অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে – প্রধানমন্ত্রী

7
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রান্তে যুক্ত হয়ে ১৫তম বিশ^ অটিজন সচেনতা দিবস উদযাপন ও অটিজম সচেতনতায় বিশেষ ভূমিকা রাখায় বিভিন্ন ব্যক্তি ্র প্রতিষ্ঠানকে পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রত্যক্ষ করেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্নসহ সকল বিশেষ শিশুকে সমাজের মূল ধারায় এনে তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্নসহ ভিন্নভাবে সক্ষম লোকদের জীবন সুরক্ষিত করার জন্য তার সরকার তাদের জন্য স্থায়ী বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। আমরা বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য একটি সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে আমরা রাষ্ট্র পরিচালনা করছি।
১৫তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে শনিবার সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অটিজমটা আছে কিনা খুব একটা শুরুতেই যদি চিহ্নিত করা যায় তাহলে তাদের উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে বা তাদের সঙ্গে সেভাবে ব্যবহার করে তাদের অনেকটা সুস্থ করে তোলা যায়। এ চেষ্টা আমাদের রয়েছে। আমাদের আটটি বিভাগ আছে। আমরা এই আট বিভাগে প্রথমে এটি (স্থায়ী বাসস্থান ও কর্মসংস্থান) প্রতিষ্ঠা করব এবং পর্যায়ক্রমে আমরা প্রতিটি জেলায় তৈরি করব।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ‘বলতে চাই’ এবং ‘স্মার্ট অটিজম বার্তা’ নামে দু’টি এ্যাপস উদ্বোধন করে বলেন, এগুলো অটিস্টিক ব্যক্তি, কথা বলতে সমস্যায় থাকা ব্যক্তিদের কথা বলতে এবং অটিজম চিকিৎসায় সহায়ক হবে। তিনি বলেন, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজএ্যাবিলিটি প্রোটেকশন ট্রাস্টের অধীনে ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তি এবং অটিজম আক্রান্তদের স্থায়ী বাসস্থান ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে। আমরা ট্রাস্টের মাধ্যমে তাদের জন্য হোস্টেল বা ডরমিটরি তৈরি করতে পারি যেখানে তাদের দেখাশোনার জন্য লোক থাকবে।
অটিজম বৈশিষ্ট্যসহ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সুপ্ত প্রতিভার কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, আজকে আমরা বিশ্বখ্যাত বেটহোফেন (জার্মান সঙ্গীতজ্ঞ লুডভিগ ফন বেটোফেনের), আমরা ইলিয়টের (বিশ্ববিখ্যাত কবি ও লেখক টিএস এলিয়ন) কথা বলি অথবা আইনস্টাইনের (বিখ্যাত বিজ্ঞান আলবার্ট আইনস্টাইন) কথা বললেই বা স্টিফেন হকিংক (ব্রিটিশ পদার্থবিদ) যার কথা আমরা বলি, তাদের প্রত্যেকের মাঝেই কিন্তু এই ধরনের একটা অটিজমের সমস্যাটি ছিল। তারা কিন্তু সমাজে এমন কিছু দিয়ে গেছে, যা কোন দিন আর কেউ এটা চিন্তাও করতে পারেনি তাদের ভেতরে এই ধরনের সমস্যা ছিল। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এবং আমাদের নানামুখী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে অটিজম বৈশিষ্ট সম্পন্ন ব্যক্তিদের জাতীয় জীবনে মূল ধারায় নিয়ে আসা সম্ভব এটা আমি বিশ্বাস করি।
এবারে ওয়ার্ল্ড অটিজম এ্যাওয়ারনেস ডে-২০২২ এর প্রতিপাদ্য ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মক্ষেত্র’। অটিজমে আক্রান্ত শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের জীবন উন্নত করতে সকলের মাধ্যমে ব্যাপক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২ এপ্রিলকে ওয়ার্ল্ড অটিজম এ্যাওয়ারনেস ডে ঘোষণা করে।
সমাজ কল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সমাজ কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মোঃ আশরাফ আলী খান খসরু এবং একই মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহফুজা আক্তার বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সমাজ কল্যাণমন্ত্রী বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্যে চারটি ক্যাটাগরিতে অটিজমে আক্রান্ত তিন শিশু, তিনটি সংস্থা, দুজন ব্যক্তি এবং একজন মায়ের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। সমাজে অবদান রাখার জন্যে অটিজমে আক্রান্ত তিন শিশু মাসুদুল ইমান, মুনতাসির ইনাম এবং ইসাবা হাবিব সুশমির প্রত্যেকের হাতে একটি ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট এবং ৫০ হাজার টাকার চেক তুলে দেয়া হয়।
এ ছাড়া, অটিজমে আক্রান্তদের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে অবদান রাখায় তিন সংস্থা এন আই খান ফাউন্ডেশান, আরটিভি এবং ফাউন্ডেশান ফর উইমেন এ্যান্ড চিলড্রেন এবং দুজন ব্যক্তি সুবর্ণ চাকমা, প্রফেসর খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুনকে সম্মানজনক মানপত্র প্রদান করা হয়। এছাড়া, অটিস্টিক শিশুর সফল মা শারমিন চৌধুরীকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পক্ষে অনুষ্ঠানে ছোট্ট শিশু ইসাবা হাবিব সুশমি বক্তব্য রাখে। অনুষ্ঠানে অটিজমে আক্রান্তদের সুন্দর ও উন্নত জীবনের লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহের ওপর নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শিত হয়।
অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের আপন করে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, সবাইকে মনে রাখতে হবে এটা কোন রোগ না। এক সময় ছিল শিশু যদি প্রতিবন্ধী হতো বা অটিজম হতো- মানুষ তাকে লুকিয়ে রাখত, পরিবার লুকিয়ে রাখত, সামনে বলতে লজ্জা পেত। তাদের সামনে আনলে অনেকে দেখে হয়তো এটা নিয়ে প্রশ্ন করত। একটা মানুষের জন্ম কিভাবে হয়েছে, তাকে তো আমরা অবহেলা করতে পারি না। তাকে আমরা ফেলে দিতে পারি না। তাদের আপন করে নিতে হবে।
বিশ্বব্যাপী অটিজম সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলাতে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের (প্রধানমন্ত্রীর কন্যা) অবদানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এইটুকু অন্তত বলব সায়মা ওয়াজেদ যখন শুরু করল এই অটিজম নিয়ে কার্যক্রম এবং মানুষের মাঝে সচেতনতা শুরু করা, জাতিসংঘে এটার ওপর রেজুলেশন নেয়া। এই ধরনের কার্যক্রম করার ফলে আজকে শুধু আমাদের দেশে না, সারাবিশ্বেই কিন্তু এই বিষয়গুলো মানুষ সাধারণভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সমাজকল্যাণ মন্ত্রীকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্থায়ী বাসস্থান এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে বলেন। যাদের অভিভাবকরা সমর্থন দিতে অক্ষম এমন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিরাপদ জীবন যাপনের জন্য এই প্রকল্প স্থায়ী বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। তিনি বলেন, তার সরকার অটিস্টিক ও ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য সমাজে সুন্দর ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে কাজ করছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সসময় সকলকে বিশেষ করে ধনী ব্যক্তিদের ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর এবং তাদের আর্থিক সহায়তা এবং চাকরিসহ প্রয়োজনীয় সকল সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানান। যাতে তাদের জীবন অর্থবহ হয় এবং সুপ্ত মেধা বিকশিত হতে পারে। তিনি বলেন, দেশের সকল ধনী নাগরিকদের দায়িত্ব ভিন্নভাবে সক্ষম লোকদের যত্ন নেয়া। কারণ তারা আমাদের আত্মার আত্মীয়।
সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, কারণ তাদের অনেক প্রতিভা রয়েছে। তাদের প্রতি আর অবহেলা না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের তাদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে।
বিশেষ অলিম্পিকে স্বর্ণ এবং রৌপ্য বিজয়ী এবং সম্প্রতি চার দেশের বিশেষ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা অর্জনে বাংলাদেশী ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের সাফল্যের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সাধারণ খেলোয়াড়রাও এটা পারেন না। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার ভিন্নভাবে সক্ষম জনগণের উন্নতিতে কাজ করতে শুরু করে। ওই সময়ে অটিজম শব্দটি পরিচিত ছিল না।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যে সমস্ত শিশুদের মধ্যে অটিজমটা একটু কম আছে বা যারা মিশতে পারে তাদের সাধারণ স্কুলে বা যারা প্রতিবন্ধী সাধারণ স্কুলে ছোট ছেলে-মেয়েদের সঙ্গেই যদি এক সঙ্গে মানুষ করা যায় এবং বড় করা যায়, সবার সঙ্গে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে থেকে তারা কিন্তু নিজে থেকে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠবে। সুস্থ হয়ে যায় তারা।
সরকারপ্রধান বলেন, তারা একে অপরের শেয়ার করতে শেখে। ঝগড়া করুক বা মারামারি করুক, যাই করুক তার মধ্যে দিয়েই কিন্তু তাদের ভেতরে একটা আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠে। শুধুমাত্র আলাদাভাবে ব্যবস্থা করলেই চলবে না। তবে যারা একেবারেই মিশতে পারে না, তাদের জন্য আলাদা থাকবে। কিন্তু যত বেশি আমরা তাদের অনেক মানুষের সঙ্গে মিশতে সুযোগ করে দেব, তত দ্রুত তারা সুস্থতা লাভ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
অটিস্টিকদের জন্যে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, বাংলাদেশে বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত, এমনকি তার কাছেও। কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নেতৃত্বে অটিজম বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, অটিজম বিষয়ে গুরুত্ব এবং সচেতনতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় পিতামাতা ও অভিভাবকদের প্রতি তাদের সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা বিষয়ে লজ্জাবোধ এড়িয়ে সমাজের মূলধারায় অটিস্টিকদের সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টার জন্যে অনুরোধ জানান। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাদের এ ধরনের সন্তানের সঙ্গে আরও বেশি সময় ব্যয় করারও আহ্বান জানান।
সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের আমাদের সমাজের বোঝা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়। তাদেরও অর্থপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। আমরা যারা পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যের অধিকারী আমাদের উচিত তাদের অধিকারের পূর্ণতা দেয়া।