সিলেটে দিনভর ভোগান্তিÍর পর রাতে পরিবহন ধর্মঘট স্থগিত ॥ যাত্রীদের পকেট কাটলো রিক্সাচালক ও রাইডাররা

43
নগরীর পাঠানটুলায় জেলা পরিবহন শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ। ছবি- মামুন হোসেন

স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেটে দিনভর মানুষের ভোগান্তির পর গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রসাশনের আশ্বাসের ভিত্তিতে পরিবহন শ্রমিকদের ডাকা ৫ দফা দাবীর ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছেন আন্দোলনকারী পরিবহন শ্রমিক নেতারা। রাত ১০ টা পর্যন্ত রুদ্ধদার বৈঠকের পর এ কর্মবিরতি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এমন তথ্য সিলেট জেলা বাস মিনিবাস কোচ মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর রাজন নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে মঙ্গলবার রাত ৮টায় সিলেট সার্কিট হাউসে বিষয়টি নিয়ে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান, সিলেট জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি অধ্যাপক জাকির হোসেন ও ‘সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ’র নেতৃবৃন্দদের নিয়ে বৈঠক শুরু হয়। বৈঠক শেষে রাত ১০টায় শ্রমিক নেতারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
বৈঠক শেষে সিলেট জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মইনুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনের তরফ থেকে আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে আমাদের সব দাবি মেনে নেবেন। তাছাড়া এসএসসি পরীক্ষা ও দুর্গাপূজার কথা বিবেচনা করে ধর্মঘট স্থগিতের অনুরোধ জানানো হয়। আর আজ বুধবার ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে পুলিশি হয়রানি বন্ধ করবেন। তাই তাদের আশ্বাসের ভিত্তিতে আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মবিরতি স্থগিত করেছি। এ সময়ের মধ্যে দাবিগুলো পূরণ হবে আশাবাদী তিনি।
জানা গেছে, ট্রাফিক পুলিশের হয়রানিসহ ৫ দফা দাবী এনে পরিবহন শ্রমিকদের ৬টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ’ কর্মবিরতির ডাক দেয়। তবে সিলেটে ধর্মঘটের নামে নৈরাজ্য চালায় পরিবহন শ্রমিকরা। তারা দিনভর লাঠিসোটা হাতে নিয়ে সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে মারমুখী অবস্থান নিয়ে সব ধরনের যানচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। তাদের এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় নিরব ভূমিকায় ছিল প্রশাসন। গতকাল ভোর থেকে সড়কে অবস্থান নিয়ে ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচলেও জোর খাটায় শ্রমিকরা। তারা লাঠি হাতে নিয়ে চলাচল করা বিভিন্ন যানবাহনের গতিরোধ করে। মারমুখী অবস্থায় পরিবহন শ্রমিকরা সড়কে অবস্থান নিয়ে রোগীবাহি গাড়ি, চিকিৎসকের গাড়ি ও বিদেশযাত্রীদের গাড়িতেও বাধা দেয় তারা। প্রকাশ্যে লাঠিহাতে তাদের এমন অপতৎপরতা রুখতে প্রথমে দেখা না গেলেও শেষ বেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাস্তায় দেখা গেছে।
সিলেট নগরীর প্রবেশদ্বারগুলোতে লাঠিসোটা হাতে নিয়ে শ্রমিকদের অবস্থান করতে দেখা যায়। ব্যক্তিগত, স্কুল-কলেজ ছাত্র-ছাত্রী, পন্যবাহি, বিআরটিসি বাস, রোগি ও যাত্রীবাহি গাড়ি চলাচলেও বাধা সৃষ্টি করেন তারা। শ্রমিকদের পিকেটিংয়ের কারণে কেবল মোটরসাইকেল ও রিকশা ছাড়া সড়কে আর কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়নি। এদিন সিএনজি চালিত অটোরিক্সা বন্ধ থাকার পাশাপাশি দূর পাল্লার যানবাহনও নগরীতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ফলে দূর দূরান্তের যাত্রীরা ট্রেনেই ভরসা খোঁজে নেন।
ধর্মঘট চলাকালে বিআরটিসি বাসে হবিগঞ্জ থেকে সিলেট আসা লায়েক আহমদ বলেন, বাসটি নগরী প্রবেশের আগেই দক্ষিণ সুরমার চন্ডিপুলস্থ আব্দুস সামাদ আজাদ চত্বরে আটকে দেন শ্রমিকরা। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শ্রমিকরা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন আপত্তি নেই। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চলাচল করলে তারা বাধা দেবেন কেন? বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার পর ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়েও কোনো যানবাহন মিলেনি। তাই বেশ কিছু পথ হেঁটেই আসতে হয়েছে।
