চা শ্রমিক আন্দোলনে বাইরে থেকে ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ এক পক্ষের অপর পক্ষের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা

4
৩শ’ টাকা মজুরির দাবিতে চা শ্রমিকদের প্রতিবাদ অব্যাহত। ছবি- মামুন হোসেন

কাজিরবাজার ডেস্ক :
চা শ্রমিকের আন্দোলনে ইন্ধন দেয়া হচ্ছে। শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনকে পুঁজি করে তৃতীয় পক্ষ ফায়দা হাসিলের তৎপরতা চালাচ্ছে। অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। চা শ্রমিকদের আন্দোলনে বাইরে থেকে উসকানি দেয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা। রবিবার দুপুরে সিলেট মহানগরীর লাক্কাতুরা চা বাগানের সামনে শ্রমিকদের আন্দোলনের সময় সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। এদিকে, শান্ত পরিবেশ বজায় রেখে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া চা শ্রমিকদের মুখে ‘চরমপন্থামূলক’ স্লোগান কিভাবে জায়গা পেল, তা নিয়ে খোদ চা শ্রমিক নেতারাও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। সুশৃঙ্খল আন্দোলনকে বিশৃঙ্খল করে সংঘাত বাধাতে বাইরে থেকে কেউ ইন্ধন দিচ্ছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন একাধিক শ্রমিক নেতা। একাধিক শ্রমিক নেতা বলছেন ‘প্রধানমন্ত্রী যেখানে আশ্বাস দিয়েছেন, সেখানে আন্দোলন স্থগিত করাটাই ছিল সবচেয়ে উত্তম।
কিন্তু আমরা স্থগিত করতে চাইলেও কোন একটি পক্ষ তা চাইছে না। এখানে বাইরের ইন্ধন ঢুকে গেল কি-না, তা নিয়ে আমরা এখন শঙ্কায় পড়ে গেছি। এখন শ্রমিকরা নিজেদের দাবি আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠছেন।
রবিবার বিভিন্ন স্থানে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা। নিজেদের গায়ে ‘চরম উক্তি’ উল্লেখ করে শ্লোগানও লিখেছেন। ‘৩০০ টাকা মজুরি দে, নইলে বুকে গুলি দে’ শ্লোগান দেখা গেছে। সিলেট শহরতলির লাক্কাতুরা এলাকায় চা শ্রমিকদের বিক্ষোভে এমন শ্লোগান ছিল শ্রমিকদের মুখে। এ ছাড়া ‘বাঁচার মতো বাঁচতে চাই, ৩০০ টাকা মজুরি চাই’ ‘জাগো রে জাগো, চা শ্রমিক জাগো’ ‘২০-৩০ মানি না, ৩০০ না হলে বুঝি না’ প্রভৃতি শ্লোগানও দেয় চা শ্রমিকরা। বেশ কিছু যুবকের গায়ে এমন শ্লোগান লেখাও ছিল। একপর্যায়ে শ্রমিকরা বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করেন। এতে সড়কের উভয় পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। পরে জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরীর আশ্বাসে দুপুর দেড়টার দিকে শ্রমিকরা অবরোধ থেকে সরে যান।
শ্রমিক নেতা রাজু গোয়ালা বলেন, ৩০০ টাকা মজুরির পক্ষে আমি একমত। তবে শোকের মাসকে সম্মান জানিয়ে আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছিলাম। এ ছাড়া আমাদের আন্দোলনে বাইরে থেকে বিভিন্ন সংগঠন ঢুকে পড়েছে। যদি কোন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়, অরাজকতা, ভাংচুর বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়, তবে তার দায়ভার চা শ্রমিক সংগঠনের নেতা হিসেবে আমি নেব না। শান্তিপূর্ণভাবে দাবি আদায় করতে হবে। আমাদের চা শ্রমিকদের বাইরে থেকে উসকানি দেয়া হচ্ছে, যার ফলে রাস্তাঘাটে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করছেন শ্রমিকরা। আমি এর পক্ষে নই।
১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সিলেটসহ সারাদেশের চা শ্রমিকরা গত ৯ আগষ্ট থেকে আন্দোলনে নেমেছেন। ৯ থেকে ১১ আগষ্ট পর্যন্ত তারা ২ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালনের পর ১৩ আগষ্ট থেকে আজ পর্যন্ত তারা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালন করছেন।
আন্দোলন থামাতে শ্রম অধিদফতরের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হলেও সমাধান আসেনি। সর্বশেষ ২০ আগষ্ট শ্রীমঙ্গলের শ্রম অধিদফতরের আঞ্চলিক অফিসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মজুরি ২৫ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। তাতে শ্রমিক নেতারা আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। কিন্তু বেঁকে বসেন সাধারণ চা শ্রমিকরা। অচলাবস্থা কাটাতে শনিবার রাতে সিলেট ভ্যালির শ্রমিক নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন জেলা প্রশাসক। বৈঠকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করার আহ্বান জানানো হয় চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দের প্রতি। সে আহ্বান মেনেও নেন স্থানীয় চা শ্রমিক নেতারা।
দফায় দফায় সিদ্ধান্ত বদল করে ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন চা শ্রমিকরা। ৩০০ টাকা মজুরির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন তারা। শনিবার মধ্যরাতে এক ভিডিও বার্তায় আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, শনিবার বিকেলে শ্রম অধিফতরের সঙ্গে আমরা বৈঠকে বসি। সেখানে আমাদের মজুরি ২৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয় এবং প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর শেষে ফিরে আমাদের সঙ্গে বসবেন জানিয়ে আমাদের ধর্মঘট প্রত্যাহারের অনুরোধ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সম্মান জানিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেই। তবে আমি কোন চুক্তিতে স্বাক্ষর করিনি। তিনি বলেন, বৈঠক শেষে বেরিয়ে আমি সাধারণ চা শ্রমিকদের ক্ষোভ আঁচ করতে পারি। তারা ২৫ টাকা মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান। আমরাও তাদের সঙ্গে একমত। তাই আমি আমার আগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।
এর আগে বিকেলে শ্রম অধিদফতরের সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে নিপেন পাল বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করছি। আমাদের মজুরি ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর থেকে এসে আমাদের সঙ্গে বসবেন বলে জানিয়েছেন। সেখানে আমাদের দাবি-দাওয়া তাকে জানানো হবে।
বৈঠক শেষে শ্রমিক নেতারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানানোর পরই ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাধারণ চা শ্রমিকরা। এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। তারা ২৫ টাকা মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ারও ঘোষণা দেন তারা। এ সময় নেতাদের বিরুদ্ধেও বিষোদ্গার করেন শ্রমিকরা।
মৌলভীবাজার : রুটি-রুজির সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মৌলভীবাজারের চা শ্রমিক নেতারা। একই সঙ্গে কর্মবিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচীও চালিয়ে যাবেন বলে জানান তারা। রবিবার দুপুরে আন্দোলন চলাকালে এমনটাই জানিয়েছেন আন্দোলনরত চা শ্রমিকরা।
হবিগঞ্জ : ১৪৫ টাকা মজুরি প্রত্যাখ্যান করে চা শ্রমিকদের একাংশ ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী রবিবার ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন হবিগঞ্জের ২৪টি চা বাগানের শ্রমিকরা।