সাংস্কৃতিক জাগরণের বাঙালির পহেলা বৈশাখ আজ

7

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের মহাউপলক্ষ পহেলা বৈশাখ এলো। আজ সেই ঐতিহ্যবাহী উৎসবের দিন। আবহমানকাল ধরে চলা আচার, অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রতিবারের মতোই বরণ করে নেয়া হবে বাংলা নববর্ষকে। কোভিড ১৯ সংক্রমণের কারণে গত দু’বছর বড় কোন উদযাপন সম্ভব হয়নি। ১৪২৯ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে আজ সেই বন্ধ্যত্ব ঘুচিয়ে নব সূচনার আশা করা হচ্ছে।
এবার আগের মতোই রমনা বটমূলে ফিরছে বাঙালিত্বের সাধনায় রত ছায়ানট। ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের প্রভাতী অনুষ্ঠানে ভোর সোয়া ৬টায় যোগ দেবে রাজধানীবাসী। এর পর সকাল ৯টায় আকর্ষণীয় মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিপুল জনসমাবেশ ঘটবে। পাশাপাশি গোটা দেশজুড়েই বিপুল উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। সবচেয়ে বড় বর্ণাঢ্য ও অসাম্প্রদায়িক উৎসবে মাতবে সব ধর্মবর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ। বহুকাল পর রোজার মধ্যে হবে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা। এ আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ধর্ম ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন আরও জোরালো হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
তবে পহেলা বৈশাখ শুধু উৎসব নয়, তাৎপর্যপূর্ণ এক মুভমেন্টের নাম। এবার এমন এক সময়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়া হবে যখন সেই পুরনো চেহারায় সামনে এসেছে মৌলবাদ। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা স্বাধীনতার ৫০ বছরের যত অর্জন সব গিলে খেতে চাইছে। নানা ছুঁতোয় ফণা তোলার চেষ্টা করছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। যখন শ্রেণীকক্ষে আক্রান্ত হচ্ছে বিজ্ঞান, যখন ধর্মের নামে উন্মাদনা ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা চালানো হচ্ছে, যখন পুলিশ এবং প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতিক্রিয়াশীলরাও বসে নেই তখন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বৈশাখ এসেছে। আজ বাঙালির চেতনাবিরোধী অপশক্তি রুখতে নতুন বছরে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেবে বাংলাদেশ। বাঙালির উদার-অসাম্প্রদায়িক চেতনার উজ্জ্বল আলোয়, অগ্নিবাণে পুড়বে অন্ধকার। নজরুলের ভাষায়: তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর…। উদার, অসাম্প্রদায়িক উৎসবের পক্ষে জয়ধ্বনি করবে আজ বাংলাদেশ। শুদ্ধ, সুন্দর চাওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন বছরে নবসূচনা করবে বাঙালি। বিগত দিনের শোক-তাপ-বেদনা-অপ্রাপ্তি-আক্ষেপ ভুলে অপার সম্ভাবনার দিকে চোখ মেলে তাকাবে।
বছরের প্রথম দিনে আজ নতুন নতুন স্বপ্ন বুনবে বাংলার কৃষক। হালখাতা খুলবেন ব্যবসায়ীরা। সরকারী ছুটির দিনে রাজধানীসহ সারাদেশে একযোগে চলবে লোকজ ঐতিহ্যের নানা উৎসব অনুষ্ঠান। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক কৃষির। এ সম্পর্কের সূত্রেই বাংলা সাল প্রবর্তন করেন স¤্রাট আকবর। তার আমলেই প্রবর্তন হয় বাংলা সাল। এখন তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত। বঙ্গাব্দের মাস হিসেবে বৈশাখের প্রথম স্থান অধিকার করার ইতিহাসটি বেশিদিনের না হলেও, আদি সাহিত্যে বৈশাখের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। দক্ষের ২৭ কন্যার মধ্যে অনন্য সুন্দরী অথচ খরতাপময় মেজাজসম্পন্ন একজনের নাম বিশাখা। এই বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারেই বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখের নামকরণ। বৈদিক যুগে সৌরমতে বৎসর গণনার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। সেখানেও সন্ধান মেলে বৈশাখের।
পেছনের যত ক্ষত ভুলে এ মাসেই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে বাঙালি। সেই শুভ সূচনা হয় পহেলা বৈশাখে। কবিগুরুর ভাষায়Ñ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা…। পুরনো দিনের শোক-তাপ- বেদনা-অপ্রাপ্তি-আক্ষেপ ভুলে অপার সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করবে। দুই হাতে অন্ধকার ঠেলে, সকল ভয়কে জয় করার মানসে নতুন করে জেগে উঠবে বাঙালি। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ আজ একাত্ম হয়ে গাইবেÑ এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ…। আনন্দে উৎসবে মাতবে গোটা দেশ। কবিগুরুর ভাষায়Ñ নব আনন্দে জাগো আজি নব রবি কিরণে/শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে…। একই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে নজরুল লিখেছেনÑতোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর…।
আবহমানকাল ধরেই চলছে বৈশাখ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। প্রকৃত রূপটি দৃশ্যমান হয় গ্রামে। একসময় গ্রামবাংলায় চৈত্রসংক্রান্তি ছিল প্রধান উৎসব। বছরের শেষদিনে তেতো খাবার খেয়ে শরীর শুদ্ধ করতেন কৃষাণ-কৃষাণীরা। নির্মল চিত্তে প্রস্তুত হতেন নতুন বছরে প্রবেশ করার জন্য। এখনও বৈশাখ বরণের অংশ হিসেবে বাড়িঘর ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করেন গৃহিণীরা। অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় আল্পনা আঁকেন মাটির মেঝেতে। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন সবাই। স্নান সারেন। নতুন পোশাক পরেন। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যান। ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিশেষ খাবার রান্না করা হয়। থাকে পিঠা-পুলির আয়োজন। আজ হাটে-মাঠে-ঘাটে বসবে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা। নানা রকম কুটির শিল্প, খেলনা, মিষ্টিসহ বাহারি পণ্যে স্টল সাজানো হবে। বিভিন্ন এলাকায় থাকবে নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা কিংবা কুস্তির মতো ঐতিহ্যবাহী আয়োজন।
নাগরিক জীবনেও বিপুল আনন্দ যোগ করে পহেলা বৈশাখ। বর্ষবরণের দিন সব শহরেই আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য উৎসব অনুষ্ঠানের। ধর্মবর্ণ ভেদ ভুলে অসাম্প্রদায়িক উৎসবে মাতে বাংলা। ষাটের দশকে বাঙালি চেতনাবিরোধী অবস্থানের প্রতিবাদে রাজধানী শহর ঢাকার রমনা বটমূলে শুরু হয় বৈশাখ উদযাপন। এর মাধ্যমে বাঙালি আপন পরিচয়ে সামনে আসার সুযোগ পায়। পরবর্তী সময়ে বাঙালির রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে পহেলা বৈশাখের। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিবসটি বর্তমানে বাঙালির জাতিসত্তায়, চেতনায় ও অনুভবের জগতে গভীরভাবে বিরাজ করছে। এ প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের বলাটি চমৎকার। তিনি বলেছেন, আমাদের অধুনাতম নববর্ষ এ দেশের গ্রীষ্মকালীন উৎসব ও কৃষি উৎসব উদযাপনের একটি বিবর্তিত নব সংস্করণ। এর ঐতিহ্য প্রাচীন কিন্তু রূপ নতুন, নতুন সংস্কার, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাধারা অবারিত স্রোতে যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করেছে এমন এক নতুন আবহ যাকে একটা দার্শনিক পরিমন্ডল বলে উল্লেখ করতে হয়। এ পরিমন্ডলে পুরাতন বিলীন জীর্ণস্তূপ নিশ্চিহ্ন, মিথ্যা বিলুপ্ত ও অসত্য অদৃশ্য। আর নতুন আবির্ভূত নবজীবন জাগরিত সুন্দর সম্মিত ও মঙ্গল সম্ভাবিত কালবৈশাখীই এর প্রতীক। সে নববর্ষের অমোঘ সহচর। নবসৃষ্টির অগ্রদূত সুন্দরের অগ্রপথিক ও বিজয়কেতন।
আজ সরকারী ছুটির দিন। লাল ও সাদা রঙের পোশাক পরে সব বয়সী মানুষ ঘর থেকে বের হবেন। শাড়ি ও পাঞ্জাবি পরে দিনভর ঘুরে বেড়াবে অলিগলি রাজপথ। নগরী জুড়ে চলবে নানা বর্ণিল অনুষ্ঠান।