কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দ্বিতীয় দফা সংলাপের প্রথম দিনে আমন্ত্রিত চারটি দলের মধ্যে একটি দল যায়নি। সকাল সাড়ে ১০টায় আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) সঙ্গে মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে এ সংলাপ শুরু হয়। পরে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ও বাংলাদেশ কংগ্রেসের সঙ্গে পৃথকভাবে সংলাপ করে ইসি। তবে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) যায়নি। সংলাপ চলাকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ভোটের মাঠের সহিংসতা ইসি বন্ধ করতে পারবে না। আমাদের অনেক ক্ষমতা আছে। কিন্তু সহিংসতা প্রতিরোধে দায়িত্ব নিতে হবে রাজনীতিবিদদের। ভোটের মাঠে খেলোয়াড় হচ্ছেন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। আর ইসি হচ্ছে রেফারি। এদিকে একটি দল জাতীয় বাজেটে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বরাদ্দ দাবি করেছে।
সিইসি বলেন, আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনুকূল পরিবেশ চাই। নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে নির্বাচন কমিশন সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। তবে সব রাজনৈতিক দল সহযোগিতা না করলে আমরা ব্যর্থ হয়ে যাব। সরকার সহায়তা না করলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিণতি মন্দ হতে পারে। তবে ইসি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। তবে আমি বারবার বলেছি, রাজনৈতিক দল আর সরকার এক নয়। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। কিন্তু যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী তখন তিনি সরকারপ্রধান, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নন; এটি বুঝতে হবে।
আমরা সরকারের সাহায্য চাইব। সরকার যদি সহায়তা না করে, তাহলে নির্বাচনের পরিণতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে। আমরা নির্বাচন করতে চাই অনুকূল পরিবেশ ও শক্ত ভিত্তির ওপর। এজন্য সকলের সহায়তা কাম্য।
সংলাপে সভাপতির বক্তব্যে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমরা বহুবার বলেছি যে, সকল রাজনৈতিক দলের বিশেষত প্রধানতম দলগুলোর নির্বাচনে অংশ নেয়া খুবই প্রয়োজন। তবে আমরা কোন দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারব না। তবে সকল দলকে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে আমরা বারবার আহ্বান করে যাব। সে প্রচেষ্টা আমাদের অব্যাহত থাকবে। সকল দলকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে সিইসি বলেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা না থাকলে জনমতের সঠিক প্রতিফলন হয় না। পক্ষ-প্রতিপক্ষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা মাঠ পর্যায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সম্ভাব্য অনিয়ম, কারচুপি, দুর্নীতি, অর্থশক্তির বৈভব ও পেশিশক্তির প্রয়োগ ও প্রভাব বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। অন্যথায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমাদের প্রয়াস যতই আন্তরিক হোক, ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। সেটা আমাদের কাম্য নয়। তাই ইসি সকলের অংশগ্রহণ, সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করতে চায়।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, ভোটের মাঠে নিয়ম লঙ্ঘন করে কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ান, তাহলে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোকেও রাইফেল নিয়ে অথবা তলোয়ার নিয়েই প্রতিরোধ করার পরামর্শ দেব। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে কি করব? আমরা সাহায্য করব। পুলিশের ও সরকারের ওপর ইসির ‘কমান্ড থাকবে’। সিইসির এমন বক্তব্যের পর এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, আমরা কেউ শটগান নিয়ে আসতে পারি না। কারণ আইনে আমাদের শটগান নিয়ে দাঁড়ানো পারমিট করে না।
অন্য কেউ যদি পিস্তল নিয়ে আসে বা ১০০ মানুষ নিয়ে আসে, সেটা সরকারের পক্ষ থেকেই ট্যাকেল করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চয়তা দিতে হবে, প্রশাসন নিউট্রাল থাকবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে নির্বাচন কমিশন ও সরকারকেই। এ সময় ববি হাজ্জাজ আগের ২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট কারচুপির কথা উল্লেখ করে এ বিষয়ে বর্তমান ইসির দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জবাবে সিইসি বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাচ্ছি, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের দায় আমাদের ওপরে চাপাবেন না। আমরা আমাদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের দায়টা বহন করব। আমোদ-ফুর্তি করতে আমরা দায়িত্ব নেইনি। কঠিন দায়িত্ব নিয়ে এসেছি, কঠোর পরিশ্রম করছি।
সিইসি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক পরিম-লে নানাবিধ আশা, হতাশা ও তর্ক-বিতর্ক চলছে। বিতর্কগুলো নিরসন হওয়া প্রয়োজন। তাই কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা আগেও ক’টি উন্মুক্ত সংলাপ করেছি। এতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে। কমিশনের সক্ষমতা ও সাধ্যের সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা নির্দ্বিধায় তা স্বীকার করে নিয়ে কারণগুলো বারবার ব্যাখ্যা করে বলেছি। একটি মাত্র দল ৩০০টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে সাংবিধানিকভাবে কোনও বাধা নেই। তবে ইতিহাস বলেন সেক্ষেত্রে অচিরেই গণতন্ত্রের অপমৃত্যু হবে। স্বৈরতন্ত্র মাথা জাগিয়ে তুলবে। গণতন্ত্রের আরাধ্য পুনরুদ্ধার হয়ে পড়বে দুরূহ।
সিইসি বলেন, ইভিএম নিয়ে পাঁচ-সাতটি কর্মশালা করার পর নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এবং বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে উন্মুক্ত সভা করেছে। সেখানে কেউ কোন ত্রুটি দেখাতে পারেনি। ইভিএম এবং ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচনে তুলনামূলক সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আরপিও ২৬ অনুযায়ী, কারচুপির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো প্রতিপালন করা হলে কারচুপি প্রতিরোধ করা সম্ভব। এত কিছুর পরও ইভিএম নিয়ে অপপ্রচার চলছে। ইভিএম সম্পর্কে বিভ্রান্তি-সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
তাই আমরা উদ্বিগ্ন হচ্ছি কেন্দ্রে কেন্দ্রে অনিয়ম, সহিংসতা, ব্যালট পেপার ছিনতাই হলে প্রতিরোধ কতটা কিভাবে সম্ভব হবে? তাই আমাদের প্রত্যাশা, জাতীয় নেতারা ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে নিবিড়ভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা ও মতৈক্য হয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর নিরসন করে আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য অনুকূল পরিবেশ ও সমতল ভিত্তি সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া আমরা অরাজনৈতিক সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদেরও সহযোগিতা কামনা করছি। সবাই সংগঠিত হয়ে এগিয়ে এসে জাতির সঙ্কটময় মুহূর্তে তাদের প্রজ্ঞা ও জ্ঞান প্রয়োগ করে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সংলাপে আহ্বান করে আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক মতৈক্য সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারেন।
সিইসি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা খুবই প্রয়োজন। আমরা দেখছি একটি বড় ঐকমত্য একদিকে, আরেকদিকে সরকার। আমরা খুবই দ্বিধান্বিত হই যখন তাদের বক্তব্যগুলো সাংঘর্ষিক হয়। আমরা চাই সমঝোতা করে তারা সবাই এগিয়ে যাক।
তিনি বলেন, যেকোন পরিস্থিতিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশন পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। অনেকে হয়ত ভয় পাচ্ছে, নতুন করে সরকার হলে তার একটা শর্ত থাকবে এই নির্বাচন কমিশন। এজন্য আমি সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই- এখানে সামান্যতম কোন ভয়-ভীতি নেই। বলার আগেই পদ ছেড়ে দেব। যদি সত্যিই নতুন কোন যোগ্য নির্বাচন কমিশনের বিষয় আসে, তাহলে আমাকে আহ্বান করতে হবে না। আমি চাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য ও সমঝোতা। নির্বাচনের স্বার্থে যদি আমাকে পথ থেকে সরে যেতে হয়, তাহলে আমাকে রিকোয়েস্ট করতে হবে না। রিকোয়েস্ট করার আগেই চলে যাব।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমি সুস্পষ্ট করে বলতে চাইÑ আমরা ভবিষ্যতে চোর হব না ডাকাত হব সেটা এখনই বলতে পারব না। তবে আমরা এখনও অতটা অসৎ হয়ে পড়িনি। অনেক রাজনৈতিক দল বলছে, আমরা নাকি একটি নির্দিষ্ট দলের এজেন্ডা নিয়ে এসেছি। দলগুলো কারা সেটা আমি বলতে চাচ্ছি না। তবে আমরা বাক্স খুলে দেখেছি কোথাও এজেন্ডাটা নেই। আমরা এখনও অতটা অসৎ হয়ে পড়িনি। আমি সুস্পষ্ট করে বলতে চাইÑ কোন রকমের পক্ষপাতিত্ব বা কারও এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার মানসিকতা এখনও আমাদের ভেতরে জন্ম নেয়নি।
এদিকে ইসির সংলাপে অংশ নিয়ে এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পোলিং এজেন্ট ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। কারণ, বিগত কয়েকটি ভোটে আমরা দেখেছি নির্বাচনে সরকারী দলের প্রার্থীর এজেন্ট ছাড়া অন্য কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট ভোটকেন্দ্রে অবস্থান করতে পারে না। বিকল্প হিসেবে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ভোট দেয়ার গোপন কক্ষ ছাড়া বাকি এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনতে হবে। এই সিসিটিভির লাইভ ফুটেজ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের দেখার ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচনকালীন কমিশনকে জনপ্রশাসনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার দাবিও জানান ববি হাজ্জাজ।
সংলাপে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট( বিএনএফ) নেতারা বলেন, আমরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ইসিকে সহায়তা করতে চাই। আগামীতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বিএনএফ সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, আগামী দিনগুলোতে রাজনীতির হিসাবনিকাশ অনেক কঠিন হবে। তবে বিএনএফের প্রত্যাশা, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব পালনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে। এক্ষেত্রে বিএনএফ নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করতে প্রস্তুত আছে। সংবিধান সমুন্নত রাখতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি।
নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নিয়ে জাতীয় বাজেটে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য দশমিক ০২ ভাগ বরাদ্দ দাবি করেছে বাংলাদেশ কংগ্রেস। বাজেটের অর্থ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে দলগুলোর মাঝে সমহারে বণ্টনেরও দাবি করে এ দলটি। দলের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট রেজাউল হোসেনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপকালে ৯টি লিখিত দাবি পেশ করে।