কাজিরবাজার ডেস্ক :
২০১৪ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। ইয়েমেনের সাআদা রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সবার নজরে আসে হুথি বিদ্রোহীরা। দেশটির রাজধানী সানাও নিয়ন্ত্রণে নেয় তারা। ফলে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আব্দরাব্বু মানসুর হাদি স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন।
এরপর ২০১৫ সালের মার্চে সৌদি সামরিক জোট হুথিদের দমন করে হাদি সরকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালায়। তাদের এ কাজে সহায়তা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তখন থেকে শুরু হওয়া সংঘাতে দেশটিতে এখন পর্যন্ত বহু মানুষ নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছেন দেশটির সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
তবে রমজান এলে অনেকটা স্বাভাবিক জীবন করতেন ইয়েমেনের মুসল্লিরা। পবিত্র রমজান মাস শেষে ঈদ উৎসবে সামিল হতেন তারা। এমন একটি সময় ছিল যখন ইয়েমেনিরা খাবার ভাগাভাগি করে নিতো পবিত্র রমজান মাসে। যারা রোজা ভাঙতে চায় তাদের জন্য রাস্তার পাশে খাবার টেবিল সাজিয়ে রাখা হতো এবং একে অপরের বাড়িতে ইফতার পাঠাতো।
কিন্তু এবছরের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে দেশটিতে খাদ্য সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। ইয়েমেন বিশেষজ্ঞ রিয়াদ দোমাজেটি বলেছেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি ইয়েমেনের অবস্থা আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাবে এবং ইয়েমেনকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে।
ইয়েমেন ৪২ শতাংশ খাদ্যশস্য আমদানি করে মাত্র দুটি দেশ থেকে। আর এই দেশ দুটি হলো ইউক্রেন এবং রাশিয়া। এসব দেশ থেকে গম ও ভুট্টা নেয় তারা। রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বে গমের মতো খাদ্যশস্য রপ্তানির শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর রপ্তানি বন্ধ। এতে বিপাকে পড়েছে মধ্য-পূর্বাঞ্চলসহ আফ্রিকান দেশগুলো।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের বহু মানুষের মতো ইয়েমেনিদের ডায়েট চার্টে রুটি অন্যতম। অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায়, সরকার বিভিন্ন রাষ্ট্রচালিত সংস্থার জন্য কাজ করে এমন লোকদের মধ্যে মজুরি বণ্টন করতে পারছে না।
অথচ বেশির ভাগ ইয়েমেনি সরকারি চাকরির ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে হুথিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলোতে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাবও পড়েছে দেশটির সাধারণ মানুষের ওপর।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, দেশটির প্রায় আড়াই লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশটির সব ধরনের মানুষ সংকটে পড়েছেন, এমনকি যারা পবিত্র রমজান মাসে অন্যদের সেবায় অর্থ খরচ করেন তারাও।
সম্প্রতি মাজিদ ইয়াসিন নামে এক ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্ট জানান, দেশে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। তাই তিনি অন্যদের এবছর রমজানের কোনো সহযোগিতা করতে পারছেন না। অথচ তার একটি সংগঠন ইবি অঞ্চলে গতবছরও খাদ্যপণ্য বিতরণ করেছিল।
একইভাবে রাজধানী সানার একটি বৃহৎ খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র বলছে যে, তারা গত বছর তিন হাজারের বেশি পরিবারের তুলনায় মাত্র পাঁচশ পরিবারকে খাওয়াতে পারছে এবারের রমজানে।
গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটি এখন দুভাগে বিভক্ত। ফলে বিদেশি খাদ্য সরবরাহের কাজও ব্যহত হচ্ছে। তার্কিশ হিউম্যানিটেরিয়ান রিলিফ ফাউন্ডেশনের (আইএইচএইচ) মিডল ইস্ট ডেস্কের প্রধান উমুত বিলজিন বলেন, এটি আসলে গুরুতর সংকট তৈরি করেছে ইয়েমেনে। দুভার্গজনক ঘটনা যে, দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছানোর আগেই কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য বন্দরেই বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বারা জব্দ হয়।
গৃহযুদ্ধের আগেও ইয়েমেন দরিদ্র দেশ ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। দীর্ঘদিন ধরে চলা সহিংসতার কারণে লাখ লাখ মানুষ মরুভূমিতে তাঁবু টাঙিয়ে এবং রাস্তার ধারে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের মানবিক সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।