জুম্মার নামাজের ইতিহাস ও ফজিলত

17

এমএ কামিল হাদিস :
আজ পবিত্র জুম্মা বার। শব্দটি আরবি। এর আভিধানিক অর্থ একত্রিত করা। এ দিবসকে ইসলাম পূর্বযুগে ‘উরুবা’ বলা হতো। জুম্মা সাপ্তাহিক প্রধান দিবসের নাম, যা শুক্রবার নামে পরিচিত। জুম্মা নামকরণ নিয়ে ইসলামের ইতিহাসে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। এদিন হজরত আদম (আ.)-এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো একত্র করে পরিপূর্ণতা লাভ করার কারণে জুম্মা বলা হয়। কেউ কেউ বলেন, এদিন আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) পরস্পর একত্র হওয়ায় জুম্মা বলা হয়। আবার অনেকে বলেন, শহর ও গ্রাম অঞ্চলের লোকেরা এদিন একত্র হয়ে নামাজ আদায় করায় এদিনকে জুম্মা বলা হয়। আর একজন মুসলমানের এই সংক্ষিপ্ত দুনিয়াবি জীবনে পবিত্র জুম্মার দিনের গুরুত্ব অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। এর অর্থ একত্র হওয়া, সম্মিলিত হওয়া, কাতারবদ্ধ হওয়া। যেহেতু সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন শুক্রবারে প্রাপ্তবয়স্ক মুমিন মুসলমান একটি নির্দিষ্ট সময়ে একই স্থানে একত্র হয়ে জামাতের সঙ্গে সেদিনের জোহরের নামাজের পরিবর্তে এই নামাজ ফরজরূপে আদায় করে, সেজন্য এই নামাজকে ‘জুম্মার নামাজ’ বলা হয়। সময় একই হলেও জোহরের সঙ্গে জুম্মার নামাজের নিয়মগত কিছু পার্থক্য রয়েছে আর জুম্মার দিন হলো সাপ্তাহিক ঈদের দিন।
নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনা গেলেন। পৌঁছার দিনটি ছিল ইয়াওমুল আরুবা (শুক্রবার)। সেদিন তিনি বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় গেলে জোহর নামাজের সময় হয়। সেখানে তিনি জোহর নামাজের পরিবর্তে জুম্মার নামাজ আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুম্মার নামাজ। তবে আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় আরো পরে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনায় যাওয়ার পর এবং জুম্মার নামাজ ফরজ হওয়ার আগে একবার মদিনার আনসার সাহাবিরা আলোচনায় বসেন। তারা বললেন, ইহুদিদের জন্য সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট রয়েছে, যেদিনে তারা সবাই একত্র হয়। নাসারারাও সপ্তাহে এক দিন একত্র হয়। সুতরাং আমাদের জন্য সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন, যেদিনে আমরা সবাই সমবেত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করব, নামাজ আদায় করব। অতঃপর তারা আলোচনায় বললেন, শনিবার ইহুদিদের আর রবিবার নাসারাদের জন্য নির্ধারিত। অবশেষে তারা ইয়াওমুল আরুবা শুক্রবারকে গ্রহণ করলেন এবং তারাই এদিনকে জুমার দিন নামকরণ করলেন (সিরাতুল মুস্তাফা ও দারসে তিরমিজি)।
জুম্মার দিন ও জুম্মার নামাজের গুরুত্ব স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনও কোরআনে তুলে ধরেছেন। জুম্মার নামাজ আদায়ের ব্যাপারে ইরশাদ করেন, হে মুমিনগণ! জুম্মার দিনে যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তোমরা আল্লাহর স্মরণে দ্রæত চলো এবং বেচাকেনা বন্ধ করো। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ। অতঃপর নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ খোঁজ করো ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও (সূরা জুম্মা : ৯-১০)।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে অজু করল, অতঃপর জুম্মা পড়তে এলো এবং মনোযোগ সহকারে নীরব থেকে খুতবা শুনল, সে ব্যক্তির এই জুম্মা ও আগামী জুম্মার মধ্যকার এবং অতিরিক্ত আরো তিন দিনের (ছোট) পাপগুলো মাফ করে দেওয়া হলো। আর যে ব্যক্তি (খুতবা চলাকালীন সময়ে) কাঁকর স্পর্শ করল, সে অনর্থক কাজ করল। অর্থাৎ সে জুম্মার সওয়াব ধ্বংস করে দিল (মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদের নামাজ অধ্যায়)।
শুক্রবার জুম্মার নামাজকে ফরজ করা হয়েছে। জুম্মার দুই রাকাত ফরজ নামাজ ও ইমামের খুতবাকে জোহরের চার রাকাত ফরজ নামাজের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। হজরত তারেক ইবনে শিহাব (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ক্রীতদাস, মহিলা, নাবালেগ বাচ্চা ও অসুস্থ ব্যক্তি- এই চার প্রকার মানুষ ছাড়া সব মুসলমানের ওপর জুমার নামাজ জামাতে আদায় করা অপরিহার্য কর্তব্য (ফরজ)’ (আবু দাউদ : ১০৬৭), মুসতাদরেকে হাকেম : ১০৬২, আস্-সুনানুল কাবির : ৫৫৮৭)। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া জুম্মার নামাজ বর্জন করবে, তার নাম মুনাফিক হিসেবে এমন দপ্তরে লিপিবদ্ধ হবে, যা মুছে ফেলা হবে না এবং পরিবর্তনও করা যাবে না (তাফসিরে মাজহারি, খ- : ৯, পৃষ্ঠা : ২৮৩)। কুবরা : ৪৯৩৫)।
জুমার দিন মূলত আজানের পর থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়টিতে কিছু ফরজ বিধান রয়েছে। এ সময়টিতে কিছু বিধান মেনে চলতে হবে। শরিয়তবহিভর্‚ত কোনো কাজ করা যাবে না। যেমন আজান হয়ে যাওয়ার পরও ব্যবসা বা অনর্থক কাজে ব্যস্ত থাকা। উপস্থিত মুসল্লিদের জন্য খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব। তাই খুতবা চলাকালে নিরর্থক কাজে লিপ্ত থাকা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। বর্ণিত হাদিসের মাধ্যমে সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণ হয়, খুতবার সময় নিশ্চুপ হয়ে খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব এবং কথাবার্তা বলা হারাম। অনুরূপ খুতবার সময় সুন্নত-নফল নামাজ পড়াও বৈধ নয়। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যখন ইমাম খুতবার জন্য বের হবেন, তখন নামাজ পড়বে না, কথাও বলবে না (মেশকাত : ৩/৪৩২)।
জুমার দিনের সীমাহীন ফজিলত রয়েছে। নবী (সা.) বিভিন্ন হাদিসে এসব ফজিলতের কথা তুলে ধরেছেন। বোখারি শরিফের হাদিসে রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো পুরুষ যখন জুমার দিন গোসল করে, সাধ্যমতো পবিত্রতা অর্জন করে, তেল ব্যবহার করে বা ঘরে যে সুগন্ধি আছে, তা ব্যবহার করে, তারপর (জুমার জন্য) বের হয় এবং (বসার জন্য) দুজনকে আলাদা করে না, এরপর সাধ্যমতো নামাজ পড়ে, তাহলে অন্য জুমা পর্যন্ত তার গুনাহ মাফ করা হয়।

জুমাবারের ফজিলতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, এই দিনে এমন একটা সময় আছে, যখন মুমিন বান্দা কোনো দোয়া করলে মহান আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার দিনে একটা এমন সময় আছে, যে সময়ে কোনো মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে ভালো কোনো কিছু প্রার্থনা করলে অবশ্যই আল্লাহ তাকে তা দান করবেন (সহিহ মুসলিম : ৮৫২, মুসনাদে আহমাদ : ৭১৫১, আস্-সুনানুল কুবরা : ১০২৩৪)। জুমার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার সে মহামূল্যবান সময় কোনটা? এ সম্পর্কে ৪৫টা মতামত পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হলো, আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দোয়া কবুলের সময়। হজরত আনাস (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার দিনের কাক্সিক্ষত সময়টা হলো আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত (মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা : ৫৪৬০, তিরমিজি : ৪৮৯)।
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, হজরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা জুমার দিনে বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করো। কারণ জিবরাইল আলাইহিস সালাম এইমাত্র আল্লাহতায়ালার বাণী নিয়ে উপস্থিত হলেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, পৃথিবীতে যখন কোনো মুসলমান আপনার ওপর একবার দরুদ পাঠ করে আমি তার ওপর দশবার রহমত নাজিল করি এবং আমার সব ফেরেশতা তার জন্য দশবার ইস্তেগফার করে (তারগিব : ৩/২৯৯)। যে ব্যক্তি জুমার দিন ৮০ বার দরুদ পড়ে তার ৮০ বছরের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। আল্লাহ আমাদের জুমার দিনের আমলগুলো সঠিকভাবে আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমিন।