কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বাজেট বাস্তবায়নে দেশবাসীর সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করে বলেছেন, দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্র, বাধা অতিক্রম করেই আমরা অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেছি। শত বাধা ও চাপের মুখে পড়লেও আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অনেক প্রতিকূল অবস্থায় আমাদের এগুতে হচ্ছে। কারণ এদেশের মানুষের মধ্যে এক অন্যরকম শক্তি আছে। যেটা যদি তারা বুঝতে পারে, অনুধাবন করতে পারে তখন শক্তিটা বুঝা যায়। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে যেটা প্রযোজ্য হয়েছে।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ সালের বাজেটের ওপর সমাপনি বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমার কাছে জনগণের শক্তিই হচ্ছে বড় শক্তি। আর যে কোন সঙ্কটে দেশের মানুষের পাশে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছিল এবং থাকবে। আর দেশের জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতা পেলে এই বাজেটও আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব, ইনশাআল্লাহ।
সরকার প্রধান তাঁর বক্তব্যে বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই সেতু আমাদের মর্যাদার প্রতীক। দেশের মানুষের আত্মপ্রত্যয় ও বীরত্বগাঁথার প্রতীক। জাতির পিতা ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন- ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’। আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনা অতিমারীর সময় যখন দেশের অনেক উন্নত দেশও তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে, আমরা তা সফলভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বিশ্বব্যাপী চলমান এই সঙ্কটের সময় দেশের মানুষকে মিতব্যয়ী হবার পাশাপাশি সঞ্চয়ের দিকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সবাইকে যতটুকু সম্ভব কৃচ্ছতা সাধন ও মিতব্যয়ী হতে হবে। সঞ্চয় করে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। সকল প্রকার অপচয় ও অপব্যবহার থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। সকলকে কৃচ্ছতা সাধন করে কিছু সঞ্চয় করে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সঞ্চয় বাড়ানোর মাধ্যমে জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে হবে, সকল প্রকার অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা পরিহার করে শুধু প্রয়োজনীয জিনিস কেনায় মনোযোগ দিতে হবে। সবকিছু ঢালাওভাবে ব্যবহার করা যাবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে জ্বালানী তেল, সারসহ বেশ কিছু পণ্যের জন্য সরকারকে বিপুল অঙ্কের টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, তবে সরকার তা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেবে না। তিনি বলেন, জাতির পিতার ডাকে দেশের মানুষ অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে বিজয়ী ছিনিয়ে এনেছিল। আমরা বীরের জাতি। এই মানুষকে নিয়েই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্বব্যাপী চলমান সঙ্কট ও করোনা মোকাবেলা করেই দেশকে আমরা আরও এগিয়ে নিয়ে যাব।
বার বার ভোট দিয়ে তাঁকে দেশ পরিচালনার সুযোগ প্রদানের জন্য দেশবাসীর প্রতি পুনর্বার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, দেশের জনগণ বার বার আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে এবং দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে পেরেছি বলেই দেশের এতো উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত। দেশের মানুষ আমাদের সঙ্গে ছিল এবং জনগণের সাহস, শক্তি ও সমর্থন ছিল বলেই আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পেরেছি। দক্ষিণবঙ্গ অনেকদিন অবহেলিত ছিল। এই সেতু নির্মাণের ফলে আর তা থাকবে না। দক্ষিণবঙ্গেও ব্যাপক উন্নয়ন সার্ধিত হবে।
তিনি বলেন, শুধুমাত্র একজন মানুষের প্ররোচনায় বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন এই সংসদে দাঁড়িয়ে আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম, নিজের টাকা পদ্মা সেতু করব। কারণ আমার বিশ্বাস ছিল দেশের জনগণের ওপর। পিতা-মাতাসহ সবাইকে হারিয়ে রিক্ত-নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরেছিলাম দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য। দেশের জনগণই আমার মূল শক্তি এবং জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করাই আমর একমাত্র লক্ষ্য।
এ প্রসঙ্গে সংসদ নেতা আরও বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে রেল একদম যশোর পর্যন্ত যাবে। আমাদের চিন্তা আছে এই রেলযোগাযোগ একদম বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার। এই রেলযোগাযোগ স্থাপনে আমাদের সমীক্ষা চলছে। যদিও এই এলাকায় এতো নদী, মাটি এতো নরম। তবুও সেটি নির্মাণে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে অনেক বৃহৎ প্রকল্প আমরা গ্রহণ করি। তখন মানুষের ঘরে বিদ্যুত ছিল না। কথা দিয়েছিলাম, দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে আলো জ্বালবো। আমরা শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দিয়েছি, প্রত্যেকের ঘরে আলো জ্বেলেছি। এখন পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেছে। সেখানে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য’র সৃষ্টি করবে।
’৭৫ পরবর্তী দেশের ইতিহাস বিকৃতি, বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা এবং বঙ্গবন্ধুর খুনী-যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসিত করার ইতিহাত তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫-এ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পুরস্কৃত করা, যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিয়ে পুনর্বাসিত এবং পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়া স্বাধীনতাবিরোধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বানিয়েছিল জিয়াউর রহমান।
তিনি বলেন, এখানেই শেষ নয়, খালেদা জিয়াও যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে তুলে দিয়েছিল লাখো শহীদের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা। ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন করে খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনী কর্নেল রশিদকে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েছিল। আরেক খুনী বজলুল হুদাকে এমপি বানিয়েছিল। কিন্তু আজ সেই পরিবেশ আর নেই। দেশের তরুণ প্রজন্ম এখন সত্য জানে, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। আর দেশের জনগণের প্রতি আমার আস্থা ও বিশ্বাস আছে। বাবা-মা’র দোয়াও আমার উপর রয়েছে। তাই দেশকে আমরা আরও এগিয়ে নিয়ে যাব, দেশের মানুষের ঘরে স্বাধীনতার সুফল পৌঁছে দেব।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং পুরো পৃথিবীতে চলমান করোনা অতিমারীর কারণে দেশের সব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী দেশের এক ইঞ্চি জায়গাও যাতে অনাবাদি না থাকে সেজন্য দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, এক ইঞ্চি জায়গাও অনাবাদী রাখা যাবে না। যে যেমনভাবে পারেন কিছু উৎপাদন করুন। নিজেরা ফসল ফলাব, নিজের খাদ্য নিজে ফলাব। তিনি বলেন, আমরা সারাদেশের উন্নয়ন করে যাচ্ছি। এই উন্নয়নের ধারাটাকে অব্যাহত রাখতে হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখার কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, দেশের ১৯ শতাংশ নিম্নবিত্ত পরিবারকে এই সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে। এবারের বাজেটে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ রেখেছি, যাতে কোন মানুষের সঙ্কটকালে অসুবিধা না হয়। এছাড়া এক কোটি কার্ডের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বল্পমূল্যে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রায় ৫০ হাজার নিম্ন আয়ের পরিবারকে পাঁচ মাসে ১৫ টাকা কেজি দরে প্রতিমাসে ৩০ কেজি চাল দেওয়া হচ্ছে, এটাও অব্যাহত থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবসম্পদ সৃষ্টি এবং প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান বাড়াতে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সরকার বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি। দেশের উন্নয়ন যাত্রাকে সফলভাবে এগিয়ে নিতে চতুর্থ বিপ্লব মোকাবেলা করার উপযুক্ত দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এতে করে দেশের কেউ বেকার থাকবে না, ইনশাআল্লাহ।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনকে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এতে করে আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উন্নতি হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ায় ২০২৬ সালে যে চ্যালেঞ্জ আসবে তা মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যদিও আমি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছি না। তবুও এ লক্ষ্য অর্জনে যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে তা থেকে উত্তরণে সম্ভাব্য সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সবাই মিলে আমরা একটা কৌশলপত্র তৈরী করছি। আমার বিশ্বাস, এ চ্যালেঞ্জও আমরা সফলভাবে উন্নীত হতে পারব, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে ইনশাআল্লাহ।
বর্তমান করোনা মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশ পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের রেকর্ড স্পর্শ করেছে উল্লেখ করে সংসদ নেতা বলেন, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে করোনা মহামারীর মধ্যেও আমরা ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিদেশে রফতানি করেছি। দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিও আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দেশের অর্থনীতি আবারও উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। সারাবিশ্বে পণ্যে মূল্যে বৃদ্ধিতে আমদানীর ক্ষেত্রে কিছুটা খরচ বাড়লেও তাতে আশঙ্কার কিছু নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা সর্বাত্মক প্রচেস্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিলাসবহুল পণ্য যাতে আমদানী কম হয়, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যেগুলো খুব একটা বেশি প্রয়োজন নেই তা যেন আমদানী না হয়।
করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী আবারও দেশবাসীকে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, মানুষের জীবনের সুরক্ষা দিতে যা যা প্রয়োজন আমরা তা করে যাচ্ছি। আমাদের করোনার টিকা প্রদানের সাফল্যের কথা সবাই জানে। এখন বুস্টার ডোজ দিচ্ছি। সবাই যেন বুস্টার ডোজ গ্রহণ করেন। সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলেও মৃত্যুর হার নগণ্য। তবে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আমরা অনেক ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছি। সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপের ফলে আমরা যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারব ইনশাআল্লাহ।