চাঞ্চল্যকর এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনা ॥ ২ মাস পর সাইফুর, রনি, তারেক ও অর্জুনসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল ॥ অস্ত্র মামলায়ও সাইফুর ও রনির বিরুদ্ধে দাখিল হয়েছে চার্জশিট

26

সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
ঐতিহ্যবাহী সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ (এমসি) ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের দায়েরকৃত মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) আদালতে দাখিল করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ৩ ডিসেম্বর সকাল ১১ টার দিকে চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার ২ মাসের অধিক সময় পর সিলেটের চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) মো: আবুল কাশেমের আদালতে সাইফুর, রনি, তারেক ও অর্জুনসহ ৮

এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনার চার্জশিট দাখিলে পুুলিশের পক্ষ থেকে প্রেসব্রিফিং।

জনকে অভিযুক্ত করে এই চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহপরাণ থানার ওসি (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য রাজন।
অভিযুক্তরা হচ্ছে, বালাগঞ্জ উপজেলার চান্দাইপাড়া গ্রামের মো: তাহিদ মিয়ার পুত্র বর্তমানে এমসি কলেজ হোস্টেল সুপারের বাংলো ৫ম ব্লকের বাসিন্দা সাইফুর রহমান (২৮), সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার উমেদনগরের রফিকুল ইসলামের পুত্র তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), হবিগঞ্জ সদরের বাগুনীপাড়ার মো. জাহাঙ্গীর মিয়ার পুত্র শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), জকিগঞ্জের আটগ্রামের কানু লস্করের পুত্র অর্জুন লস্কর (২৫), সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুর (জগদল) গ্রামের বাসিন্দা ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ এমসি কলেজ শাখার সভাপতি রবিউল ইসলাম (২৫), কানাইঘাটের গাছবাড়ি গ্রামের মাহফুজুর রহমান মাসুম (২৫), মিসবাউল ইসলাম রাজন ও আইনুদ্দিন আইনুল। এদের মধ্যে রাজন ও আইনুদ্দিন ছাড়া অপর ৬ জন মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। তদন্তকালে এ ২ জনের সংশ্লিষ্টতাও পায় পুলিশ। এছাড়া রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুমের বিরুদ্ধে ধর্ষণে সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এদিকে, গত ২২ নভেম্বর আদালতে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনার মামলায় চার্জশিটও দিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য রাজন। এতে ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামী সাইফুর রহমান ও আসামী শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আসামীরা একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলো বলে জানা গেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে অভিযোগপত্র প্রদানের তথ্যটি নিশ্চিত করে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের বলেন, সকালে আদালতে অভিযোপত্র প্রদান করা হয়েছে, দুপুরে সিলেট মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (দক্ষিণ)-এর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিস্তারিত জানানো হয়েছে।
পুলিশ জানায়, মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সাইফুর রহমানকে। এছাড়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ৮ জনের মধ্যে ৬ জন ধর্ষণে সরাসরি জড়িত, বাকিরা সহযোগিতা করেছে। এ মামলায় সকলেই গ্রেফতার রয়েছেন। বর্তমানে অভিযুক্তরা সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে। এরআগে গত ৩০ নভেম্বর ধর্ষণের ঘটনার ডিএনএ প্রতিবেদন আদালতের মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এসে পৌঁছে। ডিএনএ প্রতিবেদনে ধর্ষণের সাথে সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম উরফে তারেক, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি ও অর্জুন লস্করের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায় পুলিশ।
এছাড়া পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ৮ টার দিকে দক্ষিণ সুরমা জৈনপুর এলাকার বাসিন্দা মাইদুল ইসলাম (২৪) এবং তার স্ত্রীকে কতিপয় সন্ত্রাসী জোরপূর্বক প্রাইভেটকারসহ এমসি কলেজ গেইট হতে এমসি কলেজ ছাত্রাবাস এর ৭নং ব্লক এর ৫ম তলা বিল্ডিংয়ের সামনে নিয়ে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবী করে এবং মারধর করে। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা মাইদুল ইসলামের স্ত্রীকে জোরপূর্বক গণধর্ষণ করে এবং স্ত্রীর গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন, কানের দুল এবং নগদ ২ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় মাইদুল ইসলাম এর অভিযোগের ভিত্তিতে এজাহারনামীয় ৬ জন আসামীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে শাহপরাণ (রহ.) থানার ২১ (২৬-০৯-২০২০) নং মামলা দায়ের করেন। তদন্তকালে তাদের সাথে আরো ২ জনের জড়িত থাকার প্রমান পায় পুলিশ। আলোচ্য গণধর্ষণ মামলায় ৮ জন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তী সময়ে উক্ত ৮ আসামী বিজ্ঞ চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ফৌজধারী কার্য্যবিধি আইনের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তদন্তকালে ক্রাইমসিন হতে ফরেনসিক ইভিডেন্সসহ সংশ্লিষ্ট সকল সাক্ষীর সাক্ষ্য সংগ্রহ করা হয়। সিআইডি ফরেনসিক ল্যাবে জব্দকৃত আলামত পরীক্ষান্তে আসামীদের ডিএনএ প্রোফাইল এর সাথে সাদৃশ্যতা পাওয়া যায়। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (ওসি-তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য্য রাজন উক্ত গণধর্ষণ মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামী মোঃ সাইফুর রহমান, শাহ মোঃ মাহবুবুর রহমান রনি, তারকেুল ইসলাম উরফে তারকে, অর্জুন লস্কর, রবিউল হাসান উরফে ইসলাম, মাহফুজুর রহমান মাছুম, মোঃ আইনুদ্দনি উরফে আইনুল ও মজিবাউল ইসলাম রাজনদের বিরুদ্ধে শাহপরাণ (রহঃ) থানার অভিযোগপত্র নং-১৮৯ (০২/১২/২০২০) আদালতে দাখিল করেন।
অস্ত্র মামলায় সাইফুর-রনির বিরুদ্ধে চার্জশিট: এমসি কলেজ ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্র উদ্ধারের মামলায় ২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করাও হয়েছে। গত ২২ নভেম্বর গণধর্ষণ মামলার চার্জশিটও দাখিল করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহপরান থানার ওসি (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য রাজন। এতে আসামী করা হয়েছে গণধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি সাইফুর রহমান ও গণধর্ষণ মামলার আসামী শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এর কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়।
সেখানে মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) সুহেল রেজা জানান, ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে এমসি কলেজ ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ওই রাতেই ছাত্রাবাসে সাইফুর রহমানের কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে একটি পাইপগান, ৪টি রামদা, ২টি চাকু উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় শাহপরান থানায় পুলিশ বাদি হয়ে অস্ত্র আইনে মামলা (নং-২২/২৬/০৯/২০) দায়ের করে। এই পুলিশ কর্মকর্তা আরো জানান, মামলার তদন্তে ওই অবৈধ অস্ত্রগুলোর সাথে সাইফুর রহমান ও মাহবুবুর রহমান রনির সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (শাহপরান থানায় অভিযোগপত্র নং-১৬৪ /২২/১১/২০) দাখিল করা হয়েছে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, গণধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত তারেকুল ইসলাম তারেক, শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি, অর্জুন লস্কর, রবিউল ইসলাম, মাহফুজুর রহমান মাসুম, মিসবাউল ইসলাম রাজন ও আইনুদ্দিন আইনুল। এদের মধ্যে রাজন ও আইনুদ্দিন ছাড়া অপর ৬ জন মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। তদন্তকালে এ দুজনের সংশ্লিষ্টতাও পায় পুলিশ। অভিযোগপত্রে সরাসরি ধর্ষণে জড়িত হিসেবে নাম এসেছে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন উরফে আইনুল ও মিসবাউল ইসলাম রাজনের। ধর্ষণে সহায়তা করেন রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুম। এই ৮ আসামীর সবাই বর্তমানে কারাগারে আছেন। তাদের ডিএনএ পরীক্ষায়ও ধর্ষণের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। আসামিদের প্রত্যেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।
এছাড়া প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে একই ঘটনায় অত্র মামলার বাদীর নিকট চাঁদা দাবী করে বাদীকে মারধর এবং তার স্ত্রীর নিকট থাকা স্বর্ণালংকার ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অপরাধে সাক্ষ্য প্রমাণে তদন্ত শেষে উপরোক্ত ৮ জন আসামীর বিরুদ্ধে শাহপরাণ (রহ.) থানার অভিযোগপত্র নং-১৯০ (০২-১২-২০২০) আদালতে দাখিল করা হয়েছে। ঘটনার দিন রাতে শাহপরাণ (রহ.) থানা পুলিশ এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অস্ত্র উদ্ধার সংক্রান্তে ধর্ষণ মামলার প্রধান অভিযুক্ত সাইফুর রহমান এর বিরুদ্ধে শাহপরাণ (রহ.) থানার অস্ত্র আইনের ২২ (২৬-০৯-২০২০) নং মামলা রুজু হয়। উক্ত অস্ত্র উদ্ধার সংক্রান্তে মামলাটি তদন্ত শেষে আসামী সাইফুর রহমান এবং শাহ মোঃ মাহবুবুর রহমান উরফে রনি এর বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র রাখার অপরাধে সাক্ষ্য প্রমাণে তদন্ত শেষে শাহপরাণ (রহ.) থানার অভিযোপত্র নং-১৬৪, (২২-১১-২০২০) সিলেট আদালতে দাখিল করা হয়েছে।