রমজানে নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় থাকবে -প্রধানমন্ত্রী

7
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় সংসদের সপ্তাদশ অধিবেশনের প্রশ্নোত্তর পর্বে বক্তব্য রাখেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারের পদক্ষেপে বর্তমানে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ‘সহনীয়’ পর্যায়ে রয়েছে। আশা করি আসন্ন পবিত্র রমজান মাসেও পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশের গৃহহীন ও ভূমিহীনদের ঘর দিচ্ছে সরকার। এই ঘর উপহার দেয়াকে তাঁর জীবনের সবথেকে আনন্দের দিন বলে জানিয়েছেন আবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রী।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত ৩০ মিনিটের প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ে সংসদে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে সংসদ গরম করা হলো, সেই জন্যই আমি যখন প্রশ্নগুলো (তারকা চিহ্নিত প্রশ্ন) পেলাম, এটা এক নম্বরে নিয়ে আসলাম। ভাবলাম যে আজকে (বুধবার) উত্তর দেব। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে সমস্ত জিনিসের দাম বেড়েছে। তার প্রভাব আমাদের ওপর পড়েছে এটা স্বাভাবিক। আর কিছু লোক তো আছেই যারা সুযোগটা নেয়ার চেষ্টা করে। সেটা যাতে নিতে না পারে, তার জন্য আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছি।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামের লিখিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ সকল ধরনের পণ্যসামগ্রীর মূল্যের সাম্প্রতিক ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ ও তা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সরকার। আসন্ন পবিত্র রমজান উপলক্ষে দেশের সকল সিটি কর্পোরেশন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে নিম্ন আয়ের এক কোটি পরিবারের কাছে রমজান শুরুর আগে ও রমজানের মাঝামাঝি মোট দুইবার টিসিবির পণ্যসামগ্রী ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। উক্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্ধারিত মানদ-ের ভিত্তিতে টিসিবির পণ্যসামগ্রী বিক্রি করা হবে। তবে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পূর্বের ন্যায় ট্রাক সেলের মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তাগণের সমন্বয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত সভা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান আরও বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং সে অনুযায়ী প্রতিবেদন উপস্থাপনের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গঠিত দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল প্রতিদিন পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছে। আমদানি ও সরবরাহ অবস্থা পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এলসির তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করে।
তিনি বলেন, সকল জেলা ও উপজেলায় প্রতি মাসে জেলা টাস্কফোর্স কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত টাস্কফোর্স কমিটি জেলা ও উপজেলা বাজারসমূহে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ সকল মোবাইল কোর্ট পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী কর্তৃক ভোক্তাদের ওজনে কম না দেয়া, অধিক মুনাফার মানসিকতা পরিহার, দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের তালিকা টাঙানো, খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার রোধ ও বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা রোধে জরিমানা করে থাকে।
শেখ হাসিনা বলেন, পণ্যের মূল্য নিয়ে কেউ যেন মনোপলি বা অলিগোপলি অবস্থার সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন সৃষ্টি করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনও কাজ করে যাচ্ছে। দেশীয় শিল্প-কারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক রাখাসহ উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ ও বিপণন স্বাভাবিক রাখতে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। খাদ্যশস্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ও উর্ধগতি রোধের লক্ষ্যে চালকল পর্যায়ে ধান মজুদের সর্বোচ্চ পরিমাণ দৈনিক ৮ ঘণ্টা হিসেবে পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার ৫ গুণের স্থলে ৩ গুণে হ্রাস করা হয়েছে।
পাইকারি বাজারগুলোতে মজুদদারি বন্ধে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খাদ্যশস্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ও উর্ধগতি রোধের লক্ষ্যে চালকল পর্যায়ে ধান মজুদের সর্বোচ্চ পরিমাণ দৈনিক ৮ ঘণ্টা হিসেবে পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার ৫ গুণের স্থলে ৩ গুণে হ্রাস করা হয়েছে। পাইকারি বাজারগুলোতে মজুদদারি এবং বিভিন্ন রাইস মিলে অতিরিক্ত চাল মজুদের মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে যাতে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে, সে লক্ষ্যে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে একশ’টি বৃহৎ আকারের চালকলের মিলগেটের মূল্য নিয়মিত সংগ্রহ করে ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অভিযান এবং কেউ অবৈধ মজুদের মাধ্যমে বাজারে যাতে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করতে না পারে, সে লক্ষ্যে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ১০ টাকা দরে চাল বিক্রির খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীতে কর্মাভাবকালীন ৫ মাস (সেপ্টেম্বর-নবেম্বর ও মার্চ-এপ্রিল) সারাদেশের গ্রামাঞ্চলে ৫০ লাখ অতি দরিদ্র পরিবারের মধ্যে মাসিক ৩০ কেজি করে চাল বিক্রয় কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। ওএমএস কর্মসূচীর আওতায় বিক্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় ৩ গুণ বৃদ্ধি করে বর্তমানে ২০১৩টি কেন্দ্রে ওএমএসের খাদ্যশস্য বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ওএমএস কর্মসূচী সম্প্রসারিত করে সকল পৌরসভায় পরিচালনা করা হচ্ছে।
গৃহহীনদের গৃহদান সবচেয়ে আনন্দের দিন : সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পরে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গুচ্ছগ্রাম তৈরি কাজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দেশের কোন মানুষ গৃহহীন, ভূমিহীন ও ঠিকানাবিহীন থাকবে না। এটা জাতির পিতার লক্ষ্য ছিল। সেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করছেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমার লক্ষ্য মানুষকে উন্নত জীবন দেয়া। ১৯৯৬ সালে সরকারে আসার পর থেকে ভূমিহীন মানুষদের ঘর তৈরি করে দিচ্ছি এবং পুনর্বাসন করে যাচ্ছি। আমরা শুধু ঘর দিয়ে বসে থাকছি না, ঘর দেয়ার পরে তাদের অর্থ দিচ্ছি, প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আয়ের পথও করে দিচ্ছি।
ঘর উপহার দেয়ার পরে ওইসব গৃহহীনের নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এটা খুব ভালভাবে মনিটরিং করেন। কার্যালয়ে সচিব ও কর্মকর্তারা প্রায় যাচ্ছেন, তারা কেমন আছেন দেখছেন। দেখে আসার পরে যে ছবি আমাকে পাঠাল। ঘর পাওয়ার পরে মানুষের যে অনুভূমি, একটা ঠিকানা পেয়েছে, সেই আনন্দে যে কান্না। সেই হাসি, কান্না, বেদনা উপলব্ধি করে, সেদিন আমিও একটা মানুষ, একটা পরিবার যার একটা ঠিকানা পেয়েছে। ঘর পাওয়ার পরে জীবনটা যে পাল্টে গেছে। অভাব, দরিদ্র নেই। নিজের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।
আবেগজড়িত কণ্ঠে সংসদ নেতা বলেন, এটা আমার জীবনে সবথেকে বড় আনন্দের দিন। একজন মানুষ, যার কিছু ছিল না, তাকে একটা ঘর দিয়ে তার মুখে হাসি ফুটাতে পেরেছি। এর থেকে বড় আনন্দের কিছু হতে পারে না। সেদিন আনন্দে চোখের পানি রাখতে পারিনি। আমি অঝোর ধারায় কেঁদেছিলাম। কারণ এটাই তো আমার বাবার স্বপ্ন ছিল। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। জলে চোখ ভিজে যায়। তিনি বলেন, সরকার থেকে দেয়া ঘরে এখন অনেকের ঘরেই ফ্রিজ, টেলিভিশনসহ নানান আসবাব পত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। একটা মানুষকে যে ঠিকানা দিতে পেরেছি, জীবনটাকে পাল্টে দিতে পারলাম, এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে। এ সময় আবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রীকে চোখ মুছতে দেখা যায়।
র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা : র‌্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগে সেখানকার বাংলাদেশী দূতাবাস কেন জানতে পারল না, জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নুর এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নাইন-ইলেভেনের পর যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে সন্ত্রাস দমনে তখনকার বিএনপি সরকার র‌্যাব সৃষ্টি করেছিল। তবে তারা র‌্যাবকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ আসার পর র‌্যাব জঙ্গী, সন্ত্রাস দমন, হত্যার তদন্তসহ মানবিক কাজই করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, তারা মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করছে।
আক্ষেপ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে কিছু মানুষ আছে দেশে যখন একটি অস্বাভাবিক সরকার থাকে অথবা অবৈধ দখলকারী কেউ যদি থাকে, তখন তারা খুব ভাল থাকেন। তাদের খুব গুরুত্ব থাকে। যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলমান থাকে তারা ভাল থাকে না। এজন্য তারা সব সময় তাঁর (সরকারের) বিরুদ্ধে লেগেই থাকে। যতই ভাল কাজ করুক তারা পেছনে লেগেই থাকে, কারণ তারা সরকারের ভাল দেখতে চায় না।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন যাতে না হয়, সেজন্য নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দুপুর ১২টায় তারা (বিএনপি) সরে গেল। আমার প্রশ্ন- আন্দোলন করে তারা (বিএনপি) জনগণের সাড়া পেল না কেন? আমি যদি সত্যি ভোট ছিনতাই করে নিতাম তাহলে তো ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের (বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে) সময়ে যেভাবে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আন্দোলন করেছিল- দেড় মাসের মধ্যে খালেদা জিয়ার সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়েছিল, সেভাবে আমাদের হঠাতো! মানুষ তো সেভাবে সাড়া দেয়নি। কারণ মানুষ তো ভোট দিতে পেরেছে।
একটি মহল দেশে অস্বাভাবিক সরকার চায় বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, তারা সব সময়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। নানা ধরনের অভিযোগ, চিঠি, এই র‌্যাব সম্পর্কেও তাদের অভিযোগ। এই অপপ্রচার তারাই করেছে। ওখানকার কংগ্রেসম্যান, সিনেটরের কাছে তথ্য পাঠানো, চিঠি দেয়া নানাভাবে তারা এই অপপ্রচার করে। সেখানকার আমাদের এ্যাম্বাসি (দূতাবাস) সব সময় সক্রিয় ছিল। যখন এ ব্যাপার নিয়ে তারা আলোচনা করেছে তখন এ্যাম্বাসির কাউকে ঢুকতে দেয়নি। এটা আরও দুই বছর-তিন বছর আগের কথা। এর প্রক্রিয়া বহুদিন থেকেই চলছে। আমরা বারবার তাদের জানাচ্ছি।
সংসদ নেতা বলেন, বাংলাদেশ একমাত্র দেশ এখানে র‌্যাবের কোন সদস্য যখন অন্যায় করেছে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। আপনারা জানেন, আমাদের একজন মন্ত্রীর জামাই একটি অপরাধ করেছিল। মন্ত্রীর জামাই হিসেবে কিন্তু আমরা ক্ষমা করিনি। তাকে ঠিকই বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। শাস্তি দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ কোন সময় অন্যায়কে প্রশয় দেয় না। সে যেই হোক। আইনশৃঙ্খলা সংস্থার যে কেউ কোন অপরাধ করলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই।