কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, ওনারা ইভিএমের জন্য যে সংলাপ ডেকেছিল সেখানে আমরা যাওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি, তাই যাইনি। এবার ওনাদের চিঠি পেলে সংলাপের এজেন্ডা কী সেটা দেখে সিদ্ধান্ত নেবো। যদি মনে করি যাওয়ার দরকার তাহলে যাবো। আর মনে না করলে আমরা যাবো না।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইতোমধ্যে সংলাপের সময়সূচি ঘোষণা করেছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। তবে সংলাপে সব দলকে পাচ্ছে না কমিশন। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ তাদের সমমনা কয়েকটি দল সংলাপে না যাওয়ার বিষয়ে তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে। এর আগে, ইসি ইভিএম প্রদর্শনীতে নিবন্ধিত দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানালেও তাতে ৩৯টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে সাড়া মেলেনি ১১টির। ইভিএম প্রদর্শনীতে অংশ না নেওয়া দলগুলোর বেশিরভাগ ইসির সংলাপে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে। অবশ্য কমিশন আশা করছে, সকলেই সংলাপে অংশ নেবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনে তারা তৎপরতাও চালাবে।
দেশের সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপের লক্ষ্যে গত ৬ জুলাই সময়সূচি ঘোষণা করেছে ইসি। আগামী ১৭ জুলাই থেকে শুরু করে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ১১টি কার্যদিবসে ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। ৭ জুলাই থেকে দলগুলোকে চিঠি দেওয়া শুরু হয়েছে বলে ইসি থেকে জানানো হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে চারটি করে দলের সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিটি দলের জন্য ইসি একঘণ্টা করে সময় নির্ধারণ করেছে। অবশ্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে দুই ঘণ্টা করে।
এর আগে, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের শিক্ষাবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করে। এসব বৈঠকে আমন্ত্রিতদের বড় একটি অংশ ইসির ডাকে সাড়া দেয়নি। এছাড়া ইভিএম প্রদর্শনীর জন্য গত মাসে দেশের নিবন্ধিত ৩৯টি দলকে আমন্ত্রণ জানালেও তাতে বিএনপি ও তাদের জোটভুক্ত দলসহ ১১টি দল অংশগ্রহণ করেনি। ইভিএম প্রদর্শনীতে অংশ না নেওয়া অন্য দলগুলো হলো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি।
এদিকে বর্তমান কমিশন গঠনের আগে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ দেশের নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে ৩১টি দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণ পেলেও বিএনপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) অংশগ্রহণ করেনি। রাষ্ট্রপতির সংলাপে আমন্ত্রণ না পাওয়া বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) ও বাংলাদেশ কংগ্রেসের মধ্যে ওই সময় দুটি দল দলীয়ভাবে সংলাপে না যাওয়ার অবস্থান জানিয়েছিল। বিএনপিসহ ১৫টি দল ইসি গঠনে সার্চ কমিটিতেও কোনও নাম প্রস্তাব করেনি। অবশ্য বিএনপি আগের কমিশন গঠনের সময় নাম প্রস্তাব করেছিল। তাদের প্রস্তাবিত নামের থেকে মাহবুব তালুকদার কমিশনার হিসেবে নিয়োগে পেয়েছিল।
বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বর্তমান কমিশনের সংলাপে না যাওয়ার বিষয়ে অবস্থান জানালেও বিদায়ী কে এম নূরুল হুদা কমিশনের সংলাপে তারা অংশ নিয়েছিল। ওই কমিশনের সংলাপে দেশের নিবন্ধিত সব দলই অংশ নিয়েছিল। তবে তার আগের কাজী রকিব উদ্দিন কমিশনের সংলাপে বিএনপিসহ কয়েকটি দল অংশ নেয়। বিএনপির মূল ধারাটি অংশ নেয়নি দেশের ইতিহাসে অন্যতম সফল কমিশন হিসেবে পরিচিত এটিএম শামসুল হুদা কমিশনের সংলাপেও।
ইসির সংলাপে যাবে না বলে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে জানিয়েছে আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি। দলটির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট ছানোয়ার হোসেন তালুকদার বলেন, তারা ইসির চিঠি পেয়েছেন। তার আলোকে ইসি সচিবকে জবাবও দিয়েছেন। তারা সংলাপে যাবে না উল্লেখ করে বলেন, যেহেতু বর্তমান সরকারের অধীনে কোনও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, এজন্য তাদের গঠিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনও নির্বাচনে অংশ নেবো না। একই কারণে বর্তমান নির্বাচন সংক্রান্ত কোনও কর্মকাণ্ডে আমরা যাবো না। ইসিকে বিষয়টি আমরা জানিয়েছি।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এখনও ইসির আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পায়নি উল্লেখ করে দলটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক জানান, তারা গণমাধ্যম থেকে বিষয়টি জেনেছে। তবে যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্ত দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে। তবে অতীতের সংলাপের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বিগত কমিশনের সংলাপে আমরা অংশগ্রহণ করে ৩৩টি সুপারিশ দিয়েছিলাম। আমাদের-সহ কোনও দলের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। উন্নতমানের কাগজে সুপারিশগুলো দিয়ে একটি বই প্রকাশ করা ছাড়া কিছুই দেখা যায়নি। আর সামগ্রিক বিবেচনায় নতুন কথা কিছু বলার নেই। তারপরও দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবো।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম বলেন, আমরা এখনও নির্বাচন কমিশনের সংলাপের আমন্ত্রণ পাইনি, আমন্ত্রণ পেলে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাবো। অতীতে কমিশনের প্রতি আমাদের আস্থা ছিল না। সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সংলাপে যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবো।
বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এডভোকেট শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী বলেন, আমরা ২০ দলীয় জোটের শরিক। আমাদের জোটের প্রধান দল বিএনপি ইতোমধ্যে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে তারা বর্তমান ইসির কোনও সংলাপে যাবে না। কাজেই জোটের ঐক্যের স্বার্থে আমাদেরও যাওয়া হবে না। বিএনপি গেলে হয়তো আমরা যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতাম।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশন নিজেই বলেছে সার্বিক অবস্থায় সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। যে অবস্থা বিদ্যমান থাকায় বিগত দুটি সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। স্থানীয় সরকার পরিষদের কোনও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। এই অবস্থা দূর না করে কিছু রাজনৈতিক দলকে ডেকে আলাপ-আলোচনা করা, কথাবার্তা বলা, এটা নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কোনও কাজে লাগবে না। তাই আমরা তাদের কোনও সময় নষ্ট করতে চাই না।
সম্প্রতি দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের সংলাপে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। একমাত্র সংলাপ হতে পারে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন কীভাবে হবে, সেই আলোচনায়। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আওতায় এমন এখতিয়ার আছে কিনা, আমার জানা নেই।’
এদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ আশা প্রকাশ করেছেন সব দল ইসির সংলাপে সাড়া দেবে। ৯ জুলাই নির্বাচনি এলাকা কুষ্টিয়ায় গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনও কোনও সংকট তৈরি হয়নি। এখনও অনেক সময় আছে। যখন নির্বাচনি হাওয়া উঠবে, তখন সব দলই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। আশা করি সবাই নির্বাচনে অংশও নেবেন।
সংলাপ প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দেওয়া শুরু হয়েছে। অনেকেই ইতোমধ্যে চিঠি পেয়েছেন। পর্যায়ক্রমে অন্য দলগুলো তাদের সংলাপের নির্ধারিত তারিখের আগেই চিঠি পাবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনও দল সংলাপে আসবে না এমনটি আমাদের কেউ জানায়নি। তবে আমরা আশা করছি সকলেই সংলাপে অংশ নেবেন। যদি কোনও দল না আসে সেই দলের সংলাপটি বাদ থাকবে।
কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেন, সব দলকে আলোচনার টেবিলে বসানোর জন্য আমাদের চেষ্টা এবং সদিচ্ছার অভাব নেই। আপনারা দেখেছেন যে কোনও কোনও দল ইতিপূর্বে আমাদের ডাকে সাড়া দেয়নি। যদিও আমরা ব্যক্তিগতভাবেও যোগাযোগ করেছিলাম। ভবিষ্যতে যদি কোনও দল এই ডাকে সাড়া দিতে না চান বা না আসেন সত্যিকার অর্থে তাদের আনার চেষ্টা থাকবে। প্রয়োজনে আমি বা আমরা তাদের সাথে দেখা করতে পারি, টেলিফোনে কথা বলবো যে আসেন, দেখেন, সিদ্ধান্ত আপনাদের। একটি ফরমাল টেবিলে আপনাদের মতটা প্রকাশ করেন। এই অনুরোধটা করবো। সিইসির সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে, তিনিও ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ জানাবেন। তারপর উনাদের ব্যাপার।