কাজিরবাজার ডেস্ক :
আমদানি পর্যায়ে তেল, চিনিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ভ্যাট কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রীসভা। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল মন্ত্রীসভা বৈঠকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। এরপর উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভোজ্যতেলের ওপর মোট ২০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের আদেশ জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে আমদানিতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বহাল রাখা হয়। এর আগে গত বৃহস্পতিবার সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ভোজ্যতেলের উৎপাদনে ১৫ ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর ফলে দুইস্তরে ২০ শতাংশ ভ্যাট কমায় বাজারে ভোজ্যতেলের দাম প্রায় ২০ ভাগ কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাধা ভাঙতে এসও/ ডিও ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হবে বলে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।
জানা যায়, সয়াবিন ও পাম তেলের উৎপাদন এবং ব্যবসায়ী পর্যায়ে যথাক্রমে ১৫ শতাংশ ও ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ছিল। সোমবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ওই ভ্যাট দিতে হবে না। যদিও অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান ১৫ শতাংশ ভ্যাট অপরিবর্তিত থাকছে। এর আগে সোমবার বিকেলে সচিবালয়ে ভোজ্যতেল আমদানিতে ১০ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। একই সঙ্গে ভোজ্যতেল উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হবে বলে জানান তিনি।
সোমবার মন্ত্রীসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রীপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, দাম সহনীয় রাখতে রবিবার আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ভোক্তা পর্যায়ে নিত্যপণ্যের ভ্যাট তুলে দেয়াসহ বেশকিছু সিদ্ধান্ত হয়েছিল। রবিবারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। এবং খুব শক্ত নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ভোজ্য তেলের রিটেইলার (ভোক্তা) পর্যায়ে ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে। এনবিআরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, আমদানি পর্যায়ে যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, সেটা কতটুকু কমানো যায় দেখতে হবে এবং যথাসম্ভব কমাতে হবে। তিনি বলেন, ‘ভোজ্যতেলের রিটেইলার (খুচরা) পর্যায়ে ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আছে। আমদানি পর্যায়ে যে ভ্যাট আছে সেটা যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে এনবিআরকে বিবেচনা করার জন্য শীঘ্রই ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমদানি পর্যায়ে কমালে আমাদের ধারণা যে এটার একটা সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’ এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রীপরিষদ সচিব বলেন, ‘শুধু ভোজ্যতেল নয়, চিনি বা যেগুলো বেশি প্রয়োজনীয় সেগুলোর ক্ষেত্রে ভ্যাট কমাতে বলা হয়েছে। যেটা খুবই ক্রাইসিসে থাকবে সেটার ক্ষেত্রে একদম কম পর্যায়ে নিয়ে আসা। সম্ভাব্য লোয়েস্ট একটা সিলিংয়ে যাওয়া।’ ভ্যাট যথাসম্ভব সহনীয় একেবারে লোয়েস্ট লেভেলে নেয়া যায় কি না সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে এনবিআরকে যথা শীঘ্রই বিবেচনা করতে বলা হয়েছে বলেও জানান তিনি। শুল্ক একেবারে তুলে দিলে সমস্যা আছে জানিয়ে খন্দকার আনোয়রুল বলেন, ‘পুরোপুরি তুলে নিলে এনবিআর বুঝতে পারবে না কী পরিমাণ মালামাল ঢুকলো।’
বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রীও এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বলে জানান। সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ, অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন। সরবরাহ সঙ্কটের কথা বলে সয়াবিন তেলসহ আরও কয়েকটি নিত্যপণ্যে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম রাখছেন বিক্রেতারা। এ অবস্থায় রোজার সময়ে পরিস্থিতি কেমন হবে সেটাই জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘নাই নাই ভাবটা আসছে। কারণ, কেউ কেউ মজুদ করেছে। দেশে যথেষ্ট পরিমাণ মজুদ আছে। টিসিবিও এক কোটি মানুষকে দিতে তৈরি হয়েছে। আপানারা এই মেসেজটা দেন।’ পণ্যের দাম বাড়বে না সেই নিশ্চয়তার চেয়ে বলতে পারি, ভ্যাট কমালে পণ্যের দাম কমতেও পারে। আমরা যে প্রাইসটা ঠিক করেছি, সেটা নিশ্চিত করতে চাই। বাংলাদেশে রমজান এলে তারা সুযোগটা নেয়। অথচ বিদেশে পূজা-পার্বণে দাম কমে।’ অবশ্য ইউক্রেনে যুদ্ধপরিস্থিতির কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে বলেও জানান টিপু মুনশি। তিনি বলেন, ‘ভয় পাচ্ছি যুদ্ধটা কোথায় গিয়ে ঠেকে। কারণ তেলটা শেষ কথা নয়। গমের বিষয়ও রয়েছে। আবার সুইফট থেকে রাশিয়াকে বের করে দেওয়া হয়েছে। গম আসে ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে।’ ভ্যাট কমানোর পর পণ্যের মূল্যে কতটা প্রভাব পড়বে, তা ঘোষণা করা হবে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে ঠিক বলতে পারব না। এসআরও জারি হওয়ার পর বলা যাবে। আমরা যেটা নির্ধারণ করে দিলাম, সেই দামটা তাদের নিতে হবে। তারা চাইলে কমও নিতে পারে। কিন্তু বেশি নিলে আমরা ব্যবস্থা নেব এবং সেটা নেয়া শুরু হয়েছে। আমরা সব রকম অ্যাকশনে যাচ্ছি ওই প্রাইস ধরে। বিশ্বাবজারে বাড়লেও সেটা আমরা বিবেচনায় নেব না। বেশি দামের পণ্য দেশে ঢুকলে পরে আমরা নতুন মূল্য বিবেচনায় নেব।’
বাজার পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে- সেই প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু আমরা যেটা পারি টিসিবির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়াতে, সেটা আমরা করব।’ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থামাতে কোন পণ্যে কতটা ভ্যাট প্রত্যাহার করা হবে তা জানার জন্য এনবিআরের এসআরও প্রকাশ হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তবে সংবাদ সম্মেলনে ভ্যাট প্রত্যাহারের সম্ভাব্য হার নিয়ে কথা বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী ও বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। বাণিজ্য সচিব বলেন, চিনিতে রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) আছে ২০ শতাংশ, সিডি আছে প্রতি টনে তিন হাজার টাকা। চিনির ক্ষেত্রