দুই বছর সাত মাসে রেল দুর্ঘটনায় নিহত ২১৯ জন, ৮৯ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সারা দেশে রেলপথের ওপর দিয়ে কোথাও কোথাও সড়ক চলে গেছে। আবার কোথাও শহরের ভেতর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন।
যে কারণে দুর্ঘটনার ঘটে অহরহ। এ ছাড়া রেললাইনের ওপর পরিকল্পনা ছাড়াই সড়ক নির্মাণে রেলওয়ে ও সড়ক নির্মাণকারী সংস্থার সমন্বয়হীনতায় বেড়ে চলেছে হতাহত।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছর জুলাই অব্দি রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২১৯ জন। রেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ৮৯ শতাংশই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে। যার সিংহভাগ দায় রেল কর্তৃপক্ষের। কারণে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ছোট একটি সতর্কীকরণ নোটিশ ঝুলিয়ে হয় দায় সারা। আবার বৈধ ক্রসিংয়ের গেটম্যানদের অবহেলা ও দায়িত্ব পেয়েও পালন করা করায় জনগণের হতাহতের ঘটনা ঘটে।
আড়াইবছরে মৃত্যু ২১৯ জনের
২০২০ থেকে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত লেভেল ক্রসিংয়ে ১১৬ টি দুর্ঘটনায় ২১৯ জন নিহত হয়েছেন। চলতি বছর ২৮ জুলাই পর্যন্ত ৩৫ দুর্ঘটনায় ৭৪ জন মারা গেছেন। ২০২১ সালে ৪৩ দুর্ঘটনায় ৭৬ জন ও ২০২০ সালে ৩৮ দুর্ঘটনায় ৬৯ জন মারা যান। এ বছর সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে চট্টগ্রামের মিরসারাইয়ে। নিহত হন ১১ জন।
গত ১৮ বছরে রেল দুর্ঘটনায় (২০০৫ সাল থেকে) ৬৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
রেলওয়ের ৪৮ শতাংশই ক্রসিং অবৈধ
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, দেশের ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথে ২ হাজার ৮৫৬ টি লেভেল ক্রসিং আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ ও এক হাজার ৩৬১টি অবৈধ। অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের হার ৪৮ শতাংশ।
পূর্বাঞ্চল রেলে মোট ১ হাজার ৩৭৭টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে, যার ৮১১টি অবৈধ। পশ্চিমাঞ্চলে আছে ১৪৭৯টি, যার ৫৫০টি অবৈধ।
৯৬১ টি ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই। এরমধ্যে বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে ৬৩২টিতে গেটকিপার নেই। সবমিলিয়ে দেশে ৮২ শতাংশ রেল ক্রসিংই অনিরাপদ।
সবচেয়ে বেশি অবৈধ লেভেল ক্রসিং নির্মাণ এলজিআরডি’র
অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) নির্মাণ করেছে ৫১৬টি। এছাড়া সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) ১১টি, ইউনিয়ন পরিষদ ৩৬৩টি, পৌরসভা ৭৯টি, সিটি করপোরেশন ৩৪টি, জেলা পরিষদ ১৩টি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৩টি, বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ১টি, জয়পুরহাট চিনিকল কর্তৃপক্ষ ১টি, ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান (বেসরকারি) ৩টি, অন্যান্য ৯২টি নির্মাণ করেছে।
৩৩টি লেভেল ক্রসিং কারা পরিচালনা করে, কোনো তথ্যই নেই রেলওয়ের কাছে। অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে যেমন গেটকিপার নেই, নেই কোনো সুরক্ষা সরঞ্জামও।
সমন্বয়হীনতায় বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ লেভেল ক্রসিং
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ যে সংস্থাগুলো অবৈধ লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করেছে তাদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে রেলওয়ের।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন উপ-পরিচালক (ট্রাফিক ট্রান্সপোর্টেশন) শওকত জামিল নওশের। যদিও এটাতে রেলের দায় দেখছেন না তিনি, বরং রেলের জমির উপর দিয়ে যারা রাস্তা নির্মাণ করেছে তাদেরকেই দায়ী করছেন তিনি।
উপ-পরিচালক শওকত জামিল নওশের বলেন, ‘রেল কারও জমি ব্যবহার করে না। যারা রেলের জমি ব্যবহার করে সড়ক নির্মাণ করছে তাদের উচিত রেলওয়েকে অবহিত করা। তারা রেলকে অবহিত করলে গেটম্যান দেওয়া, ব্যারিকেড স্থাপন করতে রেলওয়ে উদ্যোগ নিতো। ’
সমন্বয়হীনতা রোধে ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেখানে স্থানীয় সরকার এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটিকে রেলওয়েতে অরক্ষিত (রেল হেটবিহীন) বৈধ-অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা নির্ধারণসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এরপরেও দেশে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয় বন্ধ হয়নি। ফলে কমছে না রেল দুর্ঘটনাও।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, সড়কের সঙ্গে রেলের কোনো সমন্বয় নেই। শুধু যে লেভেল ক্রসিং ঝুঁকিপূর্ণ তা নয়। রেল লাইনের আশপাশের এলাকাও ঝুঁকিপূর্ণ। পাহারাদার ছাড়া কোনো লেভেল ক্রসিং রাখার কোনো সুযোগ নেই। রেল লাইনের পাশে ৩ ফুট করে খুঁটির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নগরায়নের জন্য রেল লাইনের প্রতি কিলোমিটারের মধ্যে একটি করে লেভেল ক্রসিং তৈরি হয়ে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একাধিক প্রকৌশলী জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের লিখিত নির্দেশনা না থাকায় অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। মূলত কেউ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। এতে লেভেল ক্রসিংগুলোয় দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে।
দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব পদক্ষেপের জরুরি
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান ও গেটবারের ব্যবস্থা না করা, বৈধ লেভেল ক্রসিংসমূহে গেটম্যানদের দায়িত্বে অবহেলা ও গেটম্যান হিসেবে লোকবলের সঙ্কট, দুর্ঘটনায় দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া ও রেলপথ ব্যবস্থাপনায় আইনের শাসনের অভাব। যানবাহনের চালক ও সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতা ও অধৈর্য মানসিকতাও দায়ী বলে মনে করেন সাইদুর রহমান।
দুর্ঘটনা এড়াতে সব রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান নিয়োগ ও উপযুক্ত গেটবারের ব্যবস্থা করা, লেভেল ক্রসিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার করা, জনবল সঙ্কট নিরসন করে রেলপথ ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করা, সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানোর সুপারিশ করেছেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক।