কাজিরবাজার ডেস্ক :
সম্প্রতি বন্যাকবলিত পাকিস্তানের দশা সচক্ষে দেখতে দেশটিতে গিয়েছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সেখানকার পরিস্থিতি দেখে রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে যান তিনি। বলেছিলেন, এই দুর্দশা ‘ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়’।
তারপরও সংখ্যা দিয়ে অন্তত বিপর্যয়ের ন্যূনতম মাত্রা বোঝানো যেতে পারে। পাকিস্তানে এবারের বন্যায় ১ হাজার ৪৪০০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৩ কোটি ৩০ লাখের বেশি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ১৭ লাখ ঘরবাড়ি। দেশটির তুলা ফসলের অর্ধেক ভেসে গেছে এবং এ বছরের গম উৎপাদনও অনেকটা কমে যেতে পারে। সরকারের ধারণা, বন্যার কারণে পাকিস্তানের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলার (জিডিপির নয় শতাংশ) ছাড়িয়েছে।
পাকিস্তানি কর্মকর্তারা এরই মধ্যে ধনী দেশগুলোকে সাহায্য করার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে সেটি শুধু পরোপকারের জন্য নয়। তাদের যুক্তি, ওই দেশগুলোর কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন পাকিস্তানে এমন বিপর্যয়ের জন্য আংশিকভাবে দায়ী।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন প্রজেক্ট (ডব্লিউডব্লিউএ) প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতাই সম্ভবত ভারি বৃষ্টিপাত বাড়িয়ে দিয়েছে, যার কারণে বন্যা হয়েছে।
বন্যা ও বিস্তৃত জলবায়ু প্রবণতাগুলোর মধ্যে প্রথম যোগসূত্র হলো সামগ্রিক তাপমাত্রা। গত এপ্রিল ও মে মাসে পাকিস্তান এবং প্রতিবেশী ভারতের ওপর দিয়ে একটি ভয়ংকর তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। ডব্লিউডব্লিউএ’র আগের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় এ ধরনের বিরূপ তাপমাত্রাকে অন্তত ৩০ গুণ নিয়মিত করে তুলেছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।
এছাড়া বাতাস গরম হয়ে উঠলে তখন সেটি আরও বেশি আর্দ্রতা গ্রহণ করে, যা ভারি বৃষ্টির আশঙ্কা বাড়ায়। এই আগস্টে পাকিস্তানে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল গত ৩০ বছরের গড়ের চেয়ে তিনগুণ বেশি। নানা তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে ডব্লিউডব্লিউএ’র বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, জলবায়ু যদি এরই মধ্যে ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণ না হতো, তাহলে এ বছরের সবচেয়ে ভারি বৃষ্টিপাতগুলো অন্তত ৫০ শতাংশ কম তীব্র হতো।
আশঙ্কার আরেকটি কারণ, পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৭ হাজার ২০০টি হিমবাহ অতীতের তুলনায় দ্রুত গলছে, যার জন্য দায়ী মূলত গ্রিনহাউস-গ্যাস। হিমালয়ের অন্যান্য হিমবাহের সঙ্গে এগুলোকে একত্রে ‘তৃতীয় মেরু’ নামে অভিহিত করা হয়। কারণ দুটি মেরু অঞ্চলের বাইরে বিশ্বের বৃহত্তম বরফের ভাণ্ডার রয়েছে এখানে।
গত জুন মাসে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের তাপমাত্রা প্রতি দশকে ০.৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, যা বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। বিভিন্নভাবে বায়ুদূষণও হিমবাহ গলে যাওয়ার হারকে ত্বরান্বিত করেছে। কালো কণাগুলো বরফের ওপর পড়লে এর পৃষ্ঠতলও কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে, যার ফলে হিমবাহগুলো আরও বেশি সূর্যালোক শোষণ করে এবং দ্রুত গলতে থাকে।
এসবের ফলস্বরূপ গবেষকরা অনুমান করেছেন, ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে উত্তর পাকিস্তানে বরফের আচ্ছাদন প্রতি বছর ৪ দশমিক ৬ গিগাটন (এক গিগাটন প্রায় ১৮ লাখ অলিম্পিক সুইমিং পুলের সমতুল্য) সংকুচিত হয়েছে। ২০২২ সালে বরফ গলার সঠিক পরিমাণ এখনো হিসাব করা হয়নি।
যাই হোক, গিলগিট-বাল্টিস্তানের উত্তরাঞ্চলের হিমবাহী হ্রদগুলো থেকে এ বছর ১৬বার আকস্মিক পানি উপচেপড়ার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে সাম্প্রতিক অতীতে প্রতি বছর মাত্র পাঁচ বা ছয়বার এ ধরনের ঘটনা দেখা যেতো। এটি স্পষ্টতই দ্রুত বরফ গলে যাওয়ার লক্ষণ।
দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ প্রধান নদীর উৎস তৃতীয় মেরুর হিমবাহ। এটি গলে যাওয়ার পাশাপাশি বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের জলপথগুলো ফুলেফেঁপে উঠেছে। ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের বৃহত্তম নদ সিন্ধুর ওপরের অংশে পানিপ্রবাহ প্রতি দশকে ৩ দশমিক ৯ গিগাটন বৃদ্ধি পেয়েছে।
অদূর ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি আশাব্যঞ্জক জলবায়ু পরিস্থিতিতেও ২১০০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প স্তরের চেয়ে সর্বোচ্চ দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে এই শতাব্দীতেই হিমালয়ের এক-তৃতীয়াংশ বরফ বিলীন হয়ে যেতে পারে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ অঞ্চলের দরিদ্র দেশগুলো। বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে অবদান খুব সামান্য হলেও বড় ক্ষতিটা হবে তাদেরই।