হাওরে বাঁধ নির্মাণ কাজ টাকা ছাড়া মেলে না ॥ কাজ হয় ২৫-৩০ শতাংশ

16

কাজিরবাজার ডেস্ক :
‘খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম উপাদান ধান’, হাওরের নিরাপত্তায় হাওর রক্ষা বাঁধ। আর এই হাওর রক্ষার দায়িত্ব যাদের হাতে তারাই যেখানে অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বলে অভিযোগ সেখানে নীতিমালা সংশোধন কিংবা পদ্ধতি পরিবর্তন যাই করা হোক কৃষকের ফসল হারানোর বিলাপ থাকবেই। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে কৃষকের আর্তনাদ ও এর পেছনে লুটপাটের খন্ড খন্ড চিত্র। সুনামগঞ্জের হাওরে হাওরে বাঁধ দেয়াই হয় আগাম বন্যা ও পাহাড়ী ঢল ঠেকাতে। যে বছরগুলোতে আগাম বন্যা কিংবা পাহাড়ী ঢল থাকে না অথবা কম থাকে সেই বছরে বাম্পার ফসল উঠে কৃষকের ঘরে। বাহবা নেন কর্তৃপক্ষ। বরাদ্দের শতকোটি টাকা জায়েজ হয়ে যায়। ২০১৭ সালে সুনামগঞ্জে সব হাওরের শতভাগ ফসল আগাম বন্যা ও পাহাড়ী ঢলে তলিয়ে যায়। হাওরের ঘরে ঘরে কৃষকের করুণ আর্তনাদ দেখতে ছুটে আসেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। হয় নীতিমালা পরিবর্তন। হাওরের ঘরে ঘরে দেয়া হয় সাবা বছর খাবার। সেখানেও অনিয়ম-দুর্নীতি পিছু ছাড়েনি। তবুও বেশিরভাগ কৃষক কৃতজ্ঞ ছিল সরকারে প্রতি।
সংশোধিত নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গঠিত হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসির) মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ। পিআইসি গঠিত হবে সুবিধাভোগী কৃষকদের মধ্য থেকে গণশুনানির মাধ্যমে। প্রকল্প নেয়ার কথা হাওরে যাদের জমি আছে তাদের নিয়ে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নীতিমালা মানা হয়েছে কাগজে-কলমে। বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। প্রথমদিকে সংশোধিত নীতিমালা কিছুটা প্রভাব ফেললেও এবার (২০২২ সালে) হয়েছে নির্লজ্জ। অভিযোগ আছে, পিআইসি গঠন প্রকৃয়ায় যুক্ত যাঁরা তারাই বাঁধের বরাদ্দের টাকা ভাগাভাগিতে লিপ্ত। এমনকি বাঁধের দেখভাল ও তাদারকি যাদের হাতে তারাই মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পিআইসি ও মনিটরিং কমিটিসহ সবকিছু।
যাদের কল্যাণে/আশীর্বাদে প্রকল্প পেতে হয় তাঁরা নগদ (আগাম উৎকোচ) গ্রহণের মাধ্যমে প্রকল্প দেন সকল নিয়ম-নীতির ঊর্ধ্বে উঠে। এই সিন্ডিকেটে যুক্ত স্বয়ং মন্ত্রী-এমপির পিএস, জেলা-উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা, স্থনীয় জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা। অভিযোগ আছে, মন্ত্রণালয় থেকে ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার পর্যন্ত আসতে আসতে প্রকল্পের বরাদ্দ ভাগাভাগি হয়ে পিআইসি পর্যন্ত পৌঁছাতে দুই-তৃতীয়াংশ চলে যায়। কাজ হয় ২৫-৩০ শতাংশ।
উদাহরণ দেয়ার মতো অনেকগুলোর অন্যতম দোয়ারাবাজার উপজেলায় এক এখলাসুর রহমান ফরায়েজী ও তার পরিবারকে দেয়া হয়েছে, ১১টি প্রকল্প। এরকম অনিয়মের শত প্রকল্পের তালিকা হয় ডিও লেটারে কিংবা সিন্ডিকেটের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে। গণমাধ্যমে যেন এসব খবর না আসে তাই উপজেলায় উপজেলায় দেয়া হয় স্থানীয় সাংবাদিক ও তাদের মাঝে পিআইসি। মন্ত্রী-এমপির পিএস পাঠান পিআইসি গঠনের তালিকা। উপেক্ষিত হয় গণশুনানির লোক দেখানো আয়োজন। কাজ শুরু হওয়ার কথা ১৫ ডিসেম্বর কোথাও কোথাও কাজ ধরা হয় তিন মাস পর ১৯ মার্চ। এসব কিছু হয় সিন্ডকেট নিয়ন্ত্রিত লোকদের মাধ্যমে। তাদের আশীর্বাদপুষ্টদের দ্বারা। নীতিমালা অনুযায়ী পিআইসি কমিটির তালিকা পাউবো ও জেলা-উপজেলা প্রশাসনের ওয়েব পেইজে ১৫ ডিসেম্বরের পূর্বে দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয়নি জানুয়ারির মাঝামাঝিতেও। এমনকি কোন কোন তালিকা অদৃশ্য কারণে ফেব্রুয়ারিতেও আপলোড করা হয়নি।
দিরাইয়ে বাঁধ ‘সিন্ডিকেটের’ নেতৃত্বে আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায়। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে পিআইসি থাকলেও এসব তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রদীপ রায় অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘বাঁধের কাজের পিআইসি গঠন বা কাজ করার মূল দায়িত্বে থাকেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও পাউবোর কর্মকর্তারা। আমরা যেহেতু রাজনীতি করি, তাই কারও জন্য সুপারিশ করতে পারি। আমরা বললেই কাউকে কাজ দিতে হবে কেন? কাজ তো দেয়া হবে নীতিমালা মেনে।
শুধু দিরাইয়ে নয়, এর আগে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীমের কাছে ধর্মপাশার নেতারা পিআইসি ‘বেচেন’ বলে অভিযোগ করেন কৃষক। উপজেলার ডুবে যাওয়া চন্দ্র সোনার তাল হাওড় পরিদর্শনে গিয়েছিলেন উপমন্ত্রী। ওই কৃষক বলেন, ‘যত পিআইসি আছে, সবার কাছ থিকা এক লাখ টাকা করে নিয়া কাজ দিছে। নেতারাই এই টাকা নিছে। রোকন, বিলকিছ, আলমগীর, রাসেল সব নেতারাই কাজ বেচে। যে টাকা বেশি দেয়, তারেই কাজ দেয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষক যে রোকনের নাম উল্লেখ করেছেন, তিনি স্থানীয় এমপি মোয়াজ্জেম হোসেনের ছোট ভাই, ধর্মপাশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন ওরফে রোকন। একটি পিআইসির বিপরীতে রোকন তাঁর এক প্রতিনিধির মাধ্যমে তিন লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন জয়শ্রী ইউনিয়নের বাদে হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা উজ্জ্বল মিয়া। ৫ এপ্রিল তিনি (উজ্জ্বল মিয়া) কাজের বিল হিসেবে ৩ লাখ ৬ হাজার ৭০০ টাকা ব্যাংক থেকে তোলার পর ব্যাংক থেকেই ওই টাকা নিয়ে গেছেন রোকনের প্রতিনিধি মুখলেছুর রহমান তালুকদার। এ বিষয়ে তিনি গত শনিবার ধর্মপাশা থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এরকম দেয়ার মতো উদাহরণ আছে আরও শত শত।
হাওড়ে বাঁধের কাজের নীতিমালা অনুযায়ী, স্থানীয় কৃষক ও সুবিধাভোগীদের নিয়ে পাঁচ থেকে সাত সদস্যের এসব পিআইসি গঠন করা হয়। একটি পিআইসি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার কাজ করতে পারে। এবার সুনামগঞ্জে ৭২৭টি প্রকল্পে ৭২৭টি পিআইসির অধীনে ১২২ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী প্রকল্প প্রস্তুত, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কাজের সমন্বয়ের জন্য জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি রয়েছে। আছে উপজেলা পর্যায়েও ইউএনও সভাপতি, পাউবোর একজন প্রকৌশলী সদস্য সচিব কমিটি। পিআইসিগুলোর কাজ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করে পূর্বোক্ত একই উপজেলা কমিটি। দেখা গেছে এসব মনিটরিং করে মূলত সিন্ডিকেটভুক্ত প্রভাবশালীরা।
এ ব্যাপারে ঢাকা থেকে মুঠোফোনে সুনামগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ জহুরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পিআইসি গঠন ও কার্যক্রম সংক্রান্ত বিষয়ে উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটি আছে। এটি তারা নিয়ন্ত্রণ করেন। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।
সুনামগঞ্জের হাওরে হাওরে বাঁধ ভেঙ্গে ফসলডুবির খবর দিন দিন বড় হচ্ছে। সবশেষ রবিবার ভোরে তলিয়ে গেল জেলার শাল্লা উপজেলা অন্যতম বড় ‘ছায়ার হাওর’। এই হাওরে জমি রয়েছে নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলারও। শাল্লার মাউতির বাঁধ সংলগ্ন ৮১নং পিআইসির ক্লোজার দিয়ে হাওরে পানি প্রবেশ করে। মাউতির বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে ৪ হাজার ৬৩৭ হেক্টর আবাদি জমির ধান। শঙ্কা কমেছে না অন্যান্য হাওরেও। বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢল নামা বন্ধ থাকার পরও হাওরে বাঁধ ভেঙ্গে ফসলডুবির ঘটনা একর পর এক ঘটেই চলছে। এর পিছনের কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ব্যাপক অনিয়ম-অসঙ্গতি। যথাযথ নিয়মে দুরমুজ না করা (কমপ্যাক্শন সঠিকভাবে না করা), বাঁধের গোড়া থেকে মাঠি তুলে বাঁধে ফেলা, বালি দিয়ে দায়সারাভাবে বাঁধ দেয়া, অসময়ে (১৫ ডিসেম্বর শুরু এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ) নির্মিত হাওর রক্ষা বাঁধের বেশিরভাগেই হয় ধস, না হয় বরুঙ্গা দিয়ে চুঁইয়ে হাওরে পানি ঢুকে। যেসব বাঁধে এস্কেভেটর দিয়ে বড় বড় চাকা মাটি ফেলা হয়েছে এবং দুরমুজ করা হয়নি ওই সব বাঁধে ফাটল কিংবা ধস দেখা দিয়েছে ভারি বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে। অপরদিকে অনেকাংশেই বাঁধের দুপাশে যে স্লোপ থাকার কথা সেই পরিমাণ স্লোপ ও ঘাস লাগানো হয়নি। এসব বাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় আছেন পাউবো, প্রশাসন ও কৃষক। আর এই বাঁধগুলোকেই বলছেন ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ। সারা বছরের আহার একটি মাত্র ফসল বোরো ধান হারিয়ে দিশেহারা কৃষক। এখন হাওড়ের ঘরে ঘরে কৃষকের করুণ আর্তনাদ।
এখনও বেশিরভাগ বাঁধের কানায় কানায় এখন পানি। যেসব হাওরে বাঁধ এখনও টিকে আছে সে বাঁধগুলোও ঝুঁকির মুখে। অনেক বাঁধেই উপচে কিংবা ভেঙ্গে পানি ঢোকার উপক্রম।
সুনামগঞ্জ জেলার, মাটিয়ান হাওর, শনির হাওর, দেখার হাওর, জামখলা হাওর, কাঁচিভাঙ্গা হাওর, সাংহাই হাওর, খাই হাওর, নাইন্দার হাওর, মাচুখালি হাওর, চাওলির হাওর, খরচার হাওর, আঙ্গুর আলী হাওর, হালির হাওর, পুটিয়ার হাওর, কালিয়াকোটা হাওর, উৎগল হাওর, নলুয়ার হাওর, সুরাইয়া বিবিআনা হাওর, ভান্ডাবিল হাওর, ভেড়ারডহর হাওর, মহালিয়া হাওর, পাগনার হাওর, রুইবিল হাওর, সাপারিয়া পাথারিয়া হাওর, কানলার হাওরে কৃষকদেরা আজও হুমকির সম্মুখীন। বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় যে কোন সময় হাওরগুলো তলিয়ে গিয়ে কৃষকের সর্বনাশ হতে পারে।
হাওরের ফসল রক্ষার জন্য সরকার ১২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও তাদের সিন্ডিকেট চক্রের কারণে সরকারের বড় একটি অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ৩ এপ্রিল রাত থেকে সাধারণ কৃষকরা তাদের বাঁধের দায়িত্ব নিয়েছেন। তারা নিজেরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে পিআইসি বাঁধ এলাকায় না থেকে গাঁডাকা দিয়েছেন। যেহেতু এখন পর্যন্ত কোন কোন পিআইসি স্কিম বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির হাতে বাঁধের কাজ শেষ করে হস্তান্তর করেননি সেহেতু বাঁধের কাজ পিআইসি করার কথা।
এদিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড স্থানীয় সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে সকল পিআইসিকে বরাদ্ধের প্রায় ৪৩ ভাগ টাকা পরিশোধ করা হয়ে গেছে। অথচ পাগনার হাওরে অনেক বাঁধের কাজ এখনও যথাযথ স¤পন্ন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কতিপয় পিআইসি।
এ ব্যাপারে হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ স¤পাদক বিজন সেন রায় বলেন, পিআইসি, প্রশসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতায় যদি বিগত ২০১৭ সালের মতো হাওরের সোনার ফসল তলিয়ে যায় তবে, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। অর্থাৎ মামলা দায়ের করা হবে হাওর বাঁচাও আন্দোলন কমিটির মাধ্যমে।
জেলা প্রশাসকের মিডিয়া সেল ও স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, গত ২-২৪ এপ্রিল পর্যন্ত সুনামগঞ্জের ৯ উপজেলায় অন্তত ২০টি হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে ফসল তলিয়ে গেছে। যদিও প্রশাসনের মতে ৫-৬ হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষতি হয়েছে। তবে কৃষকদের দাবি হাওর এলাকার কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ হাজার হেক্টর বোরো ফসলের ক্ষতি হয়েছে।