কাজিরবাজার ডেস্ক :
পাসপোর্টে ভুল দু’রকম হয়। প্রথমত, আবেদনপত্রে গ্রাহকের ভুল। দ্বিতীয়ত, গ্রাহক ঠিক থাকলেও অফিসের ভুল। ভুল যে কারণেই হোক, দায়ভার চাপানো হয় গ্রাহকের ওপর। টাকা গচ্চা যায় গ্রাহকেরই। পাসপোর্ট অফিসের ভুলের দায় অফিস নিচ্ছে না। এতে ভোগান্তির শিকার এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে অনেককেই। রাজধানীর আগারগাঁওসহ দেশের প্রতিটি পাসপোর্ট অফিসেই এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। পাসপোর্ট অফিসের ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে আবেদনকারী বা গ্রাহককেই। ভুলের সংখ্যা অবশ্য আগের চেয়ে অনেকটাই কমে আসছে বলে দাবি করছেন পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন।
তিনি জানিয়েছেন, এক সময় হাতে লিখে পাসপোর্ট দেয়া হতো। তখন গ্রাহক ও অফিস উভয়ের কারণেই ভুল হতো। তারপর এসেছে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি)। তখনও কিছু ভুল-ভ্রান্তি হতো। এখন হচ্ছে ই-পাসপোর্টের যুগ। সব কাজই করেন আবেদনকারী নিজে। তিনি যেভাবেই আবেদন করেন, ঠিক হুবহু সেভাবেই প্রিন্ট হয় বই। এখানে ভুল হওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও ভুল হয়েই যায়, তবে সেটা হাজারে একটা বা দুটা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাতের লেখার যুগ, এমআরপির যুগ পেরিয়ে বর্তমানে ই-পাসপোর্টের যুগে প্রবেশ করলেও ভুল থেকেই যাচ্ছে। গ্রাহকের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, নতুন পাসপোর্ট করতেও যত লাগে, ভুল সংশোধন করতেও ততই লাগে। এক পয়সাও কম নেয়া হয় না। কোন দেশেই এমন নিয়ম নেই। সবচেয়ে বেশি ভুল হয় আগের পাসপোর্ট ও এনআইডির মধ্যে মিল না থাকায়। নতুন নিয়মে পুরনো পাসপোর্টে বিদ্যমান নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম এবং জন্ম তারিখ পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদফতর এ সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি তৈরি হচ্ছে এখানে।
অনেকেরই দেখা যাচ্ছে, পুরনো পাসপোর্টের নামের সঙ্গে এনআইডির নাম মিলছে না। জন্ম তারিখের তারতম্য ঘটছে। তখন এনআইডি অনুযায়ী পাসপোর্টের নাম সংশোধন না করে বলা হচ্ছে, এনআইডি সংশোধন করার জন্য। এনআইডি সংশোধন করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পাড়তে হচ্ছে গ্রাহককে। আবার এনআইডি সংশোধন করে আনার পরও সেটা গ্রহণ করা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সংশোধিত এনআইডির পরিচয়পত্র আকারে কপি চাওয়া হচ্ছে। অথচ, সার্ভারে কিন্তু এনআইডি সংশোধিত আকারে আছে। আবার এসব সংশোধন করতে গিয়ে এতসব কাগজপত্র জোগাড় করতে বলা হচ্ছে যে, সেসব জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
কাগজ জোগাড় করতে আদালত পর্যন্ত যেতে হচ্ছে। এর একটা সুরাহা হওয়া উচিত। এনআইডি থাকার পর এত কাগজপত্রের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, তা পুনরায় বিবেচনা করা দরকার। পাসপোর্ট পেতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হয় সাধারণ মানুষ। অথচ, তারাই দুর্ভোগের শিকার হয়ে বাড়তি টাকা দিয়ে পাসপোর্ট করে বিদেশে গিয়ে দেশের জন্য মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছে। তাই এই সাধারণ মানুষের পাসপোর্টপ্রাপ্তি সহজ ও হয়রানিমুক্ত করার জন্য আলাদা সেল করা উচিত বলে মনে করছেন অনেকে।
গত সপ্তাহে আগারগাঁও অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে হাসান নামের এক দালাল নিজেকে গ্রাহক দাবি করে জানিয়েছেন, পাসপোর্টের আবেদন করতে যতটা ভোগান্তি, সংশোধন করতেও ততটাই ভোগান্তি। প্রবাসীদের জন্য এটা আরও বেশি। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও একই সমস্যা। আগের পাসপোর্টের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের মিল না থাকায় দেরি হচ্ছে পাসপোর্ট পেতে। আর দেরিতে পাসপোর্ট পাওয়ায় অনেকেরই ভিসা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। বৈধতার সুযোগ পেয়েও শুধু যথাসময়ে পাসপোর্ট না পাওয়ায় অবৈধই রয়ে যাচ্ছেন অনেকে। ইতালি, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশেও এই সমস্যা।
মাহমুদ নামের অপর এক আবেদনকারীর অভিযোগ, তার পাসপোর্টে একটা ‘ইউ’-এর স্থলে ‘ও’ ছাপা হয়ে গেছে। অফিসের ভুলের দায়ভার এখন তাকে নিতে হচ্ছে। এই ভুল করার কথা স্বীকারই করছে না পাসপোর্ট অফিস। এমনকি, আনুষ্ঠানিকভাবে এ অভিযোগ করারও কোন সুযোগ নেই এই অফিসে। বাধ্য হয়েই তাকে নতুন করে অনলাইনে ফর্ম পূরণ করে আগের মতোই ফি জমা দিয়ে সংশোধন করতে হয়েছে পাসপোর্ট।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, মাহমুদের মতো এমন শত শত ভুক্তভোগীর দেখা মিলে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে। তাদের একজন মনসুর আলী বলেন, ‘খেসারত শূুুধু একমুখী নয়। একদিকে তাদের ভুলও তারা স্বীকার করে না, দায়ও নেয় না। আবার সংশোধন করতে গেলেও টাকা লাগছে নতুন পাসপোর্টের মতোই। অর্থাৎ ছোট্ট একটা অক্ষরের ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে, নতুন করে পাসপোর্ট পাওয়ার মতোই ভোগান্তিতে। এটা যে, কারও কাছে গিয়ে নালিশ জানিয়ে প্রতিকার চাইব, সে সুযোগও নেই সাধারণ মানুষের জন্য। যারা নামী-দামী ভিআইপি-সিআইপি তারা গিয়ে তো সরাসরি ভেতরে ঢুকে কর্তাদের টেবিলে বসেই সব ঠিক করে নেয়। যত ভোগান্তি সব আমার মতো পাবলিকের।’
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, পাসপোর্টের ভুল যে ধরনেরই হোক না কেন, সেটা সংশোধন করা আর নতুন করে পাসপোর্ট করার পদ্ধতি একই। এ সম্পর্কে পাসপোর্ট অফিসের কর্তাদের ভাষ্য, পাসপোর্ট হয়ে যাওয়ার পরও বিভিন্ন সময় ভুল থাকতে পারে। আবার অনেকে হয়তো সঠিকভাবে তথ্য না দেয়ার কারণেও ভুল হতে পারে। তবে, যেভাবেই ভুল হোক না কেন- তা সংশোধনও করা সম্ভব। পাসপোর্টে কোন ধরনের তথ্য সংশোধন বা পরিবর্তন করতে চাইলে পাসপোর্টটি রি-ইস্যুর জন্য আবেদন করতে হবে। তবে, পুরনো পাসপোর্টে বিদ্যমান নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম এবং জন্ম তারিখ পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই।
বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদফতর এ সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে। জন্ম তারিখ সংশোধন করার জন্য ভোটার আইডি কার্ড, এসএসসির সার্টিফিকেট অথবা জেএসসির সার্টিফিকেট, ভোটার আইডি কার্ডের সঙ্গে জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে থাকলে অনলাইন কপি, বিবাহিত হলে নিকাহনামা- এগুলো প্রয়োজন হবে পাসপোর্টের জন্ম তারিখ সংশোধনের জন্য। আর জন্ম তারিখ সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত হলে সংশোধন করতে পারবেন। পাসপোর্টে বাবা-মায়ের নাম সংশোধন করার জন্য ভোটার আইডি কার্ড, এইচএসসি অথবা এসএসসির সার্টিফিকেট, বাবা-মায়ের ভোটার আইডি কার্ডের কপি লাগবে।
পাসপোর্টের মধ্যে কেউ যদি পেশা পরিবর্তন করতে চান, তবে দিতে হবে কর্মক্ষেত্রের প্রত্যয়নপত্র। আর এর সঙ্গে জমা দিতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্রের ফটোকপি। কেউ যদি স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করতে চান, সে ক্ষেত্রে আবার নতুন করে পুলিশ প্রতিবেদন লাগবে। তবে, বর্তমান ঠিকানা পরিবর্তন করার জন্য বা সংশোধনের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোন নিয়ম নেই। যদি বৈবাহিক অবস্থা পরিবর্তন করতে চান, তাহলে পাসপোর্টের আবেদনপত্রের সঙ্গে নিকাহনামা দিতে হবে। আবেদনপত্র জমার পর জরুরীভিত্তিতে ৭ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পেতে চাইলে ৬ হাজার ৯শ’ টাকা ফি জমা দিতে হবে। ২১ দিনে অর্থাৎ সাধারণ সময়ে পাসপোর্ট পেতে ফি দিতে হবে ৩ হাজার ৪শ’ ৫০ টাকা। সোনালী ব্যাংকের পাশাপাশি ওয়ান ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, প্রিমিয়ার ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকে এই ফি জমা দেয়া যায়।
ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে প্রথমেই ব্রাউজার ওপেন করে সার্চ করে পাসপোর্ট সংশোধন ফর্ম বা পাসপোর্ট সংশোধন-সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনটি লিখে সার্চ করার পর প্রথমে যে ওয়েবসাইট আসবে, ওই ওয়েবসাইটে ঢুকে পাসপোর্ট সংশোধন ফর্ম ডাউনলোড করে নিতে হয়। এই ফর্মটির সবকিছু সঠিকভাবে পূরণ করতে হয়। তারপর পাসপোর্ট সংশোধনের আবেদন ফর্মের এই বক্সের মধ্যে যেই ব্যাংকে জমা দেয়া হবে, সেই ব্যাংক থেকে একটি চালান বা রিসিট নিয়ে এবং এখানে ফি তথ্য বসাতে হয়। তারপর এই আবেদন ফর্ম এবং অন্যান্য সব ডকুমেন্ট একসঙ্গে নিয়ে পাসপোর্ট অফিসে জমা দিলে ২১ দিনের মধ্যে গ্রাহকের মোবাইল নাম্বারে মেসেজ যায় সংগ্রহ করার।
এ প্রসঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলছেন, এখন ই-পাসপোর্টের আবেদন অনলাইনে পূরণ করতে হয় আবেদনকারীকেই। সেটা অনলাইনে জানিয়ে দেয়া হয় স্বাক্ষর করার জন্য। তারপর ছবি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট তোলা হয় পাসপোর্ট অফিসে। এখানে সবই হয় ডিজিটাল সফটওয়্যারে। আবেদনকারী যেভাবে যে তথ্য দেন, সেভাবেই প্রিন্ট করা হয় পাসপোর্ট। এমনকি, সেটা ছাপার আগে আবেদনকারীকে ডেকে নিয়ে নমুনাও দেয়া হয়, যাতে কোন ভুল-ত্রুটি থাকলে সেটা সংশোধন করে দেয়া যায়।
সংশোধনের অপশন তো পাসপোর্ট প্রিন্ট হওয়ার আগেই আবেদনকারীকে দেখা ও যাচাই-বাছাই করার সুযোগ দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে তো ভুল হওয়ার সুযোগ থাকে না। যদি হয়েও থাকে, সেটা হাজারে একটা কি দুটো হতে পারে। আগের মতো অর্থাৎ হাতে লেখার সময় বা এমআরপির মতো এত ভুল হয় না এখন। কাজেই ভুক্তভোগীদের অভিযোগ সব সঠিক নয়। হ্যাঁ ভুল হয়, সেটা আবেদনকারীর ভুল পূরণের জন্যই। এ দায়তো অফিস নেবে না।
প্রবাসীদের পাসপোর্ট ভোগান্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশে-বিদেশে যেখানেই হোক- পাসপোর্ট তৈরিতে এখন প্রধান ডকুমেন্ট জাতীয় পরিচয়পত্র। তথ্য জটিলতার কারণেই দেরি হচ্ছে পেতে। ইউরোপে যারা আছেন, তারা একটা নাম দিয়ে পাসপোর্ট করে আগে নিয়ে গেছেন, কিন্তু তার দেশের সম্পত্তি বা সবকিছু অন্য নামে।
১৮ বছর পর সবাইকে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী পাসপোর্ট করতে হবে। দেখা যাচ্ছে পরিচয়পত্র হয়েছে এক নামে, আর পাসপোর্ট করা হয়েছে অন্য নামে। এখন রিনিউ করার সময় জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী দিলে তিনি পাসপোর্ট পাচ্ছেন না। অথচ পাসপোর্ট হয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী। এই সমস্যা কিভাবে সমাধান করা যায়, সেটা নিয়েও কাজ চলছে। অর্থাৎ গ্রাহকের কল্যাণ নিশ্চিত করাই আমাদের কাজ।