নগরীর শাহজালাল উপশহর এলাকার ব্যাংক কর্মকর্তা সাইমুম হোসেন বলেন, ব্যক্তি মালিকানার গাড়িতে (প্রাইভেট কার) করে সন্তানদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বের হলে শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়ি। শ্রমিকরা উপশহর পয়েন্টে আমার গাড়ি আটকে দিয়ে হামলার চেষ্টা করে। তখন গাড়িতে থাকা শিশু সন্তানরাও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। যথারীতি রাহাজানি শুরু করে শ্রমিকরা।
সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া আহমদ বলেন, সিলেটের বাইরের অনেক চালক কর্মবিরতির কথা জানেন না। তাই না জেনেই তারা গাড়ি বের করেছেন। তাদের বুঝাতেই শ্রমিকরা কয়েকটি মোড়ে অবস্থান নিয়েছে। তবে কাউকে জোর জবরদস্তি করা হয়নি। ব্যক্তিগত গাড়িও আটকানো হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আন্দোলনরত পরিবহন শ্রমিক নেতাদের নিয়ে রাতে বৈঠকে বসেছেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন।
তবে পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন, আলোচনা ও আন্দোলন একসঙ্গে চলবে। দাবি পূরণের সুনির্দিষ্ট আশ্বাস পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।
শ্রমিকদের পাঁচদফা দাবি হলো- ট্রাফিক পুলিশের হয়রানি, রেকারিং বাণিজ্য ও মাত্রাতিরিক্ত জরিমানা আদায় বন্ধ, মহানগর পুলিশ কমিশনার, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনারকে প্রত্যাহার। গাড়ি ফিটনেস মামলা সঠিকভাবে করা, সিলেট শ্রম আদালতে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে হয়রানি বন্ধ এবং আদালত থেকে শ্রমিক প্রতিনিধি নাজমুল আলম রোমেনকে প্রত্যাহার। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে বন্ধ পাথর কোয়ারি খুলে দিতে হবে। সিলেটের সব ভাঙা সড়ক সংস্কার এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশা বিক্রি বন্ধ করার পাশাপাশি অটোবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ডাম্পিং করা গাড়ি এবং অন্য জেলা থেকে আগত গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হবে। শ্রমিকনেতাদের অভিযোগ-দীর্ঘদিন থেকে এসব দাবি জানিয়ে আসলেও আশ্বাসের মধ্যেই আটকে আছে, একটি দাবিও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এদিকে, বিকেল ৩টা। দক্ষিণ সুরমার চন্ডিপুল থেকে সিলেট মহানগরীর জিন্দাবাজারে আসবেন এক বেসরকারি চাকরিজীবী। পরিবহন শ্রমিকদের কর্মবিরতি থাকায় রাস্তায় বেরিয়ে বিপাকে পড়েন মান্না মিয়া নামের ওই চাকরিজীবী। বাধ্য হয়ে চন্ডিপুলে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন মোটরসাইকেল রাইডারের সঙ্গে জিন্দাবাজার আসার জন্য আলাপ করলে কেউই ২০০ টাকার কম জিন্দাবাজার আসতে রাজি হননি। পরে অনেক দর কষাকষির পর ১৫০ টাকায় একজন রাইডার মান্নাকে জিন্দাবাজার নিয়ে আসেন।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত দিনভর সিলেটজুড়ে ছিলো এমনই চিত্র। পরিবহন শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিকে পুঁজি করে এভাবেই যাত্রীদের ‘পকেট কাটছেন’ বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেল রাইডাররা। সাধারণ মানুষের অভিযোগ- রাইডাররা এখন আর অ্যাপের মাধ্যমে যাত্রী বহন করেন না। চুক্তি করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যান। ভাড়া হাঁকেন স্বাভাবিকের চাইতে কয়েকগুণ বেশি। এ অবস্থায় রাস্তায় লোকজন জিম্মি হয়ে রাইডারদের হাঁকানো ভাড়াতেই গন্তব্যে পৌঁছেন। অপরদিকে, পরিবহন শ্রমিকদের কর্মবিরতিকে পুঁজি করে সিলেটে রাস্তায় বেরনো লোকজনকে জিম্মি করছেন রিক্সা চালকরাও। ১০ টাকার ভাড়ার জায়গায় তারা হাঁকছেন ৬০-৭০ টাকা। আর ২০ টাকার ভাড়ায় ১০০ টাকাও আদায় করছেন তারা যাত্রীদের কাছ থেকে। অভিযোগ রয়েছে- এসব ক্ষেত্রে প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না হয়রানির শিকার যাত্রীরা।