মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :
(পূর্ব প্রকাশের পর)
উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল উটো-আজটেক ভাষাগোষ্ঠী। ওই বংশের নাহুয়াটল আজটেক সভ্যতার ভাষা ছিলো। দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ভাষা ছিলো মায়া-সাকো, যা মায়া সভ্যতার ভাষা। আরওয়াক শাখা এন্টিলেসে এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাংশ জুড়ে ছিলো। কাবিব ছিলো আমাজন নদীর উত্তরাঞ্চলের ভাষা আর কিচুয়া পেরুর ইনকা সভ্যতার ভাষা। পৃথিবীর ভাষাগোঠী সমূহের এই সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকে বোঝা যায়, এ বিশ্বে কতো অসংখ্য ও বিচিত্র ভাষা প্রচলিত, কতো ভাষা বিলুপ্ত আবার কতো ভাষা বিস্তৃত ভৌগোলিক অঞ্চলে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীতে প্রচলিত। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে অর্থাৎ কালানুক্রমিক-তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি উদ্ভবের পূর্বে পৃথিবীর অসংখ্য ভাষা এবং তাদের পারস্পারিক সম্পর্ক সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
বিশিষ্ট শাস্ত্র হিসেবে ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব ঊনবিংশ শতাব্দীর ঘটনা হলেও ব্যাকরণ শাস্ত্রের বিকাশ ঘটেছিলো বহু পূর্বে। জ্ঞানের অন্যান্য শাখার ন্যায় ভাষা বিশ্লেষণেও গ্রিকরা। অগ্রণী । তাঁরা ভাষা অধ্যয়ন করেছিলেন তাঁদের দার্শনিক চিন্তার পরিপূর্ণতার জন্য, যেখানে প্রাচীন ভারতবর্ষে ধর্মীয় কারণে আর্য প-িতেরা সংস্কৃত আর মধ্যযুগে ইউরোপে খ্রিস্টান বিদ্বদজনেরা লাতিন ভাষা চর্চা করেন। গ্রিকদের ভাষার ‘ব্যাকরণ’ তাঁদের দর্শনশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে বির্তক ছিলো ‘ভাষা’ কি ‘প্রকৃতি-শাসিত না ‘ঐতিহ্য লালিত। ভাষা যদি প্রাকৃতজ হয় তাহলে তার ঐশ্বরিক বা দৈব ব্যুৎপত্তি থাকার কথা আর তার উৎপত্তি সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে তা মানব সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত। এই বিতর্কেরই সম্প্রসারণ শব্দের গঠনের সঙ্গে শব্দের অর্থের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, সে জিজ্ঞাসা। এই বিতর্ক থেকেই ভাষার ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণের সূত্রপাত।
গ্রিকরা যেহেতু তাঁদের দর্শন চিন্তার সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে ভাষার উদ্ভব ও শব্দের ব্যুৎপত্তি অনুসন্ধানে রত হয়েছিলেন, সে কারণে তাঁরা ভাষার ভ্যাকরণ ব্যাখ্যার যুক্তি বা তর্কশাস্ত্রের সূত্রসমূহ প্রয়োগ করেছিলেন। ভাষা প্রকৃতি না ঐতিহ্যের দান সেই বিতর্ক থেকে সৃষ্টি হয়েছিলো ‘এনালজিস্ট’ বা সাদৃশ্যবাদী এবং ‘এনামলিস্ট’ বা বৈসাদুশ্যবাদী দলের। প্রথমোক্তদের মতে ভাষা নিয়মিত এবং যুক্তিনির্ভর, তাঁদের বিশ্বাস শব্দের গঠন বা ধ্বণিরূপ এবং শব্দের অর্থরূপের মধ্যে একটা সম্পর্ক বা সামঞ্জস্য বিদ্যামান । অপরদিকে বৈসাদৃশ্যবাদীরা শব্দ ও শব্দের অর্থ বা তাৎপর্যের সংগঠনের মধ্যে আকৃতি বা প্রকৃতিগত সম্পর্কে বিশ্বাস করতেন না। তাঁরা ভাষার মধ্যে বিদ্যমান অনিয়ম ও শৃঙ্খলার অভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
সাদৃশ্যবাদী দার্শনিক হেরাক্লিটাসের (৫০০ খ্রি. পূ.) মতে মানব চিন্তার মধ্যে একটা ঐক্য রয়েছে এবং ভাষার মোল সংগঠন তার সঙ্গে সম্পর্কিত বৈসাদৃশ্যবাদী দার্শনিক ডেমোক্রিটাস (৪৬০-৩৬০ খ্রি. পূ.) ভাষার দৈব বা ঐশ্বরিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে সাদৃশ্যবাদীদের ধারণাকে খ-ন করার প্রয়াস পেয়েছেন। প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রি. পূ.) মনে করতেন এক একটি শব্দ এক একটি ধারণার বস্তুগত রূপ, যে ধারণা থেকে মানুষের জগৎ সম্পর্কিত জ্ঞানের সূত্রপাত। প্লেটোর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবাবেই গ্রিকরা সর্বপ্রথম ভাষার ব্যাকরণের শ্রেণীবিন্যাসের চেষ্টা করেন। যুক্তিবিদ্যা বা তর্কশাস্ত্রের প্রয়োগে প্লোটো বিশেষ্যের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, ‘যার সম্পর্কে কিছু বলা হয় সেটাই হলো বিশেষ্য’। পরবর্তীকালে প্রথাগত ব্যাকরণের ‘উদ্দেশ্য’র সংজ্ঞা প্লেটোর বিশেষ্যের সংজ্ঞার সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। ‘ক্রিয়া’ সম্পর্ক প্লেটের সংজ্ঞা, বিশেষ্য স¤পর্কে যা বলা হয় তা হলো ক্রিয়া, পরবর্তীকালে চলিত ব্যাকরণে ‘বিধেয়’র অনুরূপ সংজ্ঞাই নির্ণীত হয়েছিলো। এরিস্টল দার্শনিক জিজ্ঞাসার রীতিতে ব্যাকরণিত রূপসমূহ নির্ণয় করেছেন। বস্তু, গুণ, স্যখা, সম্পর্ক, অস্তিত্ব, পরিবর্তন ইত্যাদির ভিত্তিতে। তিনিই প্রথম পদের শ্রেণীবিন্যাস এবং ক্রিয়ার কাল জ্ঞাপকতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরিস্টল ‘বিশেষ্য’ ও ক্রিয়া’ কে একই শ্রেণিভূক্ত করেছিলেন, তাঁর যুক্তি ছিলো এই যে কেবলমাত্র ঐ দুই শ্রেণীর শব্দের নিজস্ব অর্থ বা তাৎপর্য রয়েছে। বাকী সব শ্রেণীর শব্দ শুধুমাত্র ভাষা ব্যবহারকারীর চিন্তার পারম্পর্য রক্ষার জন্যে ব্যবহৃত। এরিস্টটলের ধারণা মতে, ক্রিয়া তার কালজ্ঞাপক উপাদানের জন্যে আর সব শ্রেণীর শব্দ থেকে আলাদা; আর এই কারণেই ক্রিয়ার প্রাথমিক কাজ বিধেয়মূলক। আবশ্য তিনি ক্রিয়ার চেয়ে বিধেয়র ভূমিকা ব্যাপকতর মনে করতেন। তাঁর মতে‘উদ্দেশ্য সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় হচ্ছে বিধেয়।’ তিনি আরো মনে করতেন, যেহেতু মানুষকে গুণাগুণের ভিত্তিতে তারতম্য করা যায় এবং ‘বিশেষণ’ সেইসব গুণের নির্দেশক, সেই কারণে বিশেষণ প্রকৃতপক্ষে ক্রিয়া নয়, তা হলো বিধেয়। অর্থাৎ ক্রিয়া ছাড়াও বাক্য সম্ভব এবং বিধেয় প্রকৃত ক্রিয়া না হলেও চলে। এরিস্টটল বাক্যের সংজ্ঞা নির্ণয়েরও প্রয়াসী হয়েছিলেন। তিনি বাক্যকে এমন ধ্বনিসমম্বয় রূপে নির্দেশ করেছেন যার একটি নির্দিষ্ট ও সামগ্রিক অর্থ বা তাৎপর্য বর্তমান আবার সেই সঙ্গে বাক্যের প্রতিটি অংশের একটা নিজস্ব অর্থও থাকে।
গ্রিক উপনিবেশ আলোকজান্দ্রিয়াতে খ্রিস্টাপূর্ব তৃতীয় শতকে বিখ্যাত গ্রন্থগারটির প্রতিষ্ঠার পর সেখানে ভাষা গবেষণার একটি কেন্দ্র গড়ে ওঠে। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রিক প-িতেরা হোমার প্রমুখ প্রাচীন কবির রচিত সাহিত্যের পা-ুলিপির পাঠ সমালোচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। আলেকজান্দ্রিয়াতেই বিখ্যাত গ্রিক বৈয়াকরণ ডায়োনিসিয়াস থ্রাক্স (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষার্ধে) পাশ্চাত্য জগতের প্রথম কার্যকর ব্যাকরণ রচনা করেন। তিনি সর্বনাম, ক্রিয়াবিশেষণ, অসমাপিকা ও পদাদ্বয়ী অব্যয় চিহিৃত করেছিলেন। তাঁর ব্যাকরণে বিভিন্ন গ্রিক শব্দ কারক, লিঙ্গ, বচন, কাল, বাচ্য, ভাব ইত্যাদি রূপ বিন্যাস্ত হয়েছিলো। গ্রিক বৈয়াকরণেরাই প্রথম বিশেষ্য, সর্বনাম, ক্রিয়া,ক্রিয়াবিশেষণ, অসমাপিকা বা ক্রিয়াবচক বিশেষণ, উপসর্গ বা পদাস্বয়ী অব্যয়, সংযোজন অব্যয় এবং উপশব্দ বা নির্দেশক বিশ্লেষণ, এই আট প্রকার পদ চিহিৃত করেন। গ্রিক দার্শনিক-বৈয়াকরণেরা ধ্বনি, ব্যাকরণ এবং অর্থ ভাষার এই ত্রিবিধ বিষয়েই দৃষ্টিপাত করেছিলেন, তবে রূপতত্ত্বেই তাদের অধিকতর পারদর্শিতা অর্জিত হয়েছিলো। ভারতবর্ষে ব্যাকরণের ঐতিহ্য গ্রিক-রোমানদের ব্যাকরণ চর্চা থেকে স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ এবং অধিকতর ব্যাপক, গভীর ও উৎকৃষ্টভাবে গড়ে উঠেছিলো। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের সুবিখ্যাত বৈয়াকরণ পাণিনি তাঁর যেসব পূর্বসূরীর উল্লেখ করেছেন তাতে মনে হয় ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যাকরণ চর্চার ঐতিহ্য আরো কয়েক শতাব্দীর পুরাতন। ভারতীয় ব্যাকরণের ইতিহাসে বারোটি ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য বা মতাদর্শ এবং সহস্রাধিক প্রাচীন ব্যাকরণ পাওয়া গেছে। তবে যাদিও আর্য এবং গ্রিক- রোমান ব্যাকরণের উদ্ভব ও বিকাশ পরস্পর নিরপেক্ষ তবুও তাদের মধ্যে কিছু কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করা গেছে। আর্য প-িতদের মধ্যেও গ্রিক দার্শনিকদের মতো ভাষার ‘প্রাকৃত’ এবং ‘ঐতিহ্য’ গত ব্যুপত্তি নিয়ে মতভেদ ছিলো। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রিক প-িতদের মতো ভারতীয় প-িতেরাও প্রাচীন রচনায় পা-ুলিপি অধ্যায়ন ও বিশ্লেষণ, শব্দ তালিকা প্রণয়ন এবং প্রাচীন শব্দের ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে বিশদ টীকা ভাষ্য দিয়েছেন। সংস্কৃত বৈয়াকরণেরা প্লেটোর মতো বিশেষ্য ও ক্রিয়ার পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। তবে দুইটি ক্ষেত্রে ভারতীয় প-িতেরা তাঁদের ইউরোপীয় সতীর্থদের চেয়ে অনেক অগ্রসর ছিলেন, একটি ধ্বনিতত্ত্ব এবং অপরটি শব্দের অভ্যন্তরীণ সংগঠন বিশ্লেষণ বা রূপতত্ত্ব। সংস্কৃত ভাষাবিদেরা ধ্বনির শ্রেণীবিন্যাসে অধিকতর পুঙ্খানুপুঙ্খ, যথার্থ এবং বাস্তব পর্যবেক্ষণনির্ভর ছিলেন। খ্রিস্টর্পূর্ব শতকে ধ্বনিবিজ্ঞানে ভারতীয়দের ব্যুৎপত্তি ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা আয়ত্ত করতে পারেরনি; অন্তত পাণিনির সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের সঙ্গে পরিচয়ের পূর্বে নয়। ভাষার রূপগঠন বিশ্লেষণে পাণিনির ব্যাকরণ অদ্যাবধি পৃথিবীতে যে কোনো কালে যেকোনো ভাষার রচিত ব্যাকরণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত। পাণিনির ব্যাকরণ সম্পর্কে সাংগঠনিক ভাষাতত্ত্বের প্রধান পুরুষ ব্লুমফিল্ড তাঁর সুবিখ্যাত ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে লিখিছেন [ ব্লুমফিল্ড(১৯৩৩)] ‘পালিনির ব্যাকরণ, যা রচিত হয়েছিলো খ্রি.পূ. ৩৫০-২৫০ কালপরিধির মধ্যে, মানব মণীষার চরম উৎকর্ষের অন্যতম নিদর্শন।
