কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, জনগণের ভোট কেড়ে নিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চাই না। আর যেনতেনভাবে প্রধানমন্ত্রী হওয়াও আমার লক্ষ্য নয়। আওয়ামী লীগ জনগণের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠা প্রাচীন রাজনৈতিক দল, আমরা নির্বাচনে জনগণের শক্তিতেই বিশ্বাসী। বাংলাদেশ কখনও চাপের কাছে মাথানত করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না। বরং জনগণের শক্তিতে দেশ এগিয়ে যাবে। আমাদের যে আত্মবিশ্বাস আছে তা নিয়েই আমরা এগিয়ে যাব এবং জনগণের শক্তি নিয়েই দেশ এগিয়ে যাবে।
দেশের মানুষের সাহসেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষের কাছ থেকে যে অভূতপূর্ব সাড়া আমি পেয়েছিলাম, সেটাই কিন্তু আমার সাহস আর শক্তি। দেশের মানুষ আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। তাদেরই সাহসে এই পদ্মা সেতু আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে বিরোধিতাকারীদের বিচারের আওতায় আনা হবে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সময়ই তা বলে দেবে। বিএনপি কাকে নিয়ে নির্বাচন করবে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ওদের (বিএনপি) জন্য কান্নাকাটি করে লাভ নেই। ওদের পুঁজিটা কী? বিএনপির কি একটাও যোগ্য নেতা নেই যাকে চেয়ারম্যান করতে পারে? তাহলেই তো এখনকার মতো- দুরবস্থা হয় না।
বুধবার তাঁর কার্যালয়ের শাপলা হলে চলমান বন্যা পরিস্থিতি এবং আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সাহস নিয়ে নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করার ফলে আজকে বাংলাদেশের সম্মান ফিরে এসেছে। নইলে আমাদের দেশের সকলের একটা পারসেপশন ছিল, একটা মানসিকতা ছিল যে, আমরা অন্যের অর্থায়ন ছাড়া কিছুই করতে পারব না। এই যে একটা পরনির্ভরশীলতা, পরমুখাপেক্ষিতাÑ এটাই কিন্তু আমাদের মাঝে ছিল। একটা দৈন্যতা ছিল। বিশ্বব্যাংক যখন এই টাকাটা তুলে নিয়ে গেল, আমরা অন্তত সেই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি। সেই অচলায়তন ভেঙ্গে আমরা যে একটা আত্মমর্যাদাশীল জাতি, আমরা যে পারি, সেটা প্রমাণ করতে পেরেছি।
সংবাদ সম্মেলনে এ সময় দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন, পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্র, দেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতিসহ নানা ইস্যুতে সাংবাদিকদের অসংখ্য প্রশ্নের সাবলীলভঙ্গিতে হাসিমুখে তার উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়ার পর শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তা বাস্তবায়নের কঠিন যাত্রায় সঙ্গে থাকায় দেশের মানুষের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতাও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে। আমি যেটা পারব, সেটাই বলব। যেটা বলব, করব। করে দেখাতে পারি, সেটা করেছি। এই জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ।’
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ সময় মঞ্চে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম। এ সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক, প্রকাশক, নবীন-প্রবীণ সাংবাদিক, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, পদ্মা সেতু নির্মাণের মূল দায়িত্বে থাকা কারিগরি পরামর্শক কমিটির শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি উপস্থত ছিলেন।
বিএনপি কাকে নিয়ে নির্বাচন করবে? আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, ওরা (বিএনপি) কাকে (নেতৃত্ব) নিয়ে নির্বাচন করবে, বলতে পারেন? ওদের জন্য কান্নাকাটি করে লাভ নেই। আর ওদের পুঁজিটা কী? বিএনপির কি একটাও যোগ্য নেতা নেই যাকে চেয়ারমান করতে পারে? তাহলেই তো (এখনকার মতো) দুরবস্থা হয় না।
আওয়ামী লীগকে গণমানুষের দল অভিহিত করে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে করতে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আমাদের অন্য দলগুলোর কী অবস্থা? তাদের জন্ম কোথায়? তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান একজন সামরিক শাসক। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যায় জড়িত। ১৫ আগষ্টের পর খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় এসে তাকে সেনাপ্রধান নিয়োগ দিয়েছিলেন। তারপর নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করলেন। নিজেই একাধারে সেনাপ্রধান, নিজেই একাধারে রাষ্ট্রপতি। পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের মতো।
তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ-না’ ভোট দিয়ে (জিয়াউর রহমান) ক্ষমতায় থাকলেন। সেই ভোট কেমন হয়েছিল, মানুষ জানে। সেই জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করলেন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দল থেকে নেতাদের নিয়ে। এ গাছের বাঁকল ও গাছের ছাল নিয়ে ক্ষমতায় বসে তৈরি করা দল হচ্ছে বিএনপি। জাতীয় পার্টিও একইভাবে গঠন করা হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, আরেক সামরিক শাসক (হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ) ক্ষমতায় বসে আরেকটি দল গঠন করলেন। জাতীয় পার্টি গঠন করা হলো। এভাবে মিলিটারি ডিকটেটররা ক্ষমতায় বসে দল গঠন করেছে। কিন্তু আমি তো জনগণের ভোট কেড়ে নিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চাই না। আমিই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। সেটা করতে গিয়ে গ্রেনেড-বোমার মুখে পড়েছি। অনেক কষ্ট করেও গণতন্ত্র চর্চা করতে পেরেছি এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা আছে বলেই দেশের এত উন্নয়ন করতে পেরেছি।
বিএনপি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা আরও বলেন, একটি দল তখনই জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করে যখন সে জানে, সেই দল নির্বাচনে জয়ী হলে কে হবে সরকারপ্রধান। এটি কিন্তু সবাই বিবেচনা করে। কিন্তু তারা (বিএনপি) কাকে (নেতা হিসেবে) দেখাবে? এতিমের টাকা মেরে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে (বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া)? তাঁকে তো আমিই নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করেছি। নাকি তারা গ্রেনেড হামলার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি (ফিউজিটিভ), যে (তারেক রহমান) বাংলাদেশী নাগরিকত্ব ছেড়ে ব্রিটিশ নাগরিক হয়ে আছে, তাকে (নেতা হিসেবে দেখাবে)?
তিনি বলেন, একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়ে কীভাবে ব্রিটিশ নাগরিক হলো, তার খোঁজ করেন। সেই খোঁজ করলেই সব তথ্য বেরিয়ে আসবে। এই (নেতৃত্ব) নিয়ে তারা ইলেকশন করবে কীভাবে, সেটিই বড় কথা। চেয়ারম্যান করতে পারে, এরকম একটা যোগ্য নেতাও কি বিএনপিতে নেই?
২০১৮ সালের নির্বাচন অবশ্যই অংশগ্রহণমূলক হয়েছে : মানবাধিকার সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবাধিকার আমাদের শিখাতে আসবে কারা যারা খুনীদের আশ্রয় দেয়, স্কুলে গুলি হয়, ছাত্রছাত্রী মারা যায়, রাস্তাঘাটে পুলিশ মানুষকে গলায় পারিয়ে মেরে ফেলে তারা কি মানবাধিকার শেখাবে? তাদের উস্কানিতে আমাদের দেশের কিছু মানুষের আস্ফালন (নাচানাচি) হবে এটা ঠিক, কিন্তু আমরা আমাদের আত্মবিশ্বাস নিয়েই চলব, জনগণের শক্তি নিয়েই চলব।
২০১৮ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচন একেক সিটে দিনে তিনবার করে প্রার্থী পরিবর্তন করে। ঢাকা থেকে একজন ঠিক হয়। আবার লন্ডন থেকে আরেকজন। যে যত টাকা দিয়েছে, বিএনপি তাকে মনোনয়ন দিয়েছে। তার মাঝখানে নির্বাচন ছেড়ে চলে গেল। তিনি বলেন, যখন মাঝাপথে কেউ নির্বাচন ছেড়ে চলে যায়, তখন তো মাঠ ফাঁকা। বাকিরা তখন যা খুশি, তা-ই করতে পারে। সেই দোষ তো আওয়ামী লীগের না। এখানে গণতন্ত্রের দোষ কোথায়? তবে বাংলাদেশ কোন চাপের মুখে কখন নতি স্বীকার করেনি, করবেও না।
বিরোধিতাকারীদের ধন্যবাদ জানালেন প্রধানমন্ত্রী : পদ্মা সেতু নির্বাচনে যারা বিরোধিতা করেছে, সংবাদ সম্মেলনে তাদের ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, তাদের বিরোধিতার কারণে আমরা যে আত্মমর্যাদাশীল, আমরা যে পারি সেটা প্রমাণ করতে পেরেছি। এতেই আমরা খুশি। এর বেশি নয়।
পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংক বা বিরোধিতাকারীরা দুঃখ প্রকাশ করেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার কথা হলো, নিজের ভাড় ভাল না, গোয়ালার ঘির দোষ দিয়ে লাভ কী? বিশ্বব্যাংককে আমি কী দোষ দেব। তারা অর্থায়ন বন্ধ করল কাদের প্ররোচনায়। সেটা তো আমাদের দেশেরই কিছু মানুষের প্ররোচনায় তারা বন্ধ করেছিল। এটাই তো বাস্তবতা। আর যারা বিভিন্ন কথা বলেছেন, তাদের কিছু কথা আমি উঠালাম। কথা আরও আছে। সেখানে আমার তো কিছু বলার দরকার নেই। এটা তারা নিজেরাই বুঝতে পারবে, যদি তাদের অনুশোচনা থাকে। আর না থাকলে আমার কিছু বলার নেই। আমার কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বিরোধিতাকারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তাদের ধন্যবাদ জানাই এ জন্যই যে, এই ঘটনাটি ঘটেছিল বলেই আমরা সাহস নিয়ে নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করতে পেরেছি। আজকে বাংলাদেশের সম্মানটি ফিরে এসেছে। আমাদের দেশের বিষয়ে সবার একটা পারসেপশন ছিল, একটা মানসিকতা ছিল যে, আমরা অন্যের অর্থায়ন ছাড়া কিছুই করতে পারব না। এই যে পরনির্ভরশীলতা, পরমুখাপেক্ষিতা আমাদের মাঝে ছিল, দৈন্যতা ছিল। বিশ্বব্যাংক যখন টাকাটা তুলে নিয়ে গেল অন্তত আমরা সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। সেই অচলায়তন ভেঙ্গে আমরা যে আত্মমর্যাদাশীল, আমরা যে পারি সেটা প্রমাণ করতে পেরেছি।
বিরোধিতাকারীদের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দাওয়াত দেয়া হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা যারা এগুলো বলেছে, বিরোধিতা করেছে। আমরা ওদের দাওয়াত দিচ্ছি, ওদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাব পদ্মা সেতুতে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করলেও বাংলাদেশের নামে বরাদ্দকৃত টাকা তারা ফেরত নিতে পারেনি জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক কোন অনুদান দেয় না। আমরা লোন নেই। যে টাকাটা বাংলাদেশের নামে স্যাংশন হবে, সেটা নষ্ট করার কোন রাইট তাদের নেই। পদ্মা সেতু থেকে টাকা তারা বন্ধ করছে, কিন্তু ওই টাকা আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি। এই টাকা আমরা অন্যান্য প্রজেক্টে ব্যবহার করতে পেরেছি।
বিশ্বব্যাংক কোন একটি দেশের একটি প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দিলে দেশটি চাইলে অন্য প্রকল্পে ব্যবহার করতে পারে এমনটি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা কিন্তু করা যায়। তা কিন্তু অনেকে জানেন না। কেন জানেন না জানিনা। আমাদের যারা অর্থনীতিবিদ, যারা কাজ করে, তারা কেন মাথায় রাখেন না। এরা (বিশ্বব্যাংক) দাতা নয়। আমরা তাদের থেকে ভিক্ষা নেই না। ব্যাংকের একটি অংশীদার হিসেবে আমরা লোন নেই এবং দসহ সেই লোন পরিশোধ করি। কাজেই আমার নামে, বাংলাদেশের নামে যে টাকা হবে, সেই টাকা তাকে (বিশ্বব্যাংক) দিতে হবে। জ্ঞানীগুণীরা বলেন, টাকা বন্ধ হয়ে গেছে। কীসের জন্য? আমরা তো লোন নিচ্ছি। যে লোন বাংলাদেশের নামে স্যাংশন হবে সেই লোন কোন না কোনভাবে তাকে দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে ওই দাতা কথাটি বন্ধ করে দিলাম। আমি বলেছি, কীসের দাতা। এরা তো উন্নয়ন সহযোগী। গণমাধ্যমেরও এ বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। আমরা কিন্তু কারও থেকে ভিক্ষা নেই না। আমরা ঋণ নেই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধও করি। এটুকু ঠিক, সুবিধাটা স্বল্প সুদে। আমাদের কেউ করুণা করে না, আমরা কারও করুণা ভিক্ষা নিইনি। তাই আমাদের জুজুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।’
