রাজনৈতিক সংকট : বিপরীতমুখী অবস্থানে প্রধান দুই দল

18

কাজিরবাজার ডেস্ক
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশে সংলাপের অতীত ইতিহাস সুখকর নয়। শুধু রাজনীতি নয়, কোনো ক্ষেত্রেই সংলাপের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান দেখা যায়নি। সংলাপ হলেই বর্তমান সংকটের সমাধান হয়ে যাবে-তা নিশ্চিত করে বলাও যাবে না। কেননা বিদ্যমান সংকটের স্থায়ী সমাধানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের গণতান্ত্রিক আন্দোলন তখনই সফল হবে, যখন তা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেবে। এ ধরনের আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতৃত্বে জনগণই সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে ওঠে। অতীতে বাংলাদেশে এ রকম আন্দোলনের নজির রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আগের মতো সাধারণ জনগণের সেই আস্থা ও বিশ্বাস আর নেই। ফলে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক কর্মসূচিতেও সাধারণ জনগণের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। তাদের সেই আস্থায় ফেরানো গেলেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন এমনিতেই গণবিক্ষোভে রূপ নেবে। তবে একই সঙ্গে এটাও বলতে হবে, ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে জনগণকেও সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। শুধু ঘরে বসে আন্দোলন সফলের স্বপ্ন দেখলেই হবে না।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘সংলাপের মধ্য দিয়ে কোনো সংকটের সমাধান হয়নি। সুশীল সমাজ এমনকি বিদেশিরা সংলাপ শব্দটি বলতে পছন্দ করে তাই বলে। যারা এসব বলছে তারাই তো সংলাপ করে না। সংলাপ হলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যেত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসার বড় উপায় হচ্ছে জনগণকে রাস্তায় নেমে আসতে হবে। সেটা না হলে সম্ভব হবে না। সংলাপ নিয়ে সুশীল সমাজসহ বিদেশিরা নানা কথা বলছেন, কিন্তু সরকারের এ নিয়ে ততটা মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না। কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নামলে তখন হয়তো রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়ে ভাবতে পারে। কিন্তু জনগণ কেন রাস্তায় নামবে? কী ভরসা আছে? তাদের মধ্যে এখনো সেই তাগিদটা দেখা যাচ্ছে না। জনগণ ভালো করেই জানে, যারা এখন গণতন্ত্র ও অবাধ নির্বাচনের কথা বলছে তারা যখন ক্ষমতায় ছিল তারাও নির্বাচন দেয়নি।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আপাতত সংকট সমাধানে কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।যে কোনো সংকট সমাধানের শান্তিপূর্ণ পথ হচ্ছে সংলাপ। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এই মুহ‚র্তে সে পথে হাঁটছে না। বিকল্প উপায় রাজপথ। কিন্তু রাজপথে কখনো শান্তিপূর্ণ সমাধান হয় না। সংঘাত, সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে একপর্যায়ে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেই সমাধান টেকসই হয় না। তাই সংকট সমাধানে সমঝোতার দিকেই দিতে হবে গুরুত্ব। না হলে রাজপথে ভয়াবহ সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে, যা কারও জন্যই ভালো ফল বয়ে আনবে না।
সোমবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে সংলাপ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘গত নির্বাচনে সংলাপ করেছি, রেজাল্টটা কী, নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ ছাড়া কিছুই করেনি। ১৫ আগস্ট আমার বাবা-মাকে হত্যা, গ্রেনেড হামলা, বোমা হামলা করে আমাকে হত্যার চেষ্টার পরও তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছি শুধু দেশের স্বার্থে। কিন্তু এরপরও তারা একের পর এক অপমান করে গেল। এত অপমানের পর তাদের সঙ্গে কিসের বৈঠক? শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার পরিষ্কার কথা, যারা এইটুকু ভদ্রতা জানে না তাদের সঙ্গে বৈঠকের কী আছে।’
পরদিন গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের জবাব দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমরা তো আগেই বলেছি, তার (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে সংলাপ করব না। তিনি তো কথাই রাখেন না। আমরা সেজন্য ডায়ালগের কথা একবারের জন্য বলিনি।’
নির্বাচন ও সংলাপ নিয়ে দুই দল কোনো ছাড় দিতে চাচ্ছে না। এমনকি রাজপথেও তারা মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। বর্তমান সংবিধানের আলোকেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কখনো ফিরে আসবে না। এমনকি এ নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে কোনো সংলাপও করবে না। অন্যদিকে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন নেতারা। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে কোনো সংলাপেও বসতে রাজি নয় বিএনপি। রাজপথেই সবকিছুর ফয়সালা হবে বলে জানান দিচ্ছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতেও সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুদলের এমন মুখোমুখি অবস্থানে কীভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। কেননা রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা ছাড়া সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়। তারা মনে করেন, সরকার হয়তো অতীতের মতো নির্বাচন করতে পারবে, কিন্তু তা দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না। এবারের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে দেশের ভেতরে এবং বাইরে নতুন করে নানা সংকট তৈরি হতে পারে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, এই মুহ‚র্তে রাজনৈতিক সংকটের গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। বড় দুই দল যদি তাদের অবস্থানে অনড় থাকে তাহলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে। যা আমাদের সামাজিক ও অর্থনীতি অশান্ত হয়ে পড়বে। তাই দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটা সমঝোতার পথে আসতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান সংকট সমাধানে সংলাপের ওপরই গুরুত্ব দিতে হবে। প্রধান দুই দল আপাতত সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলেও ভবিষ্যতে যে তা হবে না, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময় প্রকাশ্যে যা বলে তা তাদের আসল কথা নয়। তাই প্রকাশ্যে সংলাপকে নাকচ করা হলেও এটাই যে তাদের চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত তা কিন্তু এ মুহ‚র্তে নিশ্চিত করে বলা যাবে না। দেশ ও জনগণের স্বার্থের কথা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো একটা সমাধানে পৌঁছবে বলে প্রত্যাশা তাদের।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনীতিতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হয়। কিন্তু দুদলের অনড় অবস্থানে আপাতত মনে হচ্ছে না আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সংকটের সমাধান হবে। তাদের অনড় অবস্থানে জনগণ হতাশ। অতএব সংলাপের পথ যদি রুদ্ধ হয়ে যায় তাহলে তো সমাধানের কোনো পথ দেখছি না। তিনি বলেন, অনেকের মতে, সংলাপ না হলে রাজপথেই এর সমাধান। সাময়িকভাবে বাধ্য হয়ে দাবি মেনে নিলেও রাজপথে কখনো কোনো কিছুর শান্তিপূর্ণ সমাধান হয় না। সেটা বেশিদিন টিকেও থাকে না।
বদিউল আলমের মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আপাতত ইতিবাচক কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবে অনেক সময় তারা মুখে যা বলে সেটাই তাদের আসল কথা নয়। তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে বলে আমরা আশাবাদী। আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান করে জনগণকে রাজপথের সংঘাত থেকে রেহাই দেবে।