প্রাচীন ভারতবর্ষে আর্য সমাজে বৈদিক ভাষার পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্যে অসংখ্য প-িত ভাষা ও ব্যাকরণ চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন; তারই ফলে সংস্কৃত ভাষা ব্যাকরণের বিকাশ। পাণিনি আর্য ভাষার সুসংস্কৃত রূপের যথার্থতা রক্ষার জন্যে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে যে ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন, তা বস্তুতপক্ষে চার সহস্র সুনির্দিষ্ট সূত্রের সাহায্যে সংস্কৃত ভাষার বর্ণনা। ভাষা যে একটি ব্যবস্থা, তার যে একটি কাঠামো বা সংগঠন রয়েছে, এ সম্পর্কে পাণিনির পূর্ণ ধারণা ছিলো। আধুনিক বর্ণনামূলক সাংগঠনিক ভাষাতত্ত্বে রূপতত্ত্ব বিশ্লেষণে ‘শূন্যরূপমূল’ সম্পর্কিত যে ধারণা বিদ্যামান, তার উদগাতা পাণিনি। ভাষার রূপ পর্যায়ে ধ্বনিপরিবর্তন এবং তার ফলে ব্যাকরণিক অর্থের পরিবর্তন সম্পর্কিত ‘রূপগদ ধ্বনিপরিবর্তন’ তত্ত্বের উদ্ভাবক পাণিনি। প্রাচীন ভারতীয় বৈয়াকরণেরা একটি রচনায় বিভিন্ন শব্দ ও অক্ষরের গাণিতিক সম্পর্ক বা পৌনঃ পুনিকতা সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন। ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে উচ্চারণ স্থান ও রীতির ভিত্তিতে ধ্বনির বিশ্লেষণ ও বর্ণনা তাঁরাই প্রথমে করেছিলেন। অভিধানশাস্ত্রে তাঁদের নৈপুণ্য ছিলো অপরিসীম।
রোমানরা শিল্প-সাহিত্যের মতো ভাষার আলোচনায় ছিলেন গ্রিকদের অন্ধ অনুসারী। রোমান অভিজাত শ্রেণী যেমন গৌরবের সঙ্গে গ্রিক সংস্কৃতির অনুকরণ করতেন, লাতিন প-িতেরা তেমনি ব্যাকরণ চর্চায় গ্রিক ব্যাকরণকে আদর্শ রূপে গ্রহণ করেছিলেন। ভ্যারোর লাতিন ভাষা বিশ্লেষণ ডায়োনিসিয়াস থ্রাক্স-এর গ্রিক ব্যাকরণের ছাঁচেই সম্পন্ন হয়েছিলো। লাতিন সাহিত্যের প্রাচীন যুগে লাতিন ভাষার বিশ্লেষণ গুরুত্ব পেয়েছিলো; এমনকি স্বয়ং জুলিয়াস সিজার ব্যাকরণের কোনো কোনো সমস্যা নিয়ে ভাবিত ছিলেন। লাতিন ভাষার আলোচনা ব্যাকরণে নিবদ্ধ হয় রোমক সম্রাজ্যের অবক্ষয়ের কালে। এ সময়কার বিখ্যাত লাতিন বৈয়াকরণ দোনোতুস ও প্রিসিয়ান। শেষাক্ত প-িত পাঁচশত খ্রিস্টব্দের দিকে একটি অষ্টাদশ খ- লাতিন ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। বলা বাহুল্য যে তাঁর আদর্শ ছিলো থ্রাক্স এবং এপল্লোনিয়াসের গ্রিক ব্যাকরণ। চতুর্থ শতাব্দীয় শেষ পর্যন্ত রোমান প-িতদের ভাষা আলোচনা লতিন ভাষার প্রাচীন পা-ুলিপি ও ছন্দ বিশ্লেষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো, ষষ্ঠ শতাব্দীর পর থেকে ভাষার অন্যান্য দিকেও তাঁদের দৃষ্টি পড়ে। ধ্বনি বিশ্লেষণ, অবক্ষরের প্রকৃতি পর্যালোচনা, পদ বিন্যাস এবং বাক্য বিশ্লেষণের চেষ্টা চলে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শব্দ গঠনের নিয়ামাবলি নির্দেশিত হয়, ক্রিয়া গঠনকারী উপাদানসমূহ সনাক্তকরণ এবং কারক বিশ্লেষণের সুত্রপাত ঘটে। মধ্যযুগের শেষে পাদের মধ্যে লাতিন বৈয়াকরণেরা ব্যাকরণের মৌলিক উপদান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভে সমর্থ হন। বিশেষ্যও বিশেষণের পার্থক্য সুর্নিদিষ্ট হয়, গৌণ বিশেষ্য স্থিত কারকের অর্থ নির্ণয়ে মুখ্য ক্রিয়ার গুরুত্ব স্বীকৃতি পায়।
মধ্যপ্রাচ্য আরবদের মধ্যে কোরআন শরিফকে কেন্দ্র করে ভাষাতাত্ত্বিক গবেঘণার সূত্রপাত ঘটে। আরব বৈয়াকরণেরাই প্রথম ভাষার একটি অংশের সঙ্গে তার বাক্যরীতি বা সংশ্লেষ ধর্মের সম্পর্ক নির্ণয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। কোরআন শরিফের শব্দাবলি যথার্থভাবে উচ্চারণ ও আবৃত্তির জন্য তাঁরা ধ্বনির উচ্চারণ ও শ্রুতির দিকে খুব মনযোগ দিয়েছিলেন। আরবরা অভিাধান রচনার পথপ্রদর্শক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধাবলী-৩ পারদর্শী। বিখ্যাত আরবি অভিধান প্রণেতা ফিরোজবাদী (১৩২৯-১৪১৪) একশত অভিধান রচনা করেছিলেন। আরবি ভাষাভাষী বিস্তৃত অঞ্চল থেকে শব্দ সংগৃহীত হতো বলে আরবি ভাষার শব্দ সংগৃহীত হতো বলে আরবি ভাষার শব্দভা-ার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আরবি অভিদান প্রণেতারা এই সুযোগের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন। তাঁরা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত ও অন্যান্য পার্থক্য উপেক্ষা করে সমার্থক শব্দগুলোকে একই শ্রেনী ও তালিকাভূক্ত করতেন। বিভিন্ন অঞ্চল, সময় উপভাষা এবং চলতি ও সাধুরীতি নির্বিশেষে শব্দ গৃহীত হয়েছে তাঁদের অভিধানে। ইহুদিরা ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি শিখেছেন আরবদের কাছ থেকে। ইহুদিরা ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি শিখেছেন আরবদের কাছ থেকে। ইহুদিদের হিব্রু ভাষা উদ্ভব ও বিবর্তনের ইতিহাস আরবি ও আরামিক ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং ভাষা তিনটির মধ্যে অনেকে সাদৃশ্য রয়েছে। ফলে ওই তিনটি ভাষার তুলনামূলক পর্যালোচনা করতে গিয়ে ইহুদি প-িতেরা তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতির পথপ্রদর্শক হয়েছেন। ইহুদি প-িতেরা আরবদের কাছে থেকে শেখা ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতির প্রয়োগ করেছেন বাইবেলের ভাষা বিশ্লেষণে। রেনেসার পূর্বে ইউরোপীয় প-িতেরা সেমেটিক জগতের ভাষাতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হননি, শব্দের ধাতু সম্পর্কিত ধারণা ইউরোপীয় ব্যাকরণে সেমেটিক ঐতিহ্য থেকেই গৃহীত হয়েছিলো। ইউরোপে রেনেসার সময়ে গ্রিক, হিব্রু এবং আরবি ভাষার ব্যাকরণসমূহ আগ্রহের সঙ্গে সঠিক হয়, হিব্রু ও আরবি ব্যাকরণের মাধ্যমে প্রাচ্য মনীষার সঙ্গে ইউরোপীয় প-িতদের প্রথম পরিচয় ঘটে। অবশ্য রেনেসার পূর্ব থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার ব্যাকরণ প্রণয়ন শুরু হয়েছিলো। আইরিশ ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনা সপ্তম শতাব্দীর,আইসল্যান্ডিক ভাষার দ্বাদশ শতাব্দীর এবং প্রভেন্সাল ভাষার ত্রয়োদশ শতাব্দীর ঘটনা। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে ব্যাকরণের তত্ত্বগত ভিত্তি ছিলো ভাষা সম্পর্কিত যুক্তিবিদ্যা ও দার্শনিক ধারণা। ফরাসি বৈয়াকরণেরা এ বিষয়ে অগ্রনী ছিলেন। পোর্ট রয়েলে ব্যাকরণ চর্চার যে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রটি গড়ে উঠেছিলো সেখানে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে খ্যাতনামা প-িত ল্যানস্লট এবং আরনলড তাঁদের সুবিখ্যাত বিশ্বজনীন ব্যাকরণ রচনা করেন। পোর্টরয়েলের প-িতদের মতে, ভাষার ব্যাকরণের অনুশাসন যুক্তিনির্ভর হওয়া প্রয়োজন। সমগ্র মানব সত্তার জন্যে যুক্তি হলো একক,অভিন্ন ও বিশ্বজনীন, সুতরাং এমন একটি সর্বজনীন ব্যাকরণতত্ত্ব উদ্ভাবন প্রয়োজন, যা পৃথিবীর সমস্ত ভাষার মৌলিক উপাদান সম্পর্কে প্রযোজ্য। এনসাইক্লোপেডিস্ট (১৭৫১-১৭৭৮) সমকালীন ফরাসি যুক্তিবাদীরা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যাবলির প্রতি যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে এবং বিশ্বজনীন ব্যাকরণ রচনায় উৎসাহী ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপে ভাষার সৃষ্টি বা উৎস সম্পর্কে বেশ চিন্তা-ভাবনা চলে। এমনও ধারণা করা হয় যে হজরত নূহের সময়কার মহাপ্লাবনের পরবর্তী হিব্রু হচ্ছে মানব সভ্যতার প্রাচীনতম ভাষা। এছাড়াও ভাষার সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক মনগড়া উদ্ভট তত্ত্ব দাঁড় করানো হয়। তবে এ সময়ে প্রথিবীর অসংখ্য ভাষার সংগঠন ও তার বিপুল বৈচিত্র্য সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পায়। অষ্টাদশ শথাব্দীর শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে দুইশত ভাষার অস্তিত্বের কথা জানা যায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভাষা-গবেষণার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী শতাব্দীর সর্বজনীন ব্যাকরণ রচনার প্রয়াস এবং ভাষা সংগঠনের মধ্যে যুক্তির পারম্পর্য অনুসন্ধান পরিত্যক্ত হয়। ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে এই শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে পাশ্চাত্য প-িতদের পরিচয়, পানিনির ব্যাকরণের সন্ধান লাভ এবং তুলনামূলক কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব। ইংরেজ প্রাচ্যবিদ্যা-বিশারদ স্যার উইলিয়াম জোনস-এর ধারণায় প্রথম তুলনামূলক- কালানুক্রমিক পদ্ধতির ধারণা প্রতিফলিত হয়। ইউরোপ ও এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভাষাগুলির মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ করে তাদের এক সাধারণ উৎস ও বংশগত সম্পর্ক অনুমান করে জোনস্ বলেছিলেন (৩ ফেব্রুয়ারি, ১৭৮৬-তে রয়েল এসিয়াটিক সোসাইটিতে প্রদত্ত ভাষণ): ‘সংস্কৃত ভাষার পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাস যাই হোক না কেন, এর সংগঠন বিস্ময়কর, গ্রিক ভাষার চেয়ে ও নিখুঁত, লাতিন ভাষার চেয়েও এ ভাষার রূপতত্ত্ব পরিণত এবং গ্রিক ও লাতিন উভয় ভাষার চেয়েও পরিশীলিত; অথচ ঐ দুই ভাষার সঙ্গেই সংস্কৃত ভাষার কি বিস্ময়কর সাদৃশ্য! এ সাদৃশ্য ক্রিয়ার ধাতুরূপ এবং ব্যাকরণ উভয় ক্ষেত্রেই এমন যে তা কোনোক্রমেই আকস্মিক হতে পারে না। এ সদৃশ্য এতই গভীর যে কোনো ভাষাতত্ত্ববিদই এই তিনটি ভাষা পরীক্ষা করে এ কথা বিশ্বাস না করে পারেন না যে ভাষা তিনটির উৎস এক ও অভিন্ন। সেই আদি ভাষার অস্তিত্ব সম্ভবত আজ নেই। একই কারণে খুব প্রবলভাবে না হলেও অনুমান করা যায় যে গথিক এবং কেল্টিক ভাষার… উদ্ভবও সংস্কৃতের উৎস থেকেই এবং প্রাচীন ফার্সি ভাষাকেও ওই বংশের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। (অসমাপ্ত)
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
(পূর্ব প্রকাশের পর)
উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল উটো-আজটেক ভাষাগোষ্ঠী। ওই বংশের নাহুয়াটল আজটেক সভ্যতার ভাষা ছিলো। দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ভাষা ছিলো মায়া-সাকো, যা মায়া সভ্যতার ভাষা। আরওয়াক শাখা এন্টিলেসে এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাংশ জুড়ে ছিলো। কাবিব ছিলো আমাজন নদীর উত্তরাঞ্চলের ভাষা আর কিচুয়া পেরুর ইনকা সভ্যতার ভাষা। পৃথিবীর ভাষাগোঠী সমূহের এই সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকে বোঝা যায়, এ বিশ্বে কতো অসংখ্য ও বিচিত্র ভাষা প্রচলিত, কতো ভাষা বিলুপ্ত আবার কতো ভাষা বিস্তৃত ভৌগোলিক অঞ্চলে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীতে প্রচলিত। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে অর্থাৎ কালানুক্রমিক-তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি উদ্ভবের পূর্বে পৃথিবীর অসংখ্য ভাষা এবং তাদের পারস্পারিক সম্পর্ক সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
বিশিষ্ট শাস্ত্র হিসেবে ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব ঊনবিংশ শতাব্দীর ঘটনা হলেও ব্যাকরণ শাস্ত্রের বিকাশ ঘটেছিলো বহু পূর্বে। জ্ঞানের অন্যান্য শাখার ন্যায় ভাষা বিশ্লেষণেও গ্রিকরা। অগ্রণী । তাঁরা ভাষা অধ্যয়ন করেছিলেন তাঁদের দার্শনিক চিন্তার পরিপূর্ণতার জন্য, যেখানে প্রাচীন ভারতবর্ষে ধর্মীয় কারণে আর্য প-িতেরা সংস্কৃত আর মধ্যযুগে ইউরোপে খ্রিস্টান বিদ্বদজনেরা লাতিন ভাষা চর্চা করেন। গ্রিকদের ভাষার ‘ব্যাকরণ’ তাঁদের দর্শনশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে বির্তক ছিলো ‘ভাষা’ কি ‘প্রকৃতি-শাসিত না ‘ঐতিহ্য লালিত। ভাষা যদি প্রাকৃতজ হয় তাহলে তার ঐশ্বরিক বা দৈব ব্যুৎপত্তি থাকার কথা আর তার উৎপত্তি সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে তা মানব সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত। এই বিতর্কেরই সম্প্রসারণ শব্দের গঠনের সঙ্গে শব্দের অর্থের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, সে জিজ্ঞাসা। এই বিতর্ক থেকেই ভাষার ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণের সূত্রপাত।
গ্রিকরা যেহেতু তাঁদের দর্শন চিন্তার সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে ভাষার উদ্ভব ও শব্দের ব্যুৎপত্তি অনুসন্ধানে রত হয়েছিলেন, সে কারণে তাঁরা ভাষার ভ্যাকরণ ব্যাখ্যার যুক্তি বা তর্কশাস্ত্রের সূত্রসমূহ প্রয়োগ করেছিলেন। ভাষা প্রকৃতি না ঐতিহ্যের দান সেই বিতর্ক থেকে সৃষ্টি হয়েছিলো ‘এনালজিস্ট’ বা সাদৃশ্যবাদী এবং ‘এনামলিস্ট’ বা বৈসাদুশ্যবাদী দলের। প্রথমোক্তদের মতে ভাষা নিয়মিত এবং যুক্তিনির্ভর, তাঁদের বিশ্বাস শব্দের গঠন বা ধ্বণিরূপ এবং শব্দের অর্থরূপের মধ্যে একটা সম্পর্ক বা সামঞ্জস্য বিদ্যামান । অপরদিকে বৈসাদৃশ্যবাদীরা শব্দ ও শব্দের অর্থ বা তাৎপর্যের সংগঠনের মধ্যে আকৃতি বা প্রকৃতিগত সম্পর্কে বিশ্বাস করতেন না। তাঁরা ভাষার মধ্যে বিদ্যমান অনিয়ম ও শৃঙ্খলার অভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
সাদৃশ্যবাদী দার্শনিক হেরাক্লিটাসের (৫০০ খ্রি. পূ.) মতে মানব চিন্তার মধ্যে একটা ঐক্য রয়েছে এবং ভাষার মোল সংগঠন তার সঙ্গে সম্পর্কিত বৈসাদৃশ্যবাদী দার্শনিক ডেমোক্রিটাস (৪৬০-৩৬০ খ্রি. পূ.) ভাষার দৈব বা ঐশ্বরিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে সাদৃশ্যবাদীদের ধারণাকে খ-ন করার প্রয়াস পেয়েছেন। প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রি. পূ.) মনে করতেন এক একটি শব্দ এক একটি ধারণার বস্তুগত রূপ, যে ধারণা থেকে মানুষের জগৎ সম্পর্কিত জ্ঞানের সূত্রপাত। প্লেটোর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবাবেই গ্রিকরা সর্বপ্রথম ভাষার ব্যাকরণের শ্রেণীবিন্যাসের চেষ্টা করেন। যুক্তিবিদ্যা বা তর্কশাস্ত্রের প্রয়োগে প্লোটো বিশেষ্যের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, ‘যার সম্পর্কে কিছু বলা হয় সেটাই হলো বিশেষ্য’। পরবর্তীকালে প্রথাগত ব্যাকরণের ‘উদ্দেশ্য’র সংজ্ঞা প্লেটোর বিশেষ্যের সংজ্ঞার সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। ‘ক্রিয়া’ সম্পর্ক প্লেটের সংজ্ঞা, বিশেষ্য স¤পর্কে যা বলা হয় তা হলো ক্রিয়া, পরবর্তীকালে চলিত ব্যাকরণে ‘বিধেয়’র অনুরূপ সংজ্ঞাই নির্ণীত হয়েছিলো। এরিস্টল দার্শনিক জিজ্ঞাসার রীতিতে ব্যাকরণিত রূপসমূহ নির্ণয় করেছেন। বস্তু, গুণ, স্যখা, সম্পর্ক, অস্তিত্ব, পরিবর্তন ইত্যাদির ভিত্তিতে। তিনিই প্রথম পদের শ্রেণীবিন্যাস এবং ক্রিয়ার কাল জ্ঞাপকতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরিস্টল ‘বিশেষ্য’ ও ক্রিয়া’ কে একই শ্রেণিভূক্ত করেছিলেন, তাঁর যুক্তি ছিলো এই যে কেবলমাত্র ঐ দুই শ্রেণীর শব্দের নিজস্ব অর্থ বা তাৎপর্য রয়েছে। বাকী সব শ্রেণীর শব্দ শুধুমাত্র ভাষা ব্যবহারকারীর চিন্তার পারম্পর্য রক্ষার জন্যে ব্যবহৃত। এরিস্টটলের ধারণা মতে, ক্রিয়া তার কালজ্ঞাপক উপাদানের জন্যে আর সব শ্রেণীর শব্দ থেকে আলাদা; আর এই কারণেই ক্রিয়ার প্রাথমিক কাজ বিধেয়মূলক। আবশ্য তিনি ক্রিয়ার চেয়ে বিধেয়র ভূমিকা ব্যাপকতর মনে করতেন। তাঁর মতে‘উদ্দেশ্য সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় হচ্ছে বিধেয়।’ তিনি আরো মনে করতেন, যেহেতু মানুষকে গুণাগুণের ভিত্তিতে তারতম্য করা যায় এবং ‘বিশেষণ’ সেইসব গুণের নির্দেশক, সেই কারণে বিশেষণ প্রকৃতপক্ষে ক্রিয়া নয়, তা হলো বিধেয়। অর্থাৎ ক্রিয়া ছাড়াও বাক্য সম্ভব এবং বিধেয় প্রকৃত ক্রিয়া না হলেও চলে। এরিস্টটল বাক্যের সংজ্ঞা নির্ণয়েরও প্রয়াসী হয়েছিলেন। তিনি বাক্যকে এমন ধ্বনিসমম্বয় রূপে নির্দেশ করেছেন যার একটি নির্দিষ্ট ও সামগ্রিক অর্থ বা তাৎপর্য বর্তমান আবার সেই সঙ্গে বাক্যের প্রতিটি অংশের একটা নিজস্ব অর্থও থাকে।
গ্রিক উপনিবেশ আলোকজান্দ্রিয়াতে খ্রিস্টাপূর্ব তৃতীয় শতকে বিখ্যাত গ্রন্থগারটির প্রতিষ্ঠার পর সেখানে ভাষা গবেষণার একটি কেন্দ্র গড়ে ওঠে। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রিক প-িতেরা হোমার প্রমুখ প্রাচীন কবির রচিত সাহিত্যের পা-ুলিপির পাঠ সমালোচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। আলেকজান্দ্রিয়াতেই বিখ্যাত গ্রিক বৈয়াকরণ ডায়োনিসিয়াস থ্রাক্স (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষার্ধে) পাশ্চাত্য জগতের প্রথম কার্যকর ব্যাকরণ রচনা করেন। তিনি সর্বনাম, ক্রিয়াবিশেষণ, অসমাপিকা ও পদাদ্বয়ী অব্যয় চিহিৃত করেছিলেন। তাঁর ব্যাকরণে বিভিন্ন গ্রিক শব্দ কারক, লিঙ্গ, বচন, কাল, বাচ্য, ভাব ইত্যাদি রূপ বিন্যাস্ত হয়েছিলো। গ্রিক বৈয়াকরণেরাই প্রথম বিশেষ্য, সর্বনাম, ক্রিয়া,ক্রিয়াবিশেষণ, অসমাপিকা বা ক্রিয়াবচক বিশেষণ, উপসর্গ বা পদাস্বয়ী অব্যয়, সংযোজন অব্যয় এবং উপশব্দ বা নির্দেশক বিশ্লেষণ, এই আট প্রকার পদ চিহিৃত করেন। গ্রিক দার্শনিক-বৈয়াকরণেরা ধ্বনি, ব্যাকরণ এবং অর্থ ভাষার এই ত্রিবিধ বিষয়েই দৃষ্টিপাত করেছিলেন, তবে রূপতত্ত্বেই তাদের অধিকতর পারদর্শিতা অর্জিত হয়েছিলো। ভারতবর্ষে ব্যাকরণের ঐতিহ্য গ্রিক-রোমানদের ব্যাকরণ চর্চা থেকে স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ এবং অধিকতর ব্যাপক, গভীর ও উৎকৃষ্টভাবে গড়ে উঠেছিলো। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের সুবিখ্যাত বৈয়াকরণ পাণিনি তাঁর যেসব পূর্বসূরীর উল্লেখ করেছেন তাতে মনে হয় ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যাকরণ চর্চার ঐতিহ্য আরো কয়েক শতাব্দীর পুরাতন। ভারতীয় ব্যাকরণের ইতিহাসে বারোটি ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য বা মতাদর্শ এবং সহস্রাধিক প্রাচীন ব্যাকরণ পাওয়া গেছে। তবে যাদিও আর্য এবং গ্রিক- রোমান ব্যাকরণের উদ্ভব ও বিকাশ পরস্পর নিরপেক্ষ তবুও তাদের মধ্যে কিছু কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করা গেছে। আর্য প-িতদের মধ্যেও গ্রিক দার্শনিকদের মতো ভাষার ‘প্রাকৃত’ এবং ‘ঐতিহ্য’ গত ব্যুপত্তি নিয়ে মতভেদ ছিলো। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রিক প-িতদের মতো ভারতীয় প-িতেরাও প্রাচীন রচনায় পা-ুলিপি অধ্যায়ন ও বিশ্লেষণ, শব্দ তালিকা প্রণয়ন এবং প্রাচীন শব্দের ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে বিশদ টীকা ভাষ্য দিয়েছেন। সংস্কৃত বৈয়াকরণেরা প্লেটোর মতো বিশেষ্য ও ক্রিয়ার পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। তবে দুইটি ক্ষেত্রে ভারতীয় প-িতেরা তাঁদের ইউরোপীয় সতীর্থদের চেয়ে অনেক অগ্রসর ছিলেন, একটি ধ্বনিতত্ত্ব এবং অপরটি শব্দের অভ্যন্তরীণ সংগঠন বিশ্লেষণ বা রূপতত্ত্ব। সংস্কৃত ভাষাবিদেরা ধ্বনির শ্রেণীবিন্যাসে অধিকতর পুঙ্খানুপুঙ্খ, যথার্থ এবং বাস্তব পর্যবেক্ষণনির্ভর ছিলেন। খ্রিস্টর্পূর্ব শতকে ধ্বনিবিজ্ঞানে ভারতীয়দের ব্যুৎপত্তি ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা আয়ত্ত করতে পারেরনি; অন্তত পাণিনির সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের সঙ্গে পরিচয়ের পূর্বে নয়। ভাষার রূপগঠন বিশ্লেষণে পাণিনির ব্যাকরণ অদ্যাবধি পৃথিবীতে যে কোনো কালে যেকোনো ভাষার রচিত ব্যাকরণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত। পাণিনির ব্যাকরণ সম্পর্কে সাংগঠনিক ভাষাতত্ত্বের প্রধান পুরুষ ব্লুমফিল্ড তাঁর সুবিখ্যাত ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে লিখিছেন [ ব্লুমফিল্ড(১৯৩৩)] ‘পালিনির ব্যাকরণ, যা রচিত হয়েছিলো খ্রি.পূ. ৩৫০-২৫০ কালপরিধির মধ্যে, মানব মণীষার চরম উৎকর্ষের অন্যতম নিদর্শন।
