কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিশ্ববাজারে কমলেও দেশের বাজারে চিনির দাম বেড়েই চলেছে। শুধু তা-ই নয়, চিনির সংকট দেখা দেওয়ায় অনেকটা হইচই পড়ে গেছে বাজারে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চিনির বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। যদিও ট্রেডিং ইকোনমিকসের হিসাবে গত শুক্রবার (২১ অক্টোবর) বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমেছে ০.০৫ শতাংশ, আর গত এক সপ্তাহে দাম কমেছে ২.৪৪ শতাংশ। বিশ্ববাজারে বর্তমানে চিনির দাম প্রতি পাউন্ড ০.১৮৩৮ ডলার। এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমেছে ০.৭ শতাংশ। আর আগের মাস আগস্টে দাম কমেছে ২.১ শতাংশ। গবেষণা প্রতিষ্ঠান কভারিং অ্যানালিটিকস গত শুক্রবার এক পূর্বাভাসে জানিয়েছে, ২০২২-২৩ মৌসুমে বিশ্বে চিনি উৎপাদন আগের বছরের চেয়ে ৪.৮ শতাংশ বেড়ে হবে ১৯৪.২৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এর ফলে বিশ্ববাজারে উদ্বৃত্ত থাকবে ৫.৪৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এছাড়া স্টোনএক্স জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ মৌসুমে বিশ্ববাজারে চিনির উৎপাদন ৩ শতাংশের বেশি বেড়ে হবে ১৯৪.৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে ভিন্ন কথা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চাহিদা অনুযায়ী দেশে পর্যাপ্ত চিনি আমদানি হয়েছে। বর্তমানে দেশে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন, যার সিংহভাগই আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে ১৭ লাখ মেট্রিক টন চিনি আমদানি করা হয়েছিল। চলতি ২০২২ সালে ইতোমধ্যে সাড়ে ১৬ লাখ মেট্রিক টন চিনি আমদানি করা হয়েছে। রবিবার (২৩ অক্টোবর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত বছরের তুলনায় এ বছর চিনির সরবরাহে কোনও ঘাটতি নেই। শিগগিরই আরও ১ লাখ টন চিনি আমদানি করা হচ্ছে। একটু তদারকি করলে চিনির বাজার স্বাভাবিক হবে। তবে সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, এবার চাহিদার তুলনায় কম চিনি আমদানি হয়েছে।
বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, বাংলাদেশ প্রতি বছর ২৭-২৮ মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। যেখানে এ বছর এখন পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ টন। গত বছর একই সময়ে চিনির আমদানি ছিল ২৫ লাখ টন, তার আগের বছর ছিল ২৭ লাখ টন।
সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমানের সই করা ওই চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ৯৬-৯৮ টাকা ডলার রেটে খোলা ঋণপত্রের বিনিময়মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে ১০৫ টাকায়। আগে যেখানে আমদানি শুল্ক ছিল প্রতি টনে ২২-২৩ হাজার টাকা, এটা এখন সাড়ে ৩১ থেকে ৩২ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রতি টন চিনির মিলগেট মূল্য দাঁড়াচ্ছে ১ থেকে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ মণপ্রতি খরচ দাঁড়াচ্ছে ৩ হাজার ৭০৩ থেকে ৩ হাজার ৮৮৭ টাকা। কিন্তু বর্তমান মিলগেট মূল্য ৩ হাজার ১৫০ টাকা। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় থাকা ৫২ হাজার টনের বাইরে আমদানি পর্যায়ে আর কোনও চিনি নেই। ফলে দেশে চিনির ঘাটতির আশঙ্কা করছে মিলগুলো। অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি অপরিশোধিত চিনির জাহাজ রয়েছে এবং রফতানিকারক দেশ ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশে আসার মতো কোনও জাহাজ লাইনআপে নেই। অপরদিকে বিকল্প হিসেবে ভারতও চিনি রফতানি বন্ধ রেখেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশে চিনির ঘাটতি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করছে অ্যাসোসিয়েশন।
এমন পরিস্থিতিতে অ্যাসোসিয়েশন চিনির ওপরে আরোপিত সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কোনও বিধিনিষেধ ছাড়া ঋণপত্র খোলার অনুমতি দেওয়া, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রস্তাবিত ডলার মূল্যে আমদানিকৃত চিনির মূল্য পরিশোধে ডলার সরবরাহ নিশ্চিত করা, ৩৬৫ দিনের ডেফারড পেমেন্টের মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানির ব্যবস্থা এবং কারখানা চালু রাখার স্বার্থে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে।
প্রতিদিন চিনি লাগে ৫ হাজার মেট্রিক টন
দেশে প্রতিদিন গড়ে চিনির চাহিদা ৫ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু এখন উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ৩ হাজার মেট্রিক টন। ফলে দিনে চিনির ঘাটতি হচ্ছে দেড় হাজার টন। আর চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ও সরবরাহ কম থাকায় চিনির দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।
