শি জিনপিংই আবার প্রেসিডেন্ট

28
The Prime Minister, Shri Narendra Modi in a bilateral meeting with the President of the People's Republic of China, Mr. Xi Jinping, in Tashkent, Uzbekistan on June 23, 2016.

কাজিরবাজার ডেস্ক :
শুরু হয়েছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক কংগ্রেস। রবিবার (১৬ অক্টোবর) রাজধানী বেইজিংয়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে শুরু হয় কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভাটি।
এতে ভাষণ দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ধারণা করা হচ্ছে, তিনিই তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্টের মসনদে বসবেন।
কিন্তু চীনের নাগরিকরা হয়তো শি-কে তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চায় না। কারণ, দুদিন আগে দেশটিতে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসের আগেই বেইজিংয়ের জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়ছে।
কিন্তু কেন এ হতাশা? বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, দেশটির করোনাবিধি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে নাগরিকরা শি’র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন। যদিও এ সিদ্ধান্তে কঠোর অবস্থানে আছে তার দল। এএফপির খবরে বলা হয়েছে, শি প্রেসিডেন্ট পদে আবার বসতে পারেন। কিন্তু জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে তাকে কভিড নীতি সম্পর্কে ভাবতে হবে। কংগ্রেসের সম্মেলনে চীনের জিরো কোভিড নীতি সম্পর্কে রুদ্ধদ্বার আলোচনা হবে।
করোনার বিধিনিষেধ নিয়ে যারা আন্দোলন করেছিলেন, তাদের দাবি করোনাভাইরাসের টেস্ট বাদ দিয়ে তাদের কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। লকডাউন বাতিল ও মুক্ত চলাচলের দাবিও করেন তারা। বিক্ষোভকারীরা আন্দোলনের সময় নিজেদের সঙ্গে ‘আমরা আর কোভিড টেস্ট চাই না, খেয়ে পরে বাঁচতে চাই’; ‘আর লকডাউন নয়, আমাদের মুক্তভাবে চলাচল করতে দাও’ লেখা ব্যানার সঙ্গে রেখেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, চীন সরকার জনগণের ওপর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জোর খাটিয়ে যাচ্ছে। তবে, এটি প্রহসন নয়।
সম্মেলনের শুরুতে দেওয়া ভাষণে এ ব্যাপারে বলেন শি জিনপিং। প্রেসিডেন্টের ভাষ্য, ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করা সর্বাত্মক জনগণের যুদ্ধ। যে কারণেই জিরো-কোভিড নীতি বলবৎ রয়েছে। এতে জীবন রক্ষা হয়েছে। যদিও চীনের জনগণের ওপর এটি বিরূপ প্রভাবও ফেলেছে। আমরা সর্বাধিক মানুষের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা রক্ষায় বিশ্বাসী।
শি’র কথায় বোঝা যায়, খুব সহজেই জনগণের ইচ্ছা পূরণ হচ্ছে না। অর্থাৎ, তারা কভিড নীতি থেকে যে স্বাধীনতা চাচ্ছেন তা মিলছে না।
তাইওয়ান ইস্যুও শি’র নতুন করে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ মসৃণ করতে পারে। সম্প্রতি অঞ্চলটিকে নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। তাইওয়ানে নিজেদের বলে দাবি করা চীন পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রে শত্রুতে পরিণত হয়েছে। প্রাচীন একটি কথা চীনে প্রচলিত রয়েছে, চীনারা যা একবার নিজেদের বলে মনস্থির করে, তারা সেটির পেছনে লেগেই থাকে যতক্ষণ না সেটি অর্জিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান প্রণালীকে রক্ষা করবে বলে যে বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেটি গায়ে মাখছেন না শি। বরং, যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি সরাসরি আগুন নিয়ে খেলতে না করেছেন।
কিছুদিন আগে মার্কিন হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর কয়লার আগুন তাঁতিয়ে দেয়। চীনা সরকারি কর্মকর্তারা মার্কিনিদের এ ব্যাপারে শুরু থেকেই সতর্ক করে আসছিল। এ ছাড়া ন্যান্সির সফর চীনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের সামিল বলে তারা মন্তব্য করেন। যুক্তরাষ্ট্র এক-চীন নীতি বর্জন করছে বলেও অভিযোগ ওঠে।
এই ইস্যুতে চীন বরাবরই বলে আসছিল সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যার পরিণতি যেকোনো অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
রবিবারের সম্মেলনে ভাষণে শি এ ব্যাপারে বলেন, তাইওয়ান সমস্যা সমাধান করা চীনা জনগণের নিজস্ব বিষয়। অঞ্চলটিতে তাইওয়ানে বলপ্রয়োগ না করার ব্যাপারে তিনি কখনোই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবেন না। হংকংয়ের ওপর চীন ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, তাইওয়ানেও সেটি হবে বলে তিনি জানান।
শি বলেন, আমরা আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলনের চেষ্টা করবো। কিন্তু বলপ্রয়োগ না করতে কখনই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবো না। এ সময় তাইওয়ানে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বাইরের দেশের হস্তক্ষেপের নিন্দা জানান তিনি। মাতৃভূমির পুনর্মিলন অবশ্যই অর্জন করা হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
উল্লেখ্য, ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করার পর তাইওয়ান চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু বেইজিং সবসময় তাইওয়ানকে নিজেদের প্রদেশ বলে দাবি করে।
কীভাবে তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হবে শি জিনপিং
সাধারণত চীনের প্রেসিডেন্ট পদে এক ব্যক্তির দুবার নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু শি তার ক্ষমতা বাড়াতে সংবিধানের পরিবর্তন করেন। ২০১৮ সালে চীনের সংবিধান সংশোধন করা হয়। এতে প্রেসিডেন্ট পদে থাকার সময়সীমা বাতিল করা হয়। আবার দেশটিতে ৬৮ বছর বা তার কম বয়সীদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি ছিল। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের কারণে সেটি আর থাকছে না। শি জিনপিংয়ের নিজের বয়সই এখন ৬৯। তিনি বলেছিলেন, সর্ব ক্ষমতার অধিকারী হতে তার দলের ও কমিটির নেতা পাশে থাকলেই হবে।
রবিবার যে সম্মেলন হচ্ছে, তার অনেকটাই লোক দেখানো বলে বিশ্বের বেশ কিছু গণমাধ্যম মন্তব্য করেছে। এটি অবশ্য গণমাধ্যমগুলোর নিজস্ব মন্তব্য নয়। বড় বড় বিশ্লেষকরা, বছরের পর বছর গবেষণা করে যে ফল প্রকাশ করেছেন, তার আলোকেই শি’র তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। অনেক বিশ্লেষক আবার বলেছেন, শি ও তার চল স্বৈরশাসকের ভূমিকা বেশ ভালোভাবেই পালন করছেন। তাই তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে কোনো বাধা নেই।
সংবাদসংস্থা শিনহুয়া শি-কে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কাজের মানুষ বলে অভিহিত করেছে। বলা হয়েছে, তার চিন্তা অনেক গভীর; তিনি অনুভূতিপ্রবণ মানুষ। তিনি নতুন পথে যেতে ভয় পান না। তার চিন্তাভাবনা প্রগতিশীল এবং চীনকে তিনি নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন।
এর আগে ১৯৪৫ ও ১৯৮১ সালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এ ধরনের প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের প্রস্তাব ছিল কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা দখলের চার বছর পর। আর ১৯৮১ সালে ডেং জিয়াওপিং বড় ধরনের আর্থিক সংস্কার করার আগে এই প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল। শি’র সমর্থকরা দাবি করেন, এবার যে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে এটি তার ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করবে। তিনি মাও সে তুং ও ডেং জিয়াওপিংয়ের সমান গুরুত্ব পাবেন।
এদিকে, শি আবার মাও সে তুংয়ের মতো মর্যাদাবান। কারণ, তার চিন্তাধারা দলীয় গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। তাই আধুনিক চীনের রূপকার হিসেবে স্বীকৃত মাও সে তুংয়ের পর শি হন দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় নিজের চিন্তা দলীয় গঠনতন্ত্রে মতাদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলতে পেরেছিলেন। ফলে চীনে মাও সে তুংয়ের মতবাদ যেমন মাওবাদ হিসেবে বিবেচিত হয়, শি’র চিন্তাধারা বিবেচিত হবে শি-বাদ হিসেবে। এর বিরুদ্ধে যেকোনো চ্যালেঞ্জ কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধের অবস্থান বলে বিবেচিত হবে।
রয়েছে ক্ষোভ
শি’র প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে বাধা না থাকলেও বিতর্ক ছড়াচ্ছে তার বিরুদ্ধে হওয়া প্রতিবাদ। বৃহস্পতিবার বেইজিংয়ের হাইডান জেলার সিটং ব্রিজের ওপর অভিনব ও বিরল প্রতিবাদ করেছিলেন নাগরিকরা। এ সময় শি জিনপিংকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের ডাক দেওয়া হয়। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনের বিপক্ষে ধর্মঘট ও আইন-অমান্য আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে।
২৩ পৃষ্ঠার এক ইশতেহারে বলা হয়েছে, স্বৈরশাসক শি জিনপিং যেন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রাখতে না। চীন যাতে গণতন্ত্রের পথে যেতে পারে সেজন্যে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। তাই বেইজিংয়ে জোরদার করা হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা। তারপরও শি তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হবেন, জোর আশা করছেন তার নেতাকর্মী ও সমর্থকরা।