আসামীদের ফাঁসি দাবী পরিবারের ॥ সাংবাদিক ফতেহ্ ওসমানী হত্যা মামলার এক যুগ পর কাল রায়

137

সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
নগরীতে চাঞ্চল্যকর সিলেটের বিশিষ্ট সাংবাদিক, কবি, লেখক ও গবেষক ফতেহ্ ওসমানী হত্যা মামলার রায় আগামী কাল সোমবার (৩১ অক্টোবর) ঘোষনা হতে যাচ্ছে। এক যুগ পর চাঞ্চল্যকর এ রায়টি ঘোষনা করবেন সিলেট বিশেষ জেলা জজ ও জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিচারক প্রশান্ত কুমার বিশ^াস। গত বৃহস্পতিবার চাঞ্চল্যকর এ রায় ঘোষনার সকল প্রস্তুতি ইতিপূর্বে সম্পুন্ন হয়েছে বলে ওই আদালতের বেঞ্চ সহকারী এস এম আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন।
সাংবাদিক ফতেহ ওসমানীর পরিবার জানান, তিনি মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করে তার রেখে যাওয়া ২টি মেয়েকে লেখা-পড়া চালিয়ে যাচ্ছে। এক যুগেরও ওপরে রায় ঘোষণার খবর জানতে পেরে সত্যি ভালো লাগছে। পরিবারের দাবী-সকল আসামীর যেন ফাঁসি (মৃত্যুদন্ড) হয়। নিহত ফতেহ্ ওসমানী (৫১) নগরীর পূর্ব চৌকিদেখী আ/এ রংধনু ১৩৩/৩ নং বাসার মৃত মোজাফ্ফর আলীর পুত্র।
ফতেহ্ ওসমানী আশির দশকে সিলেটের প্রাচীন পত্রিকা দৈনিক জালালাবাদী পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিকতা পেশা শুরু করেন। সর্বশেষ তিনি সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছিলেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি ফতেহ ওসমানী একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘লন্ডনের সুখ দুঃখ’, ‘প্রবাসীদের দিনকাল’। যুক্তরাজ্য সফর শেষে তিনি সর্বশেষ ‘লন্ডন’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। ‘একুশের ছড়া’ নামে তাঁর একটি ছড়াগ্রন্থ ছিলো।
মামলার বাদি নিহত ফতেহ ওসমানীর ছোট ভাই আল-ফরহাদ মতিন জানান, এই মামলা চালাতে গিয়ে অনেক কষ্ট ও ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হতে হয়েছে। আইনজীবী ও আদালতের মধ্যে জানতে পেরেছি আগামীকাল সোমবার রায় ঘোষণা হবে। তবে ৬ আসামীর মধ্যে আসামী মো: কাশেম আলী কারাগারে রয়েছে। বাকী সকল আসামী পলাতক আছে। এতে আমাদের পরিবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছি। তিনি বলেন, আমার ভাইর বন্ধু আব্দুল মালেক ঘটনার সময় তার সাথে ছিলেন। কিন্তু তিনি প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকার পরও বার বার তার বিরুদ্ধে আদালত সমন ইস্যু করা হলেও তিনি আদালতে সাক্ষী দিতে যাননি। এতে মামলার রায় কি হবে আমাদের পরিবার শংকিত। তবে সকল আসামীর সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করছি।
মামলা ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে সাংবাদিক ফতেহ্ ওসমানী তার বন্ধু নগরীর লন্ডনী রোডের অগ্রনী ৩২ নং বাসার মৃত এরশাদ আলী পুত্র আব্দুল মালেককে নিয়ে সিলেট-হ-১১-২৮৭৫ নং মোটর সাইকেলে (ইমা-৮০সিসি) সাথে বাসায় ফিরছিলেন। রাত সাড়ে ১১ টার দিকে নগরীর শাহী ঈদগাহস্থ শাহ মীর (র:) মাজারের সামনের রাস্তায় পৌঁছামাত্র ৮ থেকে ১০ জন শস্ত্র ছিনতাইকারী তাদের গতিরোধ করে। এ সময় ছিনতাইকারীরা তাদের দু’জনকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মোটর সাইকেল থেকে নামিয়ে জোরপূর্বক ফতেহ ওসমানীর সাইট ব্যাগ নিয়ে নেয় এবং তাকে চাকু দিয়ে ডান উরু ও বাম বুকে এলোপাতাড়ি ৩টি আঘাত করে এবং কুপিয়ে তাকে গুরুতর আহত করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় তার বন্ধু আব্দুল মালেক এতে বাধা দিলে তাকেও ছিনতাইকারীরা পিটে ও উরুতে কুপিয়ে আহত করলে তার শোর চিৎকারে আসামীরা পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এসে আহতদের উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। এদিকে সাংবাদিক ফতেহ্ ওসমানীর অবস্থা অবনতি হলে তাকে ১৯ এপ্রিল উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার পি.জি হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। পি.জি হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব না হলে ফতেহ্ ওসমানীকে ঢাকার ব্যয়বহুল এপ্যোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ২৮ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮ টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরিবার পরিজনদের প্রচেষ্টা, সহকর্মী-শুভানুধ্যায়ীদের নিরন্তর শুভকামনা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো যায়নি। এদিকে তার বন্ধু আব্দুল মালেক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেন।
আব্দুল মালেকের কাছ থেকে বিস্তারিত শুনে নিহত ফতেহ্ ওসমানীর ছোট ভাই আল-ফরহাদ মতিন বাদি হয়ে ছিনতাইকারী ও সন্ত্রাসী সাদ্দাম উরফে টাইগার সাদ্দাম ও কাশেমের নাম উল্লেখ্য করে অজ্ঞাতনামা আরো ৮/১০ জনকে আসামী করে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন। যার নং-৯৯ (২১-০৪-২০১০)। জিআর-৪৩০। ধারা-৩৪১/৩২৩/৩২৬/৩০৭/৩৭৯ দ:বি:। পরে ফতেহ্ ওসমানী মারা যাওয়ার পর পুলিশ মামলাটিতে ৩৯৬ ধারাটি যুক্ত করে।
আদালত সূত্র আরো জানায়, প্রথমে কোতোয়ালী থানার এসআই মোজাহারুল ইসলাম মামলাটি তদন্ত করেন। এরপর মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন এসআই মো: আব্দুর রহিম। তিনি ২০১১ সালের ১৯ জুলাই টাইগার সাদ্দাম ও কাশেমসহ ৬ ছিনতাইকারীকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র নং-৫৫১) দাখিল করেন। অভিযুক্তরা হচ্ছে, সুনামগঞ্জ সদর থানার মঙ্গলকাটা বাজার এলাকার দুর্লভপুর গ্রামের হানিফ মিয়ার পুত্র বর্তমানে নগরীর ইলাশকান্দি আলতু মিয়ার কলোনীর বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন উরফে টাইগার সাদ্দাম (২২), জৈন্তাপুর থানার আদর্শগ্রামের হাবিবুর রহমানানের পুত্র মো: কাশেম আলী (২২), সুনামগঞ্জ জেলার বিশ^ম্ভরপুর থানার আমতলী গ্রামের রাজন মিয়ার পুত্র বর্তমানে শাহপরান থানার টুলটিকর এলাকার বাসিন্দা সুমন (২২), নগরীর আরামবাগ ১৩ নং বাসার সিরাজ মিয়ার পুত্র স্বপন মিয়া (২৫), কিশোরগঞ্জ সদর থানার নগুয়া গ্রামের আজিজুর রহমান উরফে আব্দুল আজিজের পুত্র বর্তমানে শাহপরান থানার বটেরতল বাবু মিয়ার কলোনীর বাসিন্দা মো: ফয়ছল আহমদ রাসেল (২৩) ও সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই থানার ভাটিপাড়ার (গণকা) জাহান নুরের পুত্র বর্তমানে উত্তর বালুচর আল-ইসলাহ্ বাসিন্দা শাহ আলম (২৪)।
পরবর্তীতে কোতোয়ালী থানা থেকে মামলাটি এয়ারপোর্ট থানায় বদলী হয়ে যায়। এরপর বাদি আল ফরহাদ-মতিন এ অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দিলে মামলাটি ২০১২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারী এয়ারপোর্ট থানার এসআই মো: আ: আলীম মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন এবং উল্লেখিত আসামীদের অভিযুক্ত করে ৩৯৬ ধারায় ওই বছরের ১৯ জুলাই আদালতে (অভিযোগপত্র নং-২৪৩) সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন।
আদালত সূত্র জানায়, ঘটনার ১৪/১৫ দিন পর স্থানীয় জনতা চৌকিদেখী এলাকা থেকে সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী সাদ্দাম উরফে টাইগার সাদ্দামকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন। এর পর পুলিশ ২০১০ সালের ৫ মে চার্জশিটযুক্ত আসামী সুমন, ২৩ মে কাশেম আলী, ২ আগষ্ট মো: ফয়ছল আহমদ রাসেল ও ২০১১ সালের ৮ জুন শাহ আলমকে গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করে। এর মধ্যে ২০১০ সালের ১ জুন কাশেম আলী ও ৫ জুন আসামী সুমন তৎকালীন সিলেট চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো: মোয়াজ্জেমেল হোছাইন এর আদালতে ঘটনার দায় স্বীকার করে ফৌজধারী কার্যবিধি আইনের ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী প্রদান করে। আসামীরা সবাই ছিনতাইকারী।
এর পর উল্লেখিত সকল আসামীকে অভিযুক্ত করে ২০১৩ সালের ২১ মে চার্জগঠন করে আদালত এ মামলার বিচারকার্য্য শুরু করেন। ২৯ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। এর মধ্যে চার্জশিটে ৭নং সাক্ষী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিলেন ফতেহ ওসমানীর বন্ধু আব্দুল মালেক। কিন্তু তিনি আদালতে সাক্ষ্য দেননি।
সিলেট বিশেষ জেলা জজ ও জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল এর সাবেক স্পেশাল পিপি এডভোকেট মো: আখতার বক্ত জাহাঙ্গীর এর কাছে সরাসরি এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাংবাদিক ফতেহ্ ওসমানী একটি চাঞ্চল্যকরা হত্যা মামলা। এ মামলায় প্রথম ও দ্বিতীয় সম্পূরক চার্জশিটে ফৌজধারী আইনের ৩০২ ধারা না দিয়ে শুধু ৩৯৬ ধারাটি সংযুক্ত করে আদালতে পুলিশ চার্জশিট থাকিল করেছে। কারন ঘটনার সকল বিষয় ওই ৩৯৬ ধারাটিতেই বহাল রেখে রাষ্ট্রপক্ষ বিচারিক কার্য্যে লড়েছে। মামলার ৭নং সাক্ষী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আব্দুল মালেক আদালতে সাক্ষ্য দেননি কেন এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আইনী যতটুকু পদ্ধতি অবলম্ভন করা প্রয়োজন সকল পদ্ধতিতে সাক্ষীকে আদালতে হাজিরের নির্দেশ সংম্ভলিত আদেশ আদালত কর্তৃক করা হইলেও রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীকে পরিক্ষা করা সম্ভব হয় নাই এটাই সত্য। তিনি বলেন, চার্জশিটে ৬ আসামীকে যুক্তিতর্কে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সর্বচ্চো শাস্তির প্রার্থনা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
গতকাল শনিবার মুঠোফোনে রায়ের বিষয়ে সিলেট বিশেষ জেলা জজ ও জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল এর পিপি এডভোকেট মো: মফর আলী বলেন, সিলেটে এ ধরণের একজন সাংবাদিককে হত্যা করে আসামীরা পার পেতে না পারে সেজন্য রাষ্ট্রপক্ষ সকল আসামীদের সর্বচ্চো শাস্তি আশা করছে।