কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাশিয়ার অধিকৃত খেরসন পুনর্দখলে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। তবে শহরটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে প্রতিরক্ষা জোরদার করছে রুশ সৈন্যরাও। ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় এই শহরটির নিয়ন্ত্রণ দুই পক্ষের জন্যই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই সামরিক বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আগামী দিনগুলোতে খেরসনের যুদ্ধ হবে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী।
খেরসন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
কৃষ্ণসাগর উপকূলের কাছে এই শহরটির অবস্থান নিপ্রো নদীর তীরে। এটি ক্রিমিয়া উপদ্বীপের খুব কাছে, যেটি ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে দখল করে নিয়েছিল রাশিয়া। ক্রিমিয়ায় এখন রাশিয়ার বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের প্রতিরক্ষা বিষয়ক গবেষক মারিনা মিরন বলেন, খেরসন হলো ক্রিমিয়ার প্রবেশদ্বার। এই যুদ্ধে এখন ইউক্রেনের মূল লক্ষ্য ক্রিমিয়া পুনর্দখল করা। তাই খেরসনের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নিতে পারলে সেই লক্ষ্য অর্জনের পথ সহজ হয়ে যাবে।
খেরসনের ভৌগলিক অবস্থান কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সাবেক ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফোবস্ ম্যাকেঞ্জি।
গোয়েন্দা বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসেসের এই প্রধান নির্বাহী বলেন, নিপ্রো নদীর নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি ইউক্রেনের একদম কেন্দ্র বরাবর বয়ে গেছে।
খেরসনের প্রতীকী গুরুত্ব
সামরিক গুরুত্বের পাশাপাশি শহরটির প্রতীকী গুরুত্বও কম নয়। খেরসন ইউক্রেনের একমাত্র আঞ্চলিক রাজধানী, যেটি রাশিয়া দখল করতে পেরেছে। যুদ্ধের শুরুর দিকেই শহরটি দখল করে নেয় রুশ সৈন্যরা। সম্প্রতি খেরসন এবং ইউক্রেনের আরও তিনটি অঞ্চলকে নিজের অংশ বলে ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া।
মিরন বলেন, এ কারণে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা খেরসন পুনর্দখল করতে পারলে একটি বার্তা যাবে যে, যুদ্ধের হাওয়া এখন ইউক্রেনের পালে। ইউক্রেনে পশ্চিমা বিশ্বকে দেখাতে পারবে, তাদের দেওয়া আর্থিক ও সামরিক সহযোগিতা বিফলে যাচ্ছে না।
তবে, রুশ সৈন্যরাও খেরসনের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মরিয়া। সম্প্রতি ইউক্রেনীয় সৈন্যদের পাল্টা হামলায় তারা দেশটির পূর্বাঞ্চলে প্রায় ছয় হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গা হারিয়েছে।
মিরন বলেন, রাশিয়ার জন্য এখন একটি বিজয় খুবই দরকার। তাদের দেখাতে হবে, তারা ইউক্রেনীয়দের পাল্টা হামলা প্রতিরোধে সক্ষম।
কেমন হবে খেরসনের লড়াই?
উত্তর এবং দক্ষিণ থেকে খেরসন শহরে রুশ সৈন্যদের সরবরাহ লাইন বিছিন্ন করার লক্ষ্যে নিপ্রো নদীর ওপর সেতুগুলোতে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ধীরে ধীরে তারা খেরসনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
গবেষক মারিনা মিরন বলেন, ইউক্রেনের পরবর্তী প্রধান টার্গেট নিপ্রো নদীর উজানের শহর বেরিস্লাভ। ওই শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে সেখানে থেকে তারা খেরসনের ওপর সহজে হামলা চালাতে পারবে। এটি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ঘটতে পারে।
তবে গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের স্থলযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক বেন ব্যারি মনে করেন, ইউক্রেনীয় সৈন্যরা খুবই ধীর গতিতে খেরসনের দিকে এগোচ্ছে।
তিনি বলেন, খেরসনের উত্তরে রুশ ফ্রন্ট-লাইন ভেঙ্গে ঢুকতে হবে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের। জায়গাগুলো এখন বেশ কর্দমাক্ত। ফলে তাদের অগ্রাভিযানের গতি কমে যেতে পারে। এমনকি রুশ প্রতিরোধ ভেঙ্গে শহরটিতে ঢোকা তাদের পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে।
রাশিয়া কি খেরসন থেকে সরে যাচ্ছে?
যুদ্ধের আগে খেরসনের জনসংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৮০ হাজারের মতো। রাশিয়া বলছে, তারা শহরটি থেকে ৭০ হাজার বেসামরিক লোক সরিয়ে নিয়েছে। এমনকি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে মস্কো।
রাশিয়া খেরসনে যে বেসামরিক প্রশাসন নিয়োগ দিয়েছে তার উপ-প্রধান কিরিল স্ট্রেমুসভ বলেছেন, নিপ্রো নদীর পশ্চিম তীরে খেরসনের কিছু জায়গা থেকে রুশ সৈন্যরা পিছিয়ে যেতে পারে। সম্ভবত আমাদের সৈন্যরা নদীর পূর্ব তীরে চলে যাবে।
তবে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী সন্দেহ করছে, এ ধরনের সৈন্য প্রত্যাহারের কথা আসলে রাশিয়ার একটি কৌশল হতে পারে।
ম্যাকেঞ্জি ইন্টেলিজেন্সের হিসাবে, পাঁচ থেকে ১০ হাজার রুশ সৈন্য খেরসন শহরের প্রতিরক্ষায় মোতায়েন রয়েছে।
গবেষণা সংস্থা দি ইনস্টিটিউট অব স্টাডি অব ওয়ার বলছে, রুশ সৈন্যরা খেরসনের ভেতর ছাড়াও শহরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থানও জোরদার করেছে।
বেন ব্যারি বলেন, নানা ধরনের পরস্পরবিরোধী খবর রয়েছে। রাশিয়া খেরসন থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু একই সময়ে তারা সেখানে ছত্রীসেনা ও নৌসেনা মোতায়েন করছে।
কতটা রক্তক্ষয়ী হবে যুদ্ধ?
ফোবস ম্যাকেঞ্জি মনে করেন, খেরসন পুনর্দখলে অভিযান শুরু করলে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের অনেক মূল্য দিতে হবে। ঘরে ঘরে লড়াই হতে পারে। ফলে বহু মানুষ মারা যাবে। সম্ভাব্য চিত্রটা খুবই ভয়ংকর।
তবে বেন ব্যারি মনে করেন, ঘরে ঘরে লড়াই না-ও হতে পারে। তিনি বলেন, দু’পক্ষেরই বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে। রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনীয়দের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে লড়াই করে একপর্যায়ে পিছু হটতে পারে। আবার, ইউক্রেনীয়রা ভেতরে না ঢুকে শহরটি ঘেরাও করে রুশদের সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দেওয়ার কৌশল নিতে পারে। আসলে এখন কোন পক্ষ কী কৌশল নেওয়ার কথা ভাবছে তা ধারণা করা প্রায় অসম্ভব।