সমালোচকদের সমালোচনার জবাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী : সংবাদ সম্মেলনে পদ্মা সেতুর সমালোচনা ও বিরোধিতাকারীদের বিষয়ে একাধিক প্রশ্নের জবাবে সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে কারা কী বলেছিলেন, তার প্রতিটি কথার উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী। আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক সবসময় স্বাধীন কথা বলেন উল্লেখ করে বলেন। উনি সব সময় স্বাধীন। স্বাধীনই থাকেন। স্বাধীন মালিক তিনি। তিনি বলেছিলেন, পদ্মা সেতু দেশীয় অর্থায়নে হবে না, সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করে তা সম্ভব করেছি। তাকে দাওয়াত দিচ্ছি, তিনি যেন পদ্মা সেতুতে আসেন।’
২০১১ সালের ৭ অক্টোবর ‘স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের কোন উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বাতিল করল’- বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যের জবাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খালেদা জিয়া নিজেই ভুলে গেছেন। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্টের টাকা বিশ্বব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছিল দুর্নীতির কারণে। সেটার সঙ্গে তিনি ও তাঁর পুত্ররাও জড়িত ছিলেন। সিমেন্স এটার সঙ্গে জড়িত ছিল। এটা আমাদের কথা না এফবিআই তথ্যটা বের করেছিল। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের টাকা বিশ্বব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছিল দুর্নীতির কারণে। কাজেই এটা ভুলে গেছেন। বাঙালি তো এমনিতে ভুলে যায়।’
অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলী খানের মন্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ৯৬ সালে যখন সরকারে এসেছিলাম, তখন তিনি (আকবর আলী খান) অর্থ সচিব ছিলেন। তিনি ২০১২ সালের ১ জুলাই বলেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের পক্ষে পরবর্তীকালে ঋণ সহায়তা পাওয়া খুব দুষ্কর হয়ে পড়বে। যখনই কোন দাতা সংস্থা কোন নতুন প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহী হবে, তারা দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশকে ভিন্ন চোখে দেখবে। সরকার যদি বিকল্প অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে, তাহলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে, কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে।’ এই কথার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আশা করি পদ্মা সেতুর কাজের মান নিয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন তুলতে পারবে না। তাই এই কথার কোন ভিত্তি নেই।’
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে ‘দুঃখজনক ঘটনা’ আখ্যা দিয়ে সুশাসনের অভাবে দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প আজ অনিশ্চয়তার মুখে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আলী আহসান মনসুরের এমন বক্তব্যে জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতিটা কোথায় দেখলেন? কানাডার আদালতই প্রমাণ করতে পারল না, কিন্তু উনারা দুর্নীতি দেখেন। সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আন্তর্জাতিকভাবে আছে কিনা, আপনারাই বিচার করবেন। বাংলাদেশের জনগণ বিচার করবে।
‘নিজ অর্থায়নে সরকার পদ্মা সেতু করার যে পরিকল্পনা করেছে, তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে সরকার ইচ্ছা করলে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারবে। কিন্তু শেষ করতে পারবে না।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দীনের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি চাই তাকেও দাওয়াত দিতে। এটা (পদ্মা সেতু) যে শেষ হয়েছে, তিনি যেন পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে একটু যান। আমরা দাওয়াত দিচ্ছি। সবাইকে দাওয়াত দেব, যারা এ কথা বলেছেন, সবাইকে দাওয়াত দেব।’
পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারলেও শেষ করার গ্যারান্টি থাকবে না। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের এমন প্রতিক্রিয়ার জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা কিন্তু শেষ করেছি। তাকেও দাওয়াত দিচ্ছি, পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়িতে পাড়ি দিতে।’ এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন, যা জোগান দিতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়বে। এর দায় সরকার এড়াতে পারবে না। সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের এমন বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের রিজার্ভ কিন্তু এখনও ৪২ বিলিয়ন। বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়েনি। সঙ্গে অন্য প্রকল্পগুলোও করে যাচ্ছি।’
এই মুহূর্তে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু শুরু করা হলে দেশের অন্যসব অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে কাজগুলো করা যেত, সেগুলো আর হবে না। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের এমন বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সব কাজ কিন্তু চলছে। কোনটা কিন্তু থেমে যায়নি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এইটুকু বললাম এই কারণে যে, তারা যখন কথা বলেন, আমি জানি না কেন তাদের ভেতরে আত্মবিশ্বাসের অভাব। তারা ভুলে যান জাতির পিতার নেতৃত্বে এই দেশের মানুষ যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। আমরা বিজয়ী জাতি, কোন কথা বললে ভেবেচিন্তেই বলি। বিজয়ী জাতি হিসেবে মানসিক শক্তি নিয়েই কথা বলি। কিন্তু এনাদের ভেতরে একটা পরাজিত মনোভাব। তারা সবসময় আত্মগ্লানিতে ভোগেন, তাই তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব। আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে। আমি যেটা পারব, সেটাই বলব। যেটা বলব, করব। করে দেখাতে পারি, সেটা করেছি। এই জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ।’
বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পরে অধ্যাপক জামিলুর রেজাসহ যেসব কারিগরি বিশেষজ্ঞ প্যানেল সরকারকে সহযোগিতা করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী। এই উপদেষ্টা প্যানেল সরকারের পাশে না দাঁড়ালে হয়তো পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হতো না বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।
একটি ব্যাংকের এমডি এত ডলার কীভাবে অনুদান দিল? : অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী একটি ব্যাংকের এমডি (ড. ইউনূস) হয়ে একটি ফাউন্ডেশনে কীভাবে এত ডলার অনুদান দিল সেই প্রশ্ন তুলে গণমাধ্যমকে তা তদন্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি নিজে এটা করতে গেলে ‘প্রতিহিংসা’র প্রশ্ন আসতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থ বরাদ্দ বন্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেছেন একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে, সেই বিষয়ে তদন্ত করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে ৫৪টি বেসরকারী ব্যাংক রয়েছে। কার এত আর্থিক সঙ্গতি রয়েছে, একজন এমডি একটি ফাউন্ডেশনে এত ডলার দিল অনুদান হিসাবে, অথবা এত ডলার খরচ করল কীভাবে? সেটা আপনারা তদন্ত করলে ভাল হয় না? আমি করতে গেলে বলবেন, প্রতিহিংসার জন্য এটা করছি। তাই আপনারা সাংবাদিকরা করলে সেটা আরও ভাল হয়। তিনি বলেন, আরও তথ্য আছে। কোন ব্যাংকে কত টাকা আছে, কোন চেকে কত টাকা সরালো, সেইসব তথ্যও আছে। সব আমরা বলব কেন? আপনারা একটু খুঁজে বের করেন। তারপরে যদি কিছু লাগে জোগান দেব।
প্রধানমন্ত্রী ড. ইউনূসের নামোল্লেখ না করে বলেন, ট্রাস্টের টাকা বেসরকারী ব্যাংকে কীভাবে যায়? এক চেকে ছয় কোটি টাকা তুলে নিয়ে যায় নিজের ব্যক্তিগত হিসাবে। আমরাও তো ট্রাস্ট চালাই, তার চেয়ারপার্সন হবার পরও আমার ব্যক্তিগতভাবে টাকা তোলার কোন রাইট নেই। আমার কাছে এই তথ্যও আছে ট্রাস্ট থেকে ব্যক্তিগত চেকে ৬ কোটি টাকা নিয়ে, তারপর সেই টাকা উধাও। গেল কই? বেশিদিনের কথা না, ২০২০ সালের কথা। তার হিসাব নম্বর সবই আছে। বলতে চাই না। আপনারা বের করেন। তিনি বলেন, এত স্বনামধন্য বিখ্যাত ব্যক্তি, আমরা তো লেখাপড়া জানি না, কিছুই জানি না। আমাদের তো বলা শোভা পায় না। এত জ্ঞানী তো না, সাধারণ মানুষ। একেবারে নিরেট বাঙালী মেয়ে। তাও আবার বাংলায় পড়েছি।
বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার পদ্মা সেতুতে : সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের গুণগত মানে কোন আপোস করা হয়নি। এই সেতু নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণে। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত এই সেতুর পাইল বসানো হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় ব্যবহৃত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি।
পদ্মা সেতুকে ঘিরে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক গড়ে উঠবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে দ্বিতীয় পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে জায়গা খোঁজা হচ্ছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরে ওই অঞ্চলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং দেশের শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগের একটা বড় লিংক। তাই আঞ্চলিক বাণিজ্যে এই সেতুর ভূমিকা অপরিসীম। তাছাড়া পদ্মার দুপাড়ে পর্যটন শিল্পেরও ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
পরিবেশ রক্ষার জন্য পুনর্বাসিত এলাকাকে ‘পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বহুমুখী এই সেতুর ওপরের ডেক দিয়ে যানবাহন এবং নিচের ডেক দিয়ে চলাচল করবে ট্রেন। সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেলপথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। এর ফলে এ অঞ্চলের মানুষের একদিকে দীর্ঘদিনের ভোগান্তি লাঘব হবে, অন্যদিকে অর্থনীতি হবে বেগবান। আশা করা হচ্ছে, এ সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ১ দশমিক দুই-তিন শতাংশ হারে অবদান রাখবে এবং প্রতি বছর দশমিক আট-চার শতাংশ হারে দারিদ্র্য নিরসন হবে।
দেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের সহযোগিতার জন্যই আজ পদ্মা সেতু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের সরকার জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নই আমাদের সরকারের প্রধান লক্ষ্য। এ বছরই মেট্রোরেল এবং কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ট্যানেল উদ্বোধন করা হবে। ঢাকায় এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের গৃহীত মেগাপ্রকল্পসহ অন্যান্য প্রকল্পের কাজও যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছে।
এ মুহূর্তে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে সেতু নয় : আয়োজন থাকলেও এই মুহূর্তে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না এমন ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতবড় একটা খরচ করেছি, আগে সেটার টাকা উঠুক, তারপর ওটা করব।
তিনি বলেন, আমরা সরকারে আসার পর বিভিন্ন সেতু নির্মাণ করে সারাদেশটাকেই সংযোগ করেছি। যে পদ্মা সেতুটি তৈরি করলাম, এটা চালু হওয়ার পর দ্বিতীয়টার জন্য আমাদের মোটামুটি আয়োজন আছে, তবুও আগে দেখতে হবে এটার প্রয়োজনীয়তাটা কতটুকু। সেটা বিবেচনা করে এটা করা হবে। কাজেই এখনই এতবড় একটা কাজ শেষ করে আবার আরেকটা শুরু করতে পারব না।
সরকারপ্রধান বলেন, আগে আরিচা থেকে ফেরি যেত দৌলতদিয়ায়। পাটুরিয়ার যে জায়গাটা আমরা ড্রেজিংয়ের পলি-বালি ফেলে ভরাট করি। আমাদের সরকার পরে আরিচা থেকে পাটুরিয়া ৭ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করে। যাতে ফেরির সময়টা কমে আসে। যদিও উদ্বোধন করে যেতে পরিনি। আর ওই জায়গাও খুব বড় নয়। কাজেই সেতুও বড় হবে না। ভবিষ্যতে যখন প্রয়োজন মনে করব, তখন করব। আর আমি আগেই বলেছি, কোন প্রকল্প নেয়ার আগে সেখান থেকে আমাদের রিটার্ন কী আসবে সেটা দেখতে হবে। এটা দেখে আমরা করব। সেটা আমাদের মাথায় আছে। এখানে হয়তো সেতু করতে হতে পারে, করব। সেটা আমরা তখন উদ্যোগ নেব।
বন্যা মোকাবেলার প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে : সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে বন্যার ঝুঁকি যে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকে, সে কথা তুলে ধরে সরকারের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রাখার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বন্যা শুরু হয়েছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্যার ঝুঁকিটা আমাদের থাকে, পানিটা নেমে আসবে দক্ষিণ অঞ্চলে। সেজন্য আগাম প্রস্তুতি আমাদের আছে।
সিলেট অঞ্চলে এবারের ভয়াবহ বন্যার কথা তুলে ধরে সেখানে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতার বিস্তারিত বিবরণ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি আগেই নির্দেশ দিয়েছিলাম, পানি যাতে দ্রুত নেমে যেতে পারে, প্রয়োজনে রাস্তা যেন কেটে দেয়। এটাও আমাদের একটা শিক্ষা, কোন জায়গা থেকে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে। কারণ আমাদের এখানে তো বন্যা আসবেই। বন্যার সঙ্গে আমাদের বসবাস করতে হবে। সেটা চিহ্নিত করে রাখতে বলেছি, সেখানে ব্রিজ কালভার্ট এমনভাবে করে দেব, যাতে পানি জমা থাকতে না পারে।
ওই অঞ্চলে আরও বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র করার পাশাপাশি বন্যার কথা মাথায় রেখে অবকাঠামো করার কথাও সরকারপ্রধান বলেন। তিনি বলেন, অনেক দিন এরকম বন্যা হয়নি, আবার বন্যা এলো। সেইভাবে অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। বন্যার পর কৃষক যেন কৃষিকাজ করতে পারে, সেজন্য বীজ, সারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে জানিয়ে শেখ হাসিনা কষ্ট করে যারা বন্যার মধ্যে কাজ করেছেন, সবাইকে ধন্যবাদ জানান। সিলেট অঞ্চলে এবারের বন্যাকে ভয়াবহ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবার সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা আমরা পেয়েছি, কিন্তু এটা আমাদের মোকাবেলা করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এটা তো আর মানুষ ঠেকাতে পারে না। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মানুষের ক্ষতিটা যাতে না হয় সেটা আমাদের দেখা দরকার।
বন্যা মোকাবেলায় সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই আন্তরিকতা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এটাই সবচেয়ে বড় কথা। প্রশাসনের কর্মকর্তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন এবং সব জায়গায় তারা কাজ করছেন। বিভাগীয় কমিশনার থেকে শুরু করে পুলিশ কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকসহ অন্য কর্মকর্তারা প্রত্যেকেই কিন্তু এই বৃষ্টিতে ভিজে, পানির মধ্যে হেঁটে হেঁটে মানুষকে উদ্ধার করা, তাদের পাশে দাঁড়ানোর কাজ করে যাচ্ছেন। কাজেই আমি এটা বলব, প্রত্যেকের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে; কাজেই যেখানেই বন্যা হবে আমরা সেভাবেই সেটা মোকাবেলা করব।
দুর্যোগ প্রশমনে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা ও ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ জুন ২০২২ পর্যন্ত আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর যেই কার্যক্রম, সেখানে সেনাবাহিনীর ১৭ ও ১৯ পদাতিক ডিভিশন তারা উদ্ধার কাজ পরিচালনা করেছে। প্রায় ১১ হাজার ৩৮০ জন এবং ২৩ হাজার ৪৪৬ পরিবারের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী দেয়া হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার ৩১৪ পরিবারকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। নৌ বাহিনীর কর্মকর্তা ও ডুবুরি মিলে ১০৬ জন, তারা সেখানে প্রায় ২০০ পরিবার উদ্ধার করেছে এবং ৮০০ পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে এবং ৩০ পরিবারকে চিকিৎসা দিয়েছে। বিজিবি কর্মকর্তা ও সৈনিক মিলে প্রায় ১ হাজার ৬২০ জন, তারা ১ হাজার ২৫০ পরিবার উদ্ধার করেছে; ৪ হাজার পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে এবং পাঁচশ পরিবারকে চিকিৎসা দিয়েছে। কোস্টগার্ডের ৮০ জন একশ পরিবারকে উদ্ধার করেছে, ৬০০ পরিবারকে ত্রাণ সামগ্রী দিয়েছে, ৩০টি পরিবারকে উন্নত চিকিৎসা দিয়েছে।