কাজিরবাজার ডেস্ক :
বেকারত্ব দূরীকরণে কর্মসংস্থানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়েছে। অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে-এমন আশায় আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এটি হচ্ছে টাকার অঙ্কে রেকর্ড-এ যাবতকালের সর্বোচ্চ ব্যয় বরাদ্দের বাজেট। আগামী ৯ জুন মহান সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করবেন। দ্রব্যমূল্য কমাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে কর ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি, দারিদ্র্য দূরীকরণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতা বাড়ানো এবং অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণ থেকে সরে আসার মতো পদক্ষেপ গ্রহণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। তবে পদ্মা সেতু দ্রুত চালুসহ বাজেটে মেগা দশ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করে আনার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। করোনার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে চলমান প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের কাজ চলবে। তবে সার্বিক স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ বাড়ানো হলেও করোনার জন্য পৃথক কোন কর্মসূচী গ্রহণ করা হচ্ছে না। দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, আগামী বাজেটে দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানো হবে। বিশেষ করে নতুন করে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা দিতে দেশের আরও ১০০ উপজেলার নাম চূড়ান্ত করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা কর্মসূচী চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এ আশঙ্কায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি ৪ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছেড়েছে। তবে ব্যাপকভাবে ডলারের ব্যবহার কমাতে অপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খোলার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। বিদ্যুত, সার ও এলএনজিতে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দেয়া হবে আগামী বাজেটে। বেসরকারীখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান সক্ষমতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। রবিবার বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে আগামী অর্থবছরের বাজেটের একটি রূপরেখা তুলে ধরেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। রূপরেখায় বাজেটের প্রাথমিক প্রাক্কলন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এটি দেশের জিডিপির ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরে ৬ লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাজমা মোবারেক বলেন, আগামী বাজেটের আকার বেশ বাড়ানো হচ্ছে এটা প্রায় নিশ্চিত। কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে নতুন বাজেটে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বাজেটের একটি রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৯ জুন মহান সংসদে অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করবেন। উল্লেখ্য, এটি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম এবং বর্তমান সরকারের টানা ১৪তম ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের চতুর্থ বাজেট।
জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ কমে আসায় আগামী বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ৪৪ লাখ ১৭ হাজার ১০০ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে বেশকিছু কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। এ লক্ষ্যে বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছর আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে আয় বাড়ছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও সারের দাম বৃদ্ধির কারণে সরকারের ভর্তুকির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভোক্তাদের মধ্যে অর্থপ্রবাহ বাড়াতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। এ সব বিবেচনায় নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার বাড়ানো হয়েছে।
জানা গেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরের মোট আয়ের মধ্যে এনবিআরকে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি জিডিপির প্রায় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছর এনবিআরকে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেয়া আছে। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা ৪০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া আগামী বাজেটে মোট আয়ের মধ্যে নন-এনবিআর থেকে প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব ৪৯ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৫.৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সে হিসাবে ঘাটতি বাড়ছে ২৮ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা আগামী অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার এডিপির প্রস্তাব করছেন। আগামী অর্থবছরে প্রাক্কলিত বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সে হিসাবে ঘাটতি বাড়ছে ২৮ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।
ভর্তুকি বাড়বে : জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটে ভর্তুকি ব্যয় আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। আগামী অর্থবছরের জন্য ইতোমধ্যে ৬০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রাথমিক প্রাক্কলন করেছে মন্ত্রণালয়। তবে চূড়ান্ত বাজেটে এর পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। সার, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে এবং তা সমন্বয় করা না হলে বাজেটে এই ব্যয় আরও বাড়ানো ছাড়া সরকারের কাছে কোন উপায় থাকবে না বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। দেশের সাধারণ মানুষের করের টাকা দিয়ে ভর্তুকি দেয়া হয়। তাই ভর্তুকির সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির মতে, ভর্তুকির টাকা কমানো গেলে সরকার তা অন্য উন্নয়নকাজে ব্যয় করতে পারে। তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভর্তুকির পরিমাণ না বাড়ালে কৃষিপণ্য, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। তাই সামনের দিনগুলোতে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়ানোর পক্ষে মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরের বাজেটে কৃষি, রফতানিসহ বিভিন্ন খাতে সব মিলিয়ে ৪৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা মোট বাজেটের প্রায় ৮ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ। বাজেটে এটি দেখানো হয়েছে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ হিসেবে। গত অর্থবছরের বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ৪৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তার আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৯-২০-এর বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়তে থাকায় গত ৩ নবেম্বর দেশেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। এবার সরকার চাচ্ছে ভর্তুকি কমানোর লক্ষ্যে গ্যাস, বিদ্যুত ও সারের দাম বাড়াতে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে যুক্তি হলো, এই তিন পণ্যের দাম সমন্বয় বা বৃদ্ধি করা না হলে বাজেটে ভর্তুকি ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে, যার পরিমাণ হতে পারে জিডিপির ২ শতাংশ। অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা, সারে ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন হবে। আর এলএনজিতে ভর্তুকি প্রয়োজন হবে ১০ হাজার কোটি টাকা। যদিও শেষ পর্যন্ত কৃষকদের ওপর বাড়তি চাপের কথা বিবেচনা করে সারের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসতে পারে সরকার, তার পরও চলতি অর্থবছরই আরও বাড়তি ৪৫ হাজার কোটি টাকা লাগার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ব্যবসাবান্ধব বাজেট : কর্মসংস্থান বাড়াতে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়ন করছে সরকার। এতে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন। ফলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে। ব্যবসায়ীদের ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে বরং করের আওতা বাড়াতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। সম্প্রতি বাজেট সংক্রান্ত এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, করোনা মহামারী থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়নে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। কর বাড়াতে হলে আগে হয়রানি বন্ধ করে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত ৪২তম পরামর্শক সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, ব্যবসায়ীরা যাতে হয়রানিমুক্ত থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন সেদিকে সবার দৃষ্টি দিতে হবে। আমদানিকৃত কাঁচামাল, মধ্যবর্তী কাঁচামালসহ যাবতীয় শিল্প উপকরণের ওপর আরোপিত অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এছাড়া আয়কর ও মূসকের আওতা বাড়ানো, সব রফতানি খাতকে সমান সুবিধা দেয়া, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি জোরদার করা, টার্নওভার কর ফিরিয়ে আনা, বিদ্যমান ভ্যাট আইন সংশোধন করার প্রস্তাব দেন জসিম উদ্দিন। এ ছাড়া রফতানি খাতসহ সব শিল্প খাতে উৎসে কর ও আগাম কর ফেরত দেয়ার পরিবর্তে পুরো বিলোপের সুপারিশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। ব্যবসায়ে অহেতুক খরচ ও সময় কমানোর জন্য এ সুপারিশ করেছে সংগঠনটি। এছাড়া জমি ক্রয়, নির্মাণ, পরিষেবার বিলসহ যাবতীয় সব সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) প্রত্যাহার চায় এফবিসিসিআই। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য মৌলিক বাজেট প্রস্তাবে এসব সুপারিশ করেছে এফবিসিসিআই।