প্রাচীন ভারতবর্ষে আর্য সমাজে বৈদিক ভাষার পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্যে অসংখ্য প-িত ভাষা ও ব্যাকরণ চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন; তারই ফলে সংস্কৃত ভাষা ব্যাকরণের বিকাশ। পাণিনি আর্য ভাষার সুসংস্কৃত রূপের যথার্থতা রক্ষার জন্যে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে যে ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন, তা বস্তুতপক্ষে চার সহস্র সুনির্দিষ্ট সূত্রের সাহায্যে সংস্কৃত ভাষার বর্ণনা। ভাষা যে একটি ব্যবস্থা, তার যে একটি কাঠামো বা সংগঠন রয়েছে, এ সম্পর্কে পাণিনির পূর্ণ ধারণা ছিলো। আধুনিক বর্ণনামূলক সাংগঠনিক ভাষাতত্ত্বে রূপতত্ত্ব বিশ্লেষণে ‘শূন্যরূপমূল’ সম্পর্কিত যে ধারণা বিদ্যামান, তার উদগাতা পাণিনি। ভাষার রূপ পর্যায়ে ধ্বনিপরিবর্তন এবং তার ফলে ব্যাকরণিক অর্থের পরিবর্তন সম্পর্কিত ‘রূপগদ ধ্বনিপরিবর্তন’ তত্ত্বের উদ্ভাবক পাণিনি। প্রাচীন ভারতীয় বৈয়াকরণেরা একটি রচনায় বিভিন্ন শব্দ ও অক্ষরের গাণিতিক সম্পর্ক বা পৌনঃ পুনিকতা সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন। ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে উচ্চারণ স্থান ও রীতির ভিত্তিতে ধ্বনির বিশ্লেষণ ও বর্ণনা তাঁরাই প্রথমে করেছিলেন। অভিধানশাস্ত্রে তাঁদের নৈপুণ্য ছিলো অপরিসীম।
রোমানরা শিল্প-সাহিত্যের মতো ভাষার আলোচনায় ছিলেন গ্রিকদের অন্ধ অনুসারী। রোমান অভিজাত শ্রেণী যেমন গৌরবের সঙ্গে গ্রিক সংস্কৃতির অনুকরণ করতেন, লাতিন প-িতেরা তেমনি ব্যাকরণ চর্চায় গ্রিক ব্যাকরণকে আদর্শ রূপে গ্রহণ করেছিলেন। ভ্যারোর লাতিন ভাষা বিশ্লেষণ ডায়োনিসিয়াস থ্রাক্স-এর গ্রিক ব্যাকরণের ছাঁচেই সম্পন্ন হয়েছিলো। লাতিন সাহিত্যের প্রাচীন যুগে লাতিন ভাষার বিশ্লেষণ গুরুত্ব পেয়েছিলো; এমনকি স্বয়ং জুলিয়াস সিজার ব্যাকরণের কোনো কোনো সমস্যা নিয়ে ভাবিত ছিলেন। লাতিন ভাষার আলোচনা ব্যাকরণে নিবদ্ধ হয় রোমক সম্রাজ্যের অবক্ষয়ের কালে। এ সময়কার বিখ্যাত লাতিন বৈয়াকরণ দোনোতুস ও প্রিসিয়ান। শেষাক্ত প-িত পাঁচশত খ্রিস্টব্দের দিকে একটি অষ্টাদশ খ- লাতিন ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। বলা বাহুল্য যে তাঁর আদর্শ ছিলো থ্রাক্স এবং এপল্লোনিয়াসের গ্রিক ব্যাকরণ। চতুর্থ শতাব্দীয় শেষ পর্যন্ত রোমান প-িতদের ভাষা আলোচনা লতিন ভাষার প্রাচীন পা-ুলিপি ও ছন্দ বিশ্লেষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো, ষষ্ঠ শতাব্দীর পর থেকে ভাষার অন্যান্য দিকেও তাঁদের দৃষ্টি পড়ে। ধ্বনি বিশ্লেষণ, অবক্ষরের প্রকৃতি পর্যালোচনা, পদ বিন্যাস এবং বাক্য বিশ্লেষণের চেষ্টা চলে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শব্দ গঠনের নিয়ামাবলি নির্দেশিত হয়, ক্রিয়া গঠনকারী উপাদানসমূহ সনাক্তকরণ এবং কারক বিশ্লেষণের সুত্রপাত ঘটে। মধ্যযুগের শেষে পাদের মধ্যে লাতিন বৈয়াকরণেরা ব্যাকরণের মৌলিক উপদান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভে সমর্থ হন। বিশেষ্যও বিশেষণের পার্থক্য সুর্নিদিষ্ট হয়, গৌণ বিশেষ্য স্থিত কারকের অর্থ নির্ণয়ে মুখ্য ক্রিয়ার গুরুত্ব স্বীকৃতি পায়।
মধ্যপ্রাচ্য আরবদের মধ্যে কোরআন শরিফকে কেন্দ্র করে ভাষাতাত্ত্বিক গবেঘণার সূত্রপাত ঘটে। আরব বৈয়াকরণেরাই প্রথম ভাষার একটি অংশের সঙ্গে তার বাক্যরীতি বা সংশ্লেষ ধর্মের সম্পর্ক নির্ণয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। কোরআন শরিফের শব্দাবলি যথার্থভাবে উচ্চারণ ও আবৃত্তির জন্য তাঁরা ধ্বনির উচ্চারণ ও শ্রুতির দিকে খুব মনযোগ দিয়েছিলেন। আরবরা অভিাধান রচনার পথপ্রদর্শক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধাবলী-৩ পারদর্শী। বিখ্যাত আরবি অভিধান প্রণেতা ফিরোজবাদী (১৩২৯-১৪১৪) একশত অভিধান রচনা করেছিলেন। আরবি ভাষাভাষী বিস্তৃত অঞ্চল থেকে শব্দ সংগৃহীত হতো বলে আরবি ভাষার শব্দ সংগৃহীত হতো বলে আরবি ভাষার শব্দভা-ার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আরবি অভিদান প্রণেতারা এই সুযোগের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন। তাঁরা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত ও অন্যান্য পার্থক্য উপেক্ষা করে সমার্থক শব্দগুলোকে একই শ্রেনী ও তালিকাভূক্ত করতেন। বিভিন্ন অঞ্চল, সময় উপভাষা এবং চলতি ও সাধুরীতি নির্বিশেষে শব্দ গৃহীত হয়েছে তাঁদের অভিধানে। ইহুদিরা ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি শিখেছেন আরবদের কাছ থেকে। ইহুদিরা ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি শিখেছেন আরবদের কাছ থেকে। ইহুদিদের হিব্রু ভাষা উদ্ভব ও বিবর্তনের ইতিহাস আরবি ও আরামিক ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং ভাষা তিনটির মধ্যে অনেকে সাদৃশ্য রয়েছে। ফলে ওই তিনটি ভাষার তুলনামূলক পর্যালোচনা করতে গিয়ে ইহুদি প-িতেরা তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতির পথপ্রদর্শক হয়েছেন। ইহুদি প-িতেরা আরবদের কাছে থেকে শেখা ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতির প্রয়োগ করেছেন বাইবেলের ভাষা বিশ্লেষণে। রেনেসার পূর্বে ইউরোপীয় প-িতেরা সেমেটিক জগতের ভাষাতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হননি, শব্দের ধাতু সম্পর্কিত ধারণা ইউরোপীয় ব্যাকরণে সেমেটিক ঐতিহ্য থেকেই গৃহীত হয়েছিলো। ইউরোপে রেনেসার সময়ে গ্রিক, হিব্রু এবং আরবি ভাষার ব্যাকরণসমূহ আগ্রহের সঙ্গে সঠিক হয়, হিব্রু ও আরবি ব্যাকরণের মাধ্যমে প্রাচ্য মনীষার সঙ্গে ইউরোপীয় প-িতদের প্রথম পরিচয় ঘটে। অবশ্য রেনেসার পূর্ব থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার ব্যাকরণ প্রণয়ন শুরু হয়েছিলো। আইরিশ ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনা সপ্তম শতাব্দীর,আইসল্যান্ডিক ভাষার দ্বাদশ শতাব্দীর এবং প্রভেন্সাল ভাষার ত্রয়োদশ শতাব্দীর ঘটনা। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে ব্যাকরণের তত্ত্বগত ভিত্তি ছিলো ভাষা সম্পর্কিত যুক্তিবিদ্যা ও দার্শনিক ধারণা। ফরাসি বৈয়াকরণেরা এ বিষয়ে অগ্রনী ছিলেন। পোর্ট রয়েলে ব্যাকরণ চর্চার যে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রটি গড়ে উঠেছিলো সেখানে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে খ্যাতনামা প-িত ল্যানস্লট এবং আরনলড তাঁদের সুবিখ্যাত বিশ্বজনীন ব্যাকরণ রচনা করেন। পোর্টরয়েলের প-িতদের মতে, ভাষার ব্যাকরণের অনুশাসন যুক্তিনির্ভর হওয়া প্রয়োজন। সমগ্র মানব সত্তার জন্যে যুক্তি হলো একক,অভিন্ন ও বিশ্বজনীন, সুতরাং এমন একটি সর্বজনীন ব্যাকরণতত্ত্ব উদ্ভাবন প্রয়োজন, যা পৃথিবীর সমস্ত ভাষার মৌলিক উপাদান সম্পর্কে প্রযোজ্য। এনসাইক্লোপেডিস্ট (১৭৫১-১৭৭৮) সমকালীন ফরাসি যুক্তিবাদীরা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যাবলির প্রতি যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে এবং বিশ্বজনীন ব্যাকরণ রচনায় উৎসাহী ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপে ভাষার সৃষ্টি বা উৎস সম্পর্কে বেশ চিন্তা-ভাবনা চলে। এমনও ধারণা করা হয় যে হজরত নূহের সময়কার মহাপ্লাবনের পরবর্তী হিব্রু হচ্ছে মানব সভ্যতার প্রাচীনতম ভাষা। এছাড়াও ভাষার সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক মনগড়া উদ্ভট তত্ত্ব দাঁড় করানো হয়। তবে এ সময়ে প্রথিবীর অসংখ্য ভাষার সংগঠন ও তার বিপুল বৈচিত্র্য সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পায়। অষ্টাদশ শথাব্দীর শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে দুইশত ভাষার অস্তিত্বের কথা জানা যায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভাষা-গবেষণার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী শতাব্দীর সর্বজনীন ব্যাকরণ রচনার প্রয়াস এবং ভাষা সংগঠনের মধ্যে যুক্তির পারম্পর্য অনুসন্ধান পরিত্যক্ত হয়। ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে এই শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে পাশ্চাত্য প-িতদের পরিচয়, পানিনির ব্যাকরণের সন্ধান লাভ এবং তুলনামূলক কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব। ইংরেজ প্রাচ্যবিদ্যা-বিশারদ স্যার উইলিয়াম জোনস-এর ধারণায় প্রথম তুলনামূলক- কালানুক্রমিক পদ্ধতির ধারণা প্রতিফলিত হয়। ইউরোপ ও এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভাষাগুলির মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ করে তাদের এক সাধারণ উৎস ও বংশগত সম্পর্ক অনুমান করে জোনস্ বলেছিলেন (৩ ফেব্রুয়ারি, ১৭৮৬-তে রয়েল এসিয়াটিক সোসাইটিতে প্রদত্ত ভাষণ): ‘সংস্কৃত ভাষার পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাস যাই হোক না কেন, এর সংগঠন বিস্ময়কর, গ্রিক ভাষার চেয়ে ও নিখুঁত, লাতিন ভাষার চেয়েও এ ভাষার রূপতত্ত্ব পরিণত এবং গ্রিক ও লাতিন উভয় ভাষার চেয়েও পরিশীলিত; অথচ ঐ দুই ভাষার সঙ্গেই সংস্কৃত ভাষার কি বিস্ময়কর সাদৃশ্য! এ সাদৃশ্য ক্রিয়ার ধাতুরূপ এবং ব্যাকরণ উভয় ক্ষেত্রেই এমন যে তা কোনোক্রমেই আকস্মিক হতে পারে না। এ সদৃশ্য এতই গভীর যে কোনো ভাষাতত্ত্ববিদই এই তিনটি ভাষা পরীক্ষা করে এ কথা বিশ্বাস না করে পারেন না যে ভাষা তিনটির উৎস এক ও অভিন্ন। সেই আদি ভাষার অস্তিত্ব সম্ভবত আজ নেই। একই কারণে খুব প্রবলভাবে না হলেও অনুমান করা যায় যে গথিক এবং কেল্টিক ভাষার… উদ্ভবও সংস্কৃতের উৎস থেকেই এবং প্রাচীন ফার্সি ভাষাকেও ওই বংশের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। (অসমাপ্ত)