ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার তালিকায় বাংলাদেশ সপ্তম

20

কাজিরবাজার ডেস্ক

ইউরোপে অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশী ভ‚মধ্যসাগর দিয়ে অবৈধ পথে পাড়ি জমান, আবার কেউ যান বৈধ পথে। গত দুই বছরে ৫০ হাজার ৭৯০ বাংলাদেশি ইউরোপে ঢুকে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের উপাত্তে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে- ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশ আগে পিছিয়ে থাকলেও এখন সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে।
২০২১ সালে ১৮ হাজার ৮২৫ বাংলাদেশি ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করলেও ২০২২ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ৩১ হাজার ৯৬৫-তে ঠেকেছে। ইতালিতে থাকতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ বাংলাদেশিদের। এ সংখ্যা ১৪ হাজার ৫৯০। এর পরই রয়েছে ফ্রান্স। দেশটিতে বাংলাদেশিদের আবেদন পড়েছে ১০ হাজার ৫৫৫টি। এ দুটি দেশের বাইরে রোমানিয়া, সেøাভেনিয়া, মাল্টা এবং সেøাভাকিয়ায় বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন যথাক্রমে ১৩৬০, ৮২৫, ৭৫ এবং ৫৫ টি।
২০২২ সালে পুরো বিশ্ব থেকে ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া। এর পরই আছে আফগানিস্তান। ২০২২ সালে ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার দিক থেকে শীর্ষ দশে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশ। বাংলাদেশের পাশাপাশি ষষ্ঠ স্থানে পাকিস্তান আর ১০ম স্থানে ভারত।
ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সবচেয়ে কম বাংলাদেশি রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন- ২ হাজার ৯৫১ জন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২৬। ২০১৭ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন ১২ হাজার ৭৩১ জন। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৫১৭। ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৬ এবং ২০১৬ সালে ৬ হাজার ৮১৮ জন বাংলাদেশি আবেদন করেন।
ক‚টনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, নির্বাচনের আগে ইউরোপে বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রবণতা বাড়ে। এর বড় অংশ ইউরোপে ভ‚মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ঢোকে। তাদের অধিকাংশেরই রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলেও দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিচারবহিভর্‚ত হত্যা, গুমের মতো বিষয়কে পুঁজি করে ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয় চেয়ে থাকেন। আর এ আশ্রয় প্রার্থনার চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেতে দীর্ঘ সময় তাদের অপেক্ষা করতে হয়।
এ সময়ের মধ্যে আবেদনকারীরা দেশেও ফিরতে পারেন না। আর ইইউ তাদের অবৈধও বলতে পারে না। এর আগে অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশকে চাপ দিয়েছিল সংস্থাটি। তাদের ফেরত আনা বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিও সই হয়েছিল। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩ হাজারের মতো বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
তবে ইউরোস্ট্যাটের হিসাব অনুযায়ী, এ সংখ্যা লাখের ওপর। ইইউতে অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশিদের ফেরত আনা না হলে ভিসা সীমিত করে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত রয়েছে ইইউর। অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরানোর ব্যাপারে অসহযোগিতার কারণে ইউরোপীয় কাউন্সিলে এ প্রস্তাব করা হয়। এ কারণে ইইউতে থাকা অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরাতে সেখানে থাকা সব বাংলাদেশের দূতাবাসের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়কে গভীরভাবে দেখতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোতে অবৈধ অভিবাসনবিরোধী ধারা চলছে। প্রথমত, দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রয়োজনের চেয়ে কমে যাওয়ায় কর্মসংস্থানের অভাব দেখা দিয়েছে। ফলে তরুণরা নিজেরাই বিশ্বে যে কোনো উপায়ে তাদের কর্মসংস্থান খুঁজে নিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এ কারণেই মূলত বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আসছে না। আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে মানুষের মধ্যে দেশের বাইরে অভিবাসনের প্রবণতা বাড়ছে ইউরোপের বর্তমান যে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব; বাংলাদেশিদের এভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা বাড়তে থাকলে তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন সাবেক এ রাষ্ট্রদূত।
এম হুমায়ুন কবির বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে পুলিশ ও প্রশাসনকে তৎপর হতে হবে, যাতে অবৈধভাবে কেউ বিদেশে পাড়ি না জমায়। আর মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে তরুণ বাংলাদেশিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা এবং বেকারত্ব দূর করার বিষয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
কয়েকটি পথ ধরে লিবিয়া হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেন বাংলাদেশিরা। এর প্রথমটি হলো ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে লিবিয়া। এর পর সেখান থেকে ইউরোপ। দ্বিতীয়টি হলো তুরস্ক হয়ে সরাসরি ইউরোপ। এতে ব্যর্থ হলে আবার লিবিয়া হয়ে যাওয়ার চেষ্টা। আরেকটি হলো দক্ষিণ সুদানের মরুভ‚মি থেকে লিবিয়া হয়ে ইউরোপ। এ পথগুলো দিয়ে গমনেচ্ছুরা ঢাকা পার করার সময় এসব বাংলাদেশিকে একটি চক্রের আওতায় রাখা হয়। এর পর দুবাই, ইস্তাম্বুল কিংবা সুদানে তাদের হস্তান্তর করা হয় দ্বিতীয় চক্রের হাতে।
সেখান থেকে উড়োজাহাজে করে লিবিয়া যাওয়ার পর তৃতীয় চক্রের হাতে যান বাংলাদেশিরা। সেখান থেকে নৌকায় উঠিয়ে দেয়ার পর চতুর্থ চক্র এবং সর্বশেষ ইউরোপ নেমে পঞ্চম চক্রের হাতে পড়েন অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। এ পথগুলো দিয়ে লিবিয়া পৌঁছতে জনপ্রতি ৯ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়। প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী সব স্থানে টাকা পরিশোধ না করলে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মুক্তিপণ ও অপহরণের মুখোমুখি হতে হয়। কখনও মানব পাচারকারী চক্রের হাতে নির্দয়-নিষ্ঠুর পরিণতি বরণ করতে হয়।