কাজিরবাজার ডেস্ক :
কাগজের মোড়কে মোড়া তামাকের গুঁড়া হিসেবে সিগারেটের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। আইনের নানা সীমাবদ্ধতা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও দেশে এমন পরিবার খুব কমই পাওয়া যাবে, যে পরিবারের পুরুষ সদস্যের সিগারেটের মাধ্যমে ধূমপানে আসক্তি নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিগারেটে আসক্তি রয়েছে নারীদেরও। কিন্তু সম্প্রতি কাগজের মোড়কের সিগারেটের বাইরেও তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ই-সিগারেট। আইন অমান্য করে রাজধানীসহ সারাদেশে যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে এই ই-সিগারেট। প্লাস্টিকের আকর্ষণীয় কোনো মোড়কে তামাকের গুঁড়া ব্যবহার করে এর মাধ্যমে ধূমপান যেন বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের কাছে ফ্যাশনেরও অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে এর ব্যবহার বাড়ছে চোখে পড়ার মতো।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাগজের মোড়কের সিগারেটের চাইতে অন্তত দ্বিগুণ ক্ষতিকারক এই ই-সিগারেটের মাধ্যমে মানুষজন তামাকের ক্ষতিকারক ধোঁয়ার পাশাপাশি প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক প্রভাব নিজের অজান্তেই শরীরে গ্রহণ করছে। ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। তাই প্রয়োজনে আইনের ব্যবহার করে এটি বন্ধের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-সিগারেট বা ইলেকট্রনিক সিগারেট তৈরি করা হয় নিকোটিনের স্ট্রে দিয়ে এবং এর সঙ্গে অন্যান্য গন্ধযুক্ত তরল যুক্ত করা হয়। ই-সিগারেট বাজারজাত করা হয়েছিল ধূমপানের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে। বস্তুত ই-সিগারেট মোটেই ক্ষতিহীন নয়। এই সিগারেট তামাকের চেয়ে একটু কম মাত্রায় কার্সিনোজেন (ক্যান্সার উৎপাদক) তৈরি করে। তবে ই-সিগারেট আল্ট্রা ফাইন কণা তৈরি করে, যা ফুসফুস ও দেহের বায়ু চলাচলের রাস্তার ক্ষতি করে। এ ছাড়া এটি কার্ডিওভাস্কুলার ও ক্যান্সারহীন ফুসফুসের রোগের সঙ্গে যুক্ত টক্সিন তৈরি করে। তাই ই-সিগারেট প্রকৃতপক্ষে ধূমপানের কোনো স্বাস্থ্যকর বিকল্প নয়। সবচেয়ে ভালো হয়, ধূমপায়ীরা যদি তামাক অথবা ই-সিগারেট কোনোটাই ব্যবহার না করেন।
বাংলাদেশে এটা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা না হলেও ক্ষতিকর এই সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছেই। প্রায় বছরখানেক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৬ জন মারা গেছে ই-সিগারেট ব্যবহার করায়। বাংলাদেশে মূলত চীনের তৈরি অত্যন্ত সস্তা দামের ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। আগে এলাকার নামি-দামি দোকানে পাওয়া গেলেও এখন সাধারণ সুপার মার্কেটে, এমনকি ফুটপাথেও পাওয়া যাচ্ছে ই-সিগারেট। আবার ব্যবহারকারীর সামাজিক অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটেছে। সাধারণ পরিবারের উঠতি বয়সের তরুণরাও রাস্তায় যেতে যেতে ই-সিগারেট টানছে, যা চলার পথে চোখে লাগে উল্লেখ করে তামাকের ব্যবহারবিরোধী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত দি ইউনিয়নের কারিগরি পরামর্শক অ্যাড. সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, সম্প্রতি তরুণদের পাশাপাশি তরুণীদেরও দেখা যাচ্ছে রাস্তাঘাট, বড় বড় রেস্টুরেন্টের স্মকিং জোনগুলোতে প্রকাশ্যে ই-সিগারেট টানছে। রিক্সায় বসে অথবা বন্ধুর সঙ্গে মোটরসাইকেলের পেছনে বসে তরুণীদেরও ই-সিগারেট টানতে দেখা যাচ্ছে আজকাল, যা খুবই ভয়ংকর।
এর সত্যতা মেলে সরেজমিনে রাজধানীর ধানম-ি, গুলশান, বারিধারার কয়েকটি রাস্তায়। উঠতি বয়সী কিছু কিশোর পেনড্রাইভের মতো করে একটি পাইপের মাধ্যমে ই-সিগারেট পান করছে। এটি কেন পান করছ, জানতে চাইলে একজন বলে, ভালো লাগে তাই খাই। বন্ধুরা সবাই খাই। তাতে কার বাপের কী? পাশেই দাঁড়ানো আরেকটি কিশোরীকেও দেখা যায় ব্যাগ থেকে সিগারেটের পাইপ বের করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কনট্রোল (সিডিসি) ই-সিগারেটজনিত রোগটিকে বলেছে ‘ইভালি’। ইভালি ‘ই-সিগারেট অর ভ্যাপিং প্রোডাক্ট ইউজ-অ্যাসোসিয়েটেড লাং ইনজুরির সংক্ষিপ্ত রূপ। গবেষণায় বলা হয়, ই-সিগারেটে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা বলছে, ই-সিগারেট ব্যবহারকারীদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার দ্বিগুণ ঝুঁকি রয়েছে। আমেরিকান হার্ট ফাউন্ডেশন জার্নালে ২০১৮-এর আগস্টে এ বিষয়ক গবেষণায় হার্ট অ্যাটাকের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বলা হয়েছে।
ই-সিগারেটের কারণে ফুসফুসের রোগ বাড়ছে জানিয়ে রবিবার মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) আয়োজনে গণমাধ্যম কর্মীদের এক ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে বক্তারা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। মানসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, তামাকজাত সিগারেট পানে অভ্যস্ত ধূমপায়ীদের চেয়ে যারা ই-সিগারেট পান করে, তাদের হার্ট অ্যাটাকের তিনগুণ ঝুঁকি রয়েছে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো- যারা তামাকজাত সিগারেট ও ই-সিগারেট দুটোই পান করেন একই সঙ্গে অধূমপায়ীদের থেকে এদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি পাঁচগুণ। তরুণরা মনে করে ই-সিগারেট তামাকের চেয়ে ক্ষতিকর নয় অথবা একেবারেই ক্ষতিকর নয়। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, ই-সিগারেটেও নিকোটিন থাকতে পারে। অনেক সময় এর মধ্যে নিকোটিনের পরিমাণ তামাকজাত সিগারেটের চেয়ে বেশিও হয়ে থাকে। তিনি বলেন, বাষ্পজাত ধোঁয়া হয় বলে এটাকে ক্ষতিকর মনে করে না ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা। এটাকে কেবল পানি দিয়েই তৈরি করে না। এর মধ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে এবং রয়েছে খুব ক্ষতিকর ক্ষুদ্র কণা (পার্টিকল)। এই কণাগুলো অতিসূক্ষ্ম বলে এটা ফুসফুসে জ্বলা-পোড়ার মতো অনুভূতি সৃষ্টি করে। ই-সিগারেট ফুসফুসের ডিএনএর ক্ষতি করে থাকে। তাই আমরা তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার বন্ধে যে আইন করার সুপারিশ করেছি, এটিতে ই-সিগারেটের বিষয়টিও যোগ করেছি।
জানা যায়, চলতি বছরের জুন মাসে ই-সিগারেট ব্যবহার করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়াও ই-সিগারেট ও তার যন্ত্রাংশের আমদানি, রপ্তানি, মজুত, বিক্রি, পরিবহন ও অংশবিশেষ উৎপাদন নিষিদ্ধের কথাও বলা হয়েছে নতুন খসড়া আইনে। শুধু তাই নয়, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের খসড়া সংশোধনীতে ই-সিগারেট, ভেইপ কিংবা নিকোটিন পাউচ নিষিদ্ধের বিধান রাখা হয়। প্রস্তাবিত সংশোধিত আইনের ধারা প্রথমবার লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদ- বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদ- কিংবা উভয় দ-ে দ-িত হতে হবে। কিন্তু বারবার একই অপরাধ করলে শাস্তি দ্বিগুণ হারে বেড়ে যাবে।
ইতোমধ্যে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়েছে। ২০০৫ সালে প্রথম আইনটি প্রণয়ন করা হয়। পরে ২০১৩ সালে এটির সংশোধন করা হয়েছিল। বিদ্যমান আইনে ই-সিগারেট নিয়ে কিছু বলা নেই।
কয়েক বছর আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে ই-সিগারেট আমদানি শুরু হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই তা তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দেশে ই-সিগারেটের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় তা উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু করে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ। এ ছাড়া বাংলাদেশের বাজারে ই-সিগারেট বিপণনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইউনাইটেড জাপান টোব্যাকো লিমিটেড। প্রস্তাবিত নতুন আইনে তামাক ও তামাকজাত পণ্যে কোনো মিষ্টি, মসলা, সুগন্ধি কিংবা আসক্তিমূলক দ্রব্যের মিশ্রণও নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে। যদি কেউ প্রথমবার এই আইনের লঙ্ঘন করে, তবে দায়ীকে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদ- বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দ-ে দ-িত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। যদি এ ধরনের অপরাধ বারবার করা হয়, তবে শাস্তি দ্বিগুণ হারে বাড়তে থাকবে। তামাক ও তামাকজাত পণ্য ফেরি করে বিক্রি নিষিদ্ধেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে আইনের খসড়া সংশোধনীতে। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, খেলার মাঠ ও শিশুপার্কের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের বিক্রি নিষিদ্ধ হচ্ছে। কেউ এ বিধান লঙ্ঘন করলে প্রথমবার সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা এবং অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে পর্যায়ক্রমে দ্বিগুণ হারে দ-িত হবেন। কিন্তু বাস্তবে এ সব নীতিমালা সিগারেটের ধোঁয়ার মতোই ধোঁয়াশাময় বলে অভিমত তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর নেতাদের।
এ বিষয়ে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, সংশোধনীর খসড়াটি সময়োপযোগী। এটি দ্রুত পাস করে কার্যকর করা হলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তিনি জানান, ২০০৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন করার পর ২০১৩ সালে তা সংশোধন করা হলেও বাস্তবে তাতেও অনেক ঘাটতি আছে। এখন যে সংশোধনীর খসড়া তৈরি করা হয়েছে, তা বাস্তবতার নিরিখে যৌক্তিক।