মো. শাহজাহান মিয়া জগন্নাথপুর থেকে :
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে গেছে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলা। ৮ দিনের দুর্বিষহ জীবনের স্মৃতিকথা মানুষকে ফিরে নিয়ে গেছে আশির দশকে। অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও অপূরণীয় ক্ষতি অতীতের সকল ইতিহাসকে ছাড়িয়ে গেছে। যা জগন্নাথপুরবাসী কল্পনাও করেননি। হঠাৎ এতো বড় বন্যা মোকাবেলায় প্রস্তুত ছিলেন না মানুষ। যে কারণে জনদুর্ভোগ ও ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি হয়েছে।
গত ১৭ জুন শুক্রবার রাত থেকে টানা বৃষ্টিপাতের সাথে আশঙ্কাজনক ভাবে পানি বাড়তে শুরু করে। ওই রাতে চলে যায় বিদ্যুৎ ও বন্ধ হয়ে যায় মোবাইল সহ সব ধরণের নেটওয়ার্ক। শনিবারের মধ্যে জগন্নাথপুর উপজেলা সদর সহ সব কিছু পানির নিচে তলিয়ে যায়। প্রধান প্রধান সড়কে কোমর ও পেট পানি হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় যানবাহন চলাচল। তলিয়ে যাওয়া বাড়ি ঘরের মানুষ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিতে ছুটাছুটি করেন। কেউ কাউকে সহযোগিতা করার মতো অবস্থা ছিল না। কারো দিকে কেউ তাকানোর সুযোগ নেই। নেটওয়ার্ক না থাকায় কেউ কারো খবরও নিতে পারেননি। নারী, পুরুষ, আবাল, বৃদ্ধ বণিতা পানিতে হেঁটে বৃষ্টিতে ভিজে ছুটে চলেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে একটু মাথাগুজার ঠাঁই পাওয়ার আশায়। আবদুস সামাদ আজাদ অডিটোরিয়াম, মুক্তিযোদ্ধা ভবন, জগন্নাথপুর পৌরসভা, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রসা ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি সহ যে যেভাবে পারছেন উঁচু স্থানে পরিবার পরিজনকে নিয়ে দুর্গত মানুষেরা আশ্রয় নেন। এতেও অনেকের বিধিবাম হয়েছে। আশ্রয় নেয়া সেই উঁচু স্থানটিও এক পর্যায়ে তলিয়ে যায়। এরপর আবারো আশ্রয়ের সন্ধানের ছুটে চলেন মানুষ। এক কথায় দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। এ সময় তাদের সাথে অতি প্রয়োজনীয় কাপড় সহ অল্প জিনিসপত্র নিয়ে আসলেও সকল মালামাল পানিতে ডুবে যাওয়া বাড়িতে তালাবদ্ধ করে রেখে আসেন। তবে গবাদিপশু নিয়ে মানুষ ছিলেন দিশেহারা। অনেকে প্রধান সড়েক গাবদিপশু বেধে রাখেন। তবে ঘরে থাকা ধান সহ অন্যান্য মালামাল ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। তখন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানহীন মানুষের দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়। যা নিজ চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারেন না। কার্যত অচল ছিল জগন্নাথপুর। পানিবন্দি জগন্নাথপুর সারা দেশ থেকে রীতিমতো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এদিকে-পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জগন্নাথপুর সদর বাজার সহ উপজেলার প্রায় সকল হাট-বাজারের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। দেখা দেয় খাদ্য ও জ্বালানী সংকট। খাদ্যের অভাবে ক্ষুধার্ত মানুষদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মাঝে মধ্যে ২/১ টি দোকান খোলা পাওয়া গেলেও মোমবাতি, গ্যাস সহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম ছিল অনেক বেশি। যদিও বাজার নিয়ন্ত্রন রাখতে উপজেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের আটক সহ অর্থদন্ড করেন। রোববার থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা দুর্গত মানুষের মধ্যে প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ সহ বিভিন্ন মানুষের পক্ষ থেকে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়। এ সময় খাদ্য পাওয়ার আশায় অনাহারী মানুষগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়েন। সোমবার ও মঙ্গলবার থেকে পানি কমতে শুরু করে। এর মধ্যে গত শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত টানা ৫ দিন বিদ্যুৎহীন অন্ধকারে ছিলেন জগন্নাথপুরবাসী। ছিল না কোন প্রকার নেটওয়ার্ক। প্রতিদিন রাত হলেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ডাকাত আতঙ্ক। রাত জেগে মানুষ পাহারা দেন। অনেক স্থানে জনতার ধাওয়ায় ডাকাতদল পিছু হটে এবং বন্দুকের পাকাগুলি বর্ষণের ঘটনাও ঘটে। এমনও হয়েছে ডাকাত ভেবে মানুষ পুলিশকেও ধাওয়া করেছেন। এছাড়া বেড়ে যায় গরু চোর সহ অন্যান্য চোরদের উৎপাত। এ সময় চুরি ও ডাকাতি রোধে জনতার সাথে পুলিশের নৌ টহল অব্যাহত রয়েছে। যে কারণে কোথাও বড় ধরণের চুরি-ডাকাতির ঘটেনি। সব মিলিয়ে বিগত ১৯৮৮ সালের বন্যার কথা স্বরণ করে মানুষ এমন অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। চলতি ২০২২ সালের বন্যা অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এ বন্যার কাছে সকল মানুষ অসহায় হয়ে পড়েন। অবশেষে ২১ জুন মঙ্গলবার রাত ৮ টার দিকে জগন্নাথপুর পৌর শহরের কিছু অংশে ফের বিদ্যুৎ আসলে আনন্দে মেতে উঠেন ভুক্তভোগী মানুষ। পরে আবার বিদ্যুৎ চলে যায়। পরে ২৩ জুন বৃহস্পতিবার দুপুরে বিদ্যুৎ আবার আসে। ২৪ জুন শুক্রবার কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে।