ/ দারেমী)
শুধু হালাল, হারাম নয়, শরীয়তের যাবতীয় ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম জানার সূত্র যেমন কুরআন, তেমনি রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর হাদীসও। স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন একাধিক আয়াতে। যেমন তিনি এরশাদ করেছেন, “রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর, আর যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক….”। – (হাশর:৭)
আরেকটি হাদীসে নবী করীম (সা:) এরশাদ করেছেন, তোমাদের কাছে দুটো বিষয় রেখে গেলাম, সে দুটোকে আঁকড়ে ধরলে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না, আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাত অর্থাৎ হাদীস। -(হাকেম)
এরপর দেখা যাক, যুক্তিবাদীদের বিশাল (?) যুক্তিগুলো। যদিও কুরআন, হাদীস একটি বা উভয়টিতে থাকলে কোন যুক্তির দ্বারস্থ হওয়ার প্রশ্নই আসেনা, তবুও দেখা যাক যুক্তিগুলোর বক্তব্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য। পূর্বোল্লিখিত লেখকের একটি বড় যুক্তি হচ্ছে- যেহেতু দুনিয়ার আদালতেও বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পূর্বে শাস্তি দেয়ার নিয়ম নেই, তাহলে আল্লাহ পাকের ক্ষেত্রে হাশরের ময়দানে বিচার হওয়র পূর্বে কবরে শাস্তি দেয়া কি করে মেনে নেয়া যায়। এ যুক্তি যদি চ‚ড়ান্ত হক হিসাবে ধরে নেয়া হয়, তাহলে সব যালিম, অপরাধী, দুষ্কৃতকারীদেরকে দুনিয়ায় কোন শাস্তি প্রদান করা থেকে আল্লাহর উপর ইনজাংশন জারী করতে হবে (নাউজুবিল্লাহ)। তাহলে কিসের ভিত্তিতে হাশরের ময়দানে বিচারের পূর্বেই আল্লাহ তা’আলা ফিরআউন ও তার দলবলকে সলীল সমাধির শাস্তি দিলেন। আ’দ সামুদ ও কওমে লূত এবং অন্যান্য বহু জাতিকে গযব নাযিল করে ধ্বংস করলেন। হাশরের ময়দানে বিচারের পূর্বেই বহু জাতি ও অগণিত অপরাধীকে দুনিয়াতে বিভিন্ন রকম আযাব ও গযব দেয়ার কারণে আল্লাহ তা’আলা কি অন্যায় কাজ করেছেন? (এমন যুক্তি থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই)।
আর যদি বিশ্বাস করি, এসব অপরাধীদেরকে দুনিয়াতে শাস্তি দিয়ে আল্লাহ ঠিকই করেছেন, এটাই তাদের আমলের প্রাপ্য, তাহলে মৃত্যুর পূর্বে বা মৃত্যুর সময় আল্লাহ আযাব দেয়া ন্যায়সঙ্গত হলে মৃত্যুর পর কবর বা বরযখের জিন্দেগীতে আযাব দেয়া অন্যায় হবে কেন? আসলে আল্লাহ হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা। বিচারক হিসেবে তাঁর ক্ষমতা, আর দুনিয়ার মানুষের মধ্যে যারা বিচারক তাদের ক্ষমতা এক করে দেখার কারণেই এমন ভ্রান্ত উপসংহারের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ তো আলেমুল গায়েব নয়। একজন অপরাধীর ছোট-বড়, ভিতর-বাহির, গোপন-প্রকাশ্য যাবতীয় দোষ-গুণ সব কিছু তার কাছে জানা নেই। সাক্ষী প্রমাণের মাধ্যম ছাড়া কোন ফায়সালা দেয়ার উপায় ও অধিকার কোনটাই তার নেই। এত সীমাবদ্ধ ক্ষমতার অধিকারী তো নন আল্লাহ। মনের অভ্যন্তরে গোপন খাহেশের কথাও তাঁর কাছে দিবালোকের মত সুষ্পষ্ট। সে অসীম জ্ঞানী আল্লাহর কাছে মানুষের ভাল-মন্দ যাবতীয় কর্ম সুস্পষ্টভাবে সংরক্ষিত হয়ে আছে। সে জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ আল্লাহ তা’আলা যাকে ফায়সালা করেন দুনিয়াতে শাস্তি দেন, কবরে (বরযখে) দেন এবং আখেরাতেও দেবেন। আমলনামা দেয়ার সাথে সাথেই জাহান্নামের শাস্তি বা জান্নাতের পুরস্কারের ফায়সালা বিচার ছাড়াই শুধু আমলের ভিত্তিতেই প্রতিভাত হযে উঠবে। সে জন্যই আমলনামা হাতে দিয়ে আল্লাহ বলবেন, “তোমাদের আমলনামা পাঠ কর, আজকে তুমিই তোমার হিসেব গ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট।’’-(বনী ইসরাঈল:১৫)
ব্যাপারটা তো এমন নয়, শুধু সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করার পরই তার বিচার সম্ভব হবে, তার আগে নয়। ব্যক্তি নিজেই তার আমল দেখে বুঝতে পারবে, তার শাস্তি কি হওয়া উচিৎ। তবুও শেষ পর্যন্ত দুনিয়ার শঠতার মত হাশরের ময়দানেও যখন মিথ্যা কথা বলে সব অস্বীকার করে বসবে, তখন আল্লাহ তার নিজস্ব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে স্বাক্ষী হিসেবে কথা বলাবেন, শুধু এজন্য নয় যে, প্রমাণের অভাবে আল্লাহ বিচার করতে পারছেন না। বরং মিথ্যাবাদীদের শঠতার অস্ত্রটি খান খান করে চুরমার করে দেয়ার মাধ্যমে আসলে তাদের নগদ আযাব ও কষ্ট আরেকটু বাড়িয়ে দেয়া হল মাত্র।
হাশরের মযদানে বিচারের আগে দুনিয়াতে মৃত্যুর আগে এবং মৃত্যুর পর বরযখী জিন্দেগীতে যে কোন অপরাধীকে যে কোন অবস্থায় শাস্তি দেয়ার অধিকার ও ক্ষমতা আল্লাহর অবশ্যই আছে। উপরোল্লিখিত আলোচনায় তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো। কাজেই উপরোক্ত যুক্তিটির অসারতা একেবারেই দিবালোকের মত সুষ্পষ্ট। যুক্তিবাদীদের আরেকটি যুক্তি হল, কবর আযাব সংক্রান্ত দৃশ্যগুলো শুধু কবরে সমাহিত ব্যক্তির সাথেই সামঞ্জস্যশীল। কিন্তু যেসব মানুষের মৃতদেহ সমাহিত করা হয়নি, চিতায় ভস্মিভ‚ত করা হয়েছে অথবা বাঘের পেটে বা হাঙ্গরের উদরে হজম হয়ে গেছে, তাদের তো কবরই নেই, কবর আযাব হবে কোথায়। আর ফিরিশতা এসে প্রশ্নগুলো করবেন কিভাবে, কোথায়?
এসব প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে, কবরের জিন্দেগীকে দুনিয়ার জিন্দেগীর মত মনে করার কারণে। কবর অর্থাৎ বরযখ সে এক অন্য জগত। পার্থিব জগতের সাথে তার কোন মিল নেই। বরযখের জিন্দেগী সবার জীবনেই ঘটবে। যাকে কবর দেয়া হয়েছে তার জীবনে যেমন বরযখের জিন্দেগী হবে, যে বাঘের পেটে হজম হয়ে গেছে তার জন্যও একই বরযখের জিন্দেগী অনুষ্ঠিত হবে। সে জিন্দেগীর প্রকৃত অবস্থা দুনিয়ার বস্তুগত প্রক্রিয়ার মত হবে না। কাজেই দুনিয়ার প্রক্রিয়া ও উপায় উপকরণ হুবহু যেমন আখেরাতের জন্য প্রযোজ্য নয়, তেমনি তা বরযখের জিন্দেগীর জন্যও প্রযোজ্য নয়। এ তিন জগতের প্রত্যেকটির রয়েছে আলাদা সিষ্টেম। এক জগতের সিষ্টেম দিয়ে অন্য জগতকে বিচার করাটাই বড় ভুল। এমনকি যাদেরকে কবর দেয়া হয়েছে, তাদের লাশও তো পাঁচে গলে শেষ হয়ে যাবে। তখন তাদের বরযখের জিন্দেগী যেভাবে হবে, যাদেরকে কবর দেয়া হয়নি, তাদের বরযখের জিন্দেগী সে প্রক্রিয়াতেই হবে।
একজন নেক বান্দাহ আর একজন কাফের, মুনাফেক বা পাপিষ্ঠ ব্যক্তির কবর যদি একদম পাশাপাশি থাকে, তাহলে হাদীসের ভাষানুযায়ী একজনের কবর হবে জান্নাতের টুকরার মত। অনেক প্রশস্ত করে দেয়া হবে, আলোকিত করে দেয়া হবে, বইতে থাকবে জান্নাতের সুবাতাস। আর আরেকজনের কবরকে সংকুচিত করে দেয়া হবে, তা হবে জাহান্নামের গর্ত সদৃশ। সেখানে চলতে থাকবে আযাবের বিভীষিকা। পাশের কবরের এ বিভীষিকা তার প্রতিবেশীর শান্তিতে এতটুকুনও বিঘœতা সৃষ্টি করবে না। দুনিয়ার হিসেবে এটা কি করে সম্ভব! মৃত্যুর পরবর্তী জিন্দেগী, চাই সেটা বরযখ হোক আর আখেরাত- পুরোটাই গায়েব (অদৃশ্য)-এর অন্তভর্‚ক্ত। এসব গায়েবের খবরের ব্যাপারে আল্লাহ পাক বলেছেন, (তারাই প্রকৃত মুত্তাকী) যারা গায়েবের প্রতি বিশ্বাস করে। এমন কোন যুক্তি প্রমাণ ও বিজ্ঞান নেই যা দিয়ে বরযখ ও আখেরাতের সবকিছুকে বুঝে তারপর ঈমান আনা যাবে, না হলে নয়। তাহলে গায়েবের উপর ঈমান আনার দরকার কি? তবে সময়মত সবই বুঝে আসবে যখন প্রকৃত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। যখন গায়েব সমূহ প্রকাশিত হয়ে পড়বে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, তোমার (চক্ষুর) পর্দা সরিয়ে দিয়েছি, আজকে তোমার দৃষ্টি সুতীক্ষè। -(সূরা ক্বাফ:২২) আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে সহীহ হাদীস অস্বীকার করার প্ররোচনা থেকে হেফাযত করুন- আমীন।