ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে চাই – প্রধানমন্ত্রী

13
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর স্থানীয় একটি হোটেলে যুক্ত হয়ে Bangladesh Delta Plan 2100 International Conference: ‘Issues and Challenge of Implementaion’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন প্রজন্ম যাতে সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে বাংলাদেশ নামক বদ্বীপকে সেভাবে গড়ে তোলার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করছে জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ। এই বদ্বীপ আমাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। তিনি বলেন, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, বাংলাদেশ যাতে আমরা সুরক্ষিত করতে পারি। শুধু আজকের জন্য নয়, আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশ যেন টেকসই হয়, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয় এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আমরা অর্জন করতে পারি। তাঁর সরকার ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করতেই ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়ন করছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ এবং উন্নয়ন অংশীদারদেরও এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে দেশী-বিদেশী নীতিনির্ধারক, গবেষক, শিক্ষক, উন্নয়নকর্মী এবং উন্নয়ন সহযোগীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ আন্তর্জাতিক সম্মেলন : সমস্যা ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক দু’দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগ এবং নেদারল্যান্ডসের দূতাবাস যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এ্যানি গেরাড ভান লিউয়েন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোন ভূমিকা না থাকা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। আর ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ এবং উন্নয়ন অংশীদারদের সহযোগিতা এবং অংশগ্রহণ একান্তভাবে প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ হলো একটি বদ্বীপ যেখানে ৭শ’ নদী এবং বিস্তীর্ণ নিচুজমি ও জলাভূমি রয়েছে এবং আমাদের এটিকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারে। আমরা সেভাবেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।
সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনাÑ তথ্যপ্রযুক্তি ও জ্ঞানভিত্তিক একটি টেকনো-ইকোনমিক মহাপরিকল্পনা। এর পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়নে ২০২৫ সাল নাগাদ জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থের প্রয়োজন হবে। ফলে অর্থায়ন থেকে শুরু করে জ্ঞান, প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। তিনি এজন্য বিভিন্ন বন্ধুপ্রতীম দেশ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
তিনি এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম নেদারল্যান্ডস এগিয়ে আসায় তাদের ধন্যবাদ জানান এবং এ ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কথা উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কথা চিন্তা করেই তাঁর সরকার কিছু স্বল্প মেয়াদি, মধ্য মেয়াদি এবং দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর পরই জাতির পিতা এই বদ্বীপের সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। জাতির পিতা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ভারতের সঙ্গে স্থায়ীভাবে একটি যৌথ নদী কমিশন গঠনে ইন্দিরা গান্ধীকে রাজি করান। ফলে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা সফরকালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন ও সেচ সুবিধার উন্নয়নে দু’দেশের জনগণের পারস্পরিক সুবিধা অর্জনের জন্য এবং সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় পাওয়ার গ্রীড স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য যৌথ ইশতেহার (১৪-ক) ঘোষণার মাধ্যমে যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। উক্ত ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে একই বছর ২৪ নবেম্বর যৌথ নদী কমিশন স্ট্যাটিউট স্বাক্ষরিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৪ সালেই জাতির পিতা সমুদ্রসীমা আইন প্রণয়ন করেন। তখনও জাতিসংঘ সেই আইন করেনি, তারা করেছিল ১৯৮২ সালে। বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় পর্যায়ে (জ্যামাইকার কিংস্টোনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ্ সম্মেলনে) আলোচনা শুরু করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় ’৭৫-এর পর যারা ক্ষমতায় ছিল তারা সমুদ্রসীমায় বাংলাদেশের অধিকার নিয়ে আর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
শেখ হাসিনা বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর তাঁর সরকার ১৯৯৬ সালেই ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্বারোপ করে। ফলে ১৯৯৮ সালেই বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সমর্থ হয়।
তিনি বলেন, সে সময় একটি ভয়াবহ বন্যা আঘাত হেনেছিল এবং বিদেশের বিভিন্ন দেশের মিডিয়ায় সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল যে প্রায় ২ কোটি মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে এবং তাঁর সরকারের কার্যকর পদক্ষেপে একটি মানুষও না খেয়ে মারা যায়নি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
পার্শ^বর্তী দেশ ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে দুই দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তিতেও তাঁর সরকারের সাফল্যের উল্লেখ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রতিনিয়ত বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙ্গন, লবণাক্ততা, পাহাড়ধস প্রভৃতি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে চলতে হয়। তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত দুর্যোগ মোকাবেলার নীতিমালা আমরা অনুসরণ করে চলি।
‘কপ ১৫’ এ যোগ দিয়ে দেশে ফিরেই জলবায়ুর ‘অভিযোজন এবং প্রশমনে’ কর্মসূচী বাস্তবায়নে নিজস্ব অর্থায়নে ট্রাস্ট ফান্ড করে পদক্ষেপ নেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডেল্টা প্ল্যানটা এই জন্যই আমরা এখন গ্রহণ করেছি। কেননা, শত বছরের বাংলাদেশ যাতে টেকসই হয় এবং উন্নত-সমৃদ্ধশালী হয় সেটাই লক্ষ্য। কাজেই এই জলবায়ু অভিঘাত থেকে আমাদের জনসংখ্যাকে বাঁচানোর পাশাপাশি তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এবং শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদাগুলো বাস্তবায়নেও আমরা পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জনগণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি সুপেয় পানিয় জলের ব্যবস্থা এবং খাদ্য পুষ্টির নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা একান্তভাবে অপরিহার্য। দিন দিন জনসংখ্যা বাড়লেও ভৌগোলিক সীমারেখা বাড়বে না, সেটি মাথায় রেখেই আমরা গবেষণা করছি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতিও তাঁর সরকার গৃহীত পদক্ষেপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশের জনগণ পিছিয়ে থাকবে না বরং এগিয়ে যাবে এবং সেটা তাঁর সরকার প্রমাণ করেছে উল্লেখ করে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যদিকে কোভিড-১৯ এর আঘাত আবার এদিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, যার ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। এর মাঝেও দেশের মানুষের যাতে কোন রকম কষ্ট না হয় সেজন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখার এবং দেশকে এগিয়ে নেয়ায় তাঁর সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
এক্ষেত্রে তাঁর সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন প্রণোদনার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, আজকে আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ৮শ’ ২৪ মার্কিন ডলার হয়েছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দিয়েছি, গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড পৌঁছে দিয়েছি, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছি এবং সর্বপরি ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতির গতিকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার জাতিসংঘ ঘোষিত এমডিজি সফলভাবে বাস্তবায়নের পর এখন এসডিজি সফলভাবে বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে দেশের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তা অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাঁর সরকার ‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ পরিকল্পনার অনেক কর্মসূচী ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজকের এই সম্মেলনে ডেল্টা প্ল্যান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটি বাস্তবায়নের পথ আরও সুগম হবে।