কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশজুড়ে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় (বুস্টার) ডোজের টিকা কার্যক্রম চলছে। পাশাপাশি প্রথম ডোজের টিকাদান চললেও তা খুবই সীমিত আকারে। তবে আগামী নভেম্বর মাসের পর প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের জন্য সংরক্ষিত টিকার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এরপর শুধু বুস্টার ডোজের কার্যক্রমই চলমান থাকবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
কিন্তু এখনও টিকার আওতার বাইরে রয়েছে ৩৩ লাখ মানুষ। যারা প্রথম এবং দ্বিতীয় কোন ডোজের টিকাই নেননি। শুধু তাই নয় দ্বিতীয় ডোজের টিকা নেয়নি আরও প্রায় ১ কোটি মানুষ। এমন অবস্থায় দুই কোটি ডোজ টিকা মজুদ আছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাতে। যেগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে নবেম্বরে। এরপর এসব টিকা মেডিক্যাল বর্জ্য ছাড়া কিছুই বিবেচ্য হবে না। যদিও স্বাস্থ্য বিভাগ চেষ্টা করছে অন্য দেশগুলোতে টিকা উপহার বা রফতানি করার কিন্তু তেমন কোন দেশ বিশেষ আগ্রহী না হওয়ায় এসব বহুল কাক্সিক্ষত টিকার আধিক্যই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এত কষ্টে পাওয়া টিকা ফেলে না কাজে লাগাতে চায় সরকার তাই যারা এখনও টিকা নেয়ার বাকি রয়েছে তাদের দ্রুত টিকা নেয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। পাশাপাশি ইপিআই কার্যক্রমের মাধ্যমে টিকাকে গণমুখী করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের টিকা কর্মসূচীর সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডাঃ শামসুল হক বলেন, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত প্রচেষ্টায় ৩০ কোটি ডোজ টিকা আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছি। প্রথম, দ্বিতীয় এবং বুস্টার ডোজ মিলিয়ে আমরা এখন পর্যন্ত প্রায় ২৯ কোটি ডোজ টিকা দিতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের হাতে এখনও প্রায় দুই কোটি টিকা মজুদ আছে। তিনি বলেন, প্রথম ডোজের জন্য আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ কোটি ২৯ লাখ মানুষ।
এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও দ্বিতীয় ডোজের লক্ষ্যমাত্রা এখনও পূরণ হয়নি। এখনও প্রায় ১ কোটি মানুষ দ্বিতীয় ডোজের টিকার আওতায় সেখানে এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ পেয়েছেন ১২ কোটি ৯৬ লাখ মানুষ। যার ফলে এখনও প্রায় ৩৩ লাখ মানুষ প্রথম ডোজ টিকা নেয়নি। একইভাবে দ্বিতীয় ডোজ এবং প্রথম ডোজের মধ্যে আমাদের পার্থক্য প্রায় ৯৪-৯৫ লাখ। অর্থাৎ প্রথম ডোজ নিয়েছেন কিন্তু দ্বিতীয় ডোজ নেননি, এই মিলিয়ে হলো প্রায় সোয়া এক কোটি।
তিনি বলেন, আমাদের যারা এখনও টিকা গ্রহণ করেননি, তাদের টিকা কিন্তু আমাদের কাছে মজুদ আছে। আমরা সেই টিকা সংগ্রহ করে প্রত্যেকটা মানুষ যেন টিকা পায় সেটা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া আছে, হাসপাতালগুলো তৈরি আছে, টিকা কেন্দ্র তৈরি আছে।
কিন্তু এই প্রথম ডোজের ৩৩ লাখ এবং দ্বিতীয় ডোজের প্রায় ১ কোটি মানুষের জন্য যেই টিকা আছে, সেগুলোর মেয়াদ হলো নবেম্বর পর্যন্ত। এরপর সেগুলো আর দেয়া যাবে না। যেহেতু এখনও বড় একটা সংখ্যক মানুষ প্রথম ডোজ নেয়নি, সেক্ষেত্রে তাদের উচিত হবে এখনই প্রথম ডোজ নিয়ে নেয়া। নিলে আমাদের প্রথম ডোজ সেপ্টেম্বরে প্রায় শেষ হয়ে যাবে। এখন আমরা এই বিষয়টার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি।
করোনার ভয়াল অন্ধকার দিন যেন আজ অতীত। মাত্র ২ মাসের ব্যবধানে সংক্রমণ এখন নিয়ন্ত্রণে। মৃত্যু এবং সংক্রমণ কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি সম্ভব হয়েছে দেশজুড়ে টিকাদান কর্মসূচী জোরদার হওয়ার জন্য। প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে টিকাদান কর্মসূচী আজ সাফল্যের পথে। গত বছরের ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ডের এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাদান কর্মসূচীর উদ্বোধন করেন।
তারপর থেকে দেশজুড়ে টিকাদান কর্মসূচী চললেও ভারতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলে নিজেদের উৎপাদিত টিকার রফতানি বন্ধ করে দেয় দেশটি। এসময়টায় টিকার জন্য অন্য কোন দেশে যোগাযোগ না করায় বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচী মুখ থুবড়ে পরে। কিন্তু সরকারের নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতায় সঙ্কট কেটে টিকাদান কর্মসূচীতে মাইলফলক অর্জন করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। নিয়মিতভাবে পাওয়া যায় চীনের সিনোফার্ম, কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় এ্যাস্ট্রাজেনেকাসহ ফাইজার, মডার্নার টিকাও পেতে শুরু করে বাংলাদেশ।
লক্ষ্যমাত্রার অধিকাংশ মানুষকেই টিকার আওতায় আনা সম্ভব হলেও এক শ্রেণীর লোকজনের টিকা গ্রহণে খুবই অনীহা দেখা যাচ্ছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশে এখনও প্রথম, দ্বিতীয় ও বুস্টার ডোজ দেয়া হচ্ছে। কিছুদিন পর আর দ্বিতীয় ডোজ পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় ডোজের জন্য আমাদের কাছে যে পরিমাণ টিকা সংরক্ষিত আছে, সেগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তাই যারা এখনও টিকা নেননি, তারা দ্রুত টিকা নিয়ে নিন।
মন্ত্রী বলেন, আমরা সারাদেশে সফলভাবে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করছি। যার ফলে আমরা করোনা সংক্রমণকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। কিন্তু এখনও অনেকেই দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেয়নি। তাদের জন্য বলতে চাই, দ্বিতীয় ডোজ না নিলে কিন্তু তারা বুস্টার ডোজও পাবেন না। তাই, যারা এখনও প্রথম ডোজ, দ্বিতীয় ডোজ নেননি, দ্রুততম সময়ে তাদের টিকা নিয়ে নেয়ার অনুরোধ করছি। না নিলে কিন্তু পরে আর খুঁজেও পাবেন না। তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে করোনা সংক্রমণ আবারও বেড়েছিল। তবে, সেটি কমতে শুরু করেছে। চিকিৎসক-নার্সরা দারুণ কাজ করেছেন। নয়ত এমন ঘনবসতিপূর্ণ একটা দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতো। তাই সবার উচিত স্বপ্রণোদিত হয়ে টিকা নেয়া।
এমন অবস্থায় টিকা কেন গণমুখী করা হলো না এমন প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ বে-নজির আহমেদ নিবন্ধে বলেন, টিকায় বিশ্ব মুকুট প্রাপ্ত দেশ করোনা টিকাদানে কাক্সিক্ষত সাফল্য পাবে না, এটা আদৌ কাক্সিক্ষত নয়। পরীক্ষিত ক্লাস খেলোয়াড় ঘরের মাঠে মুখ থুবড়ে পড়বে, এটা মেনে নেয়া যায় না।
চার দশক ধরে নবজাতক শিশু-কিশোরী মায়েদের মন জয় করেছে ইপিআই কর্মসূচী। গাঁও গেরামের মানুষের করোনা টিকাদানে ব্যর্থতার কারণ আমাদের করোনা টিকাদান ক্রীড়ার জাতীয় কোচ, ব্যবস্থাপকদের ভুল কৌশল, ভুল পদ্ধতি নির্বাচন। সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড সক্ষম জাতীয় কর্মসূচী ইপিআইয়ের প্রতি এক ধরনের কালিমা লেপিত হলো এবং করোনা টিকাদান কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছতে ব্যর্থ হলো।