মজুত চিনিতে চলবে আরও তিন মাস
সফিকুজ্জামান বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চিনির কোনও ঘাটতি নেই। এখন পর্যন্ত যে চিনি মজুত আছে, তা দিয়ে অন্তত তিন মাস চলা যাবে। তবে সমস্যা হচ্ছে, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে অপরিশোধিত চিনি পরিশোধন করা যাচ্ছে না। তাই উৎপাদন ও চাহিদার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আলোচনা করে সমস্যা চিহ্নিত করেছি। আশা করছি শিগগিরই চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।’
প্রতিশ্রুতি দিলেন মিল মালিকরা
এদিকে মিল মালিকরা এখন বলছেন, দেশে অপরিশোধিত চিনির কোনও ঘাটতি নেই। কিন্তু গ্যাস না পাওয়ায় চাহিদা মতো চিনি পরিশোধন করতে পারেনি মিলগুলো। যে কারণে বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। তবে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। সোমবার (২৪ অক্টোবর) রাত থেকেই পরিশোধনকারী মিলগুলো চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক করবে। ফলে মঙ্গলবার থেকেই বাজারে চিনির সংকট কেটে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বেসরকারি চিনি সরবরাহকারী মিল মালিক ও চিনি ব্যবসায়ীরা।
সোমবার জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের চিনির সরবরাহ এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে মিল মালিক, রিফাইনারি, পাইকারি এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের মতবিনিময় সভায় তারা এ প্রতিশ্রুতি দেন। অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামানের সভাপতিত্বে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
অবশ্য চিনির বাজার স্থিতিশীল করতে মিল মালিক, রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান ও পাইকারদের কাছে মজুত চিনি বাজারে ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চিনিসহ নিত্যপণ্যের বিষয়ে বৈঠকের সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস এ তথ্য জানান।
সফিকুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে সরকার বেশ তৎপর আছে। আজকে চিনিসহ নিত্যপণ্যের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়েছে। সভায় প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে জানানো হয়, বর্তমানে চিনির মিল, রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে যে এক লাখ মেট্রিক টন পরিশোধিত চিনি মজুত রয়েছে, তা আগামী দুই দিনের মধ্যে বাজারে সরবরাহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আশা করছি খুব শিগগিরই বাজার সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
পাওয়া গেলো ১৩৪ বস্তা চিনি
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের অভিযানে শুধু রাজশাহীতেই মিলেছে ১৩৪ বস্তা চিনি। সোমবার (২৪ অক্টোবর) দুপুরে রাজশাহী নগরীর সাহেব বাজার এলাকায় অভিযানে দেখা গেলো গুদামভর্তি চিনির বস্তা। যদিও মালিক আলী আহম্মেদ বলছিলেন, চিনি নেই। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই পাওয়া গেলো ১৩৪ বস্তা চিনি। চিনির মজুত নিয়ে এ ধরনের মিথ্যা কথা বলায় রাজশাহী নগরীর সাহেব বাজার এলাকার আলী ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পাশাপাশি দ্রুত মজুত চিনি বিক্রি করে দেওয়ার জন্য আলী ট্রেডার্সকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাজার পরিস্থিতি
ব্যবসায়ীদের একটি অংশ চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতির অজুহাত তুলে সরকারের বেঁধে দেওয়া মূল্যের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছে চিনি। অনেক এলাকায় প্যাকেট চিনিও উধাও হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে খোলা চিনির দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। ক্রেতারা বলছেন, জনগণকে জিম্মি করে ব্যবসায়ীরা খেলায় মেতেছেন। তারা সরকারের কোনও নিয়ম-নীতি মানছেন না। নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর বেশিরভাগ দোকানে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা কেজিতে। এক সপ্তাহ আগের কেনা চিনি কিছু কিছু দোকানে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা কেজি। বাজার ও দোকানগুলোতে প্যাকেটজাত চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এই দোকানগুলোতে এক সপ্তাহ আগেও চিনি বিক্রি হয়েছে ৯০-৯৫ টাকা কেজি দরে। আর প্যাকেটজাত চিনি ছিল ৯৫ টাকা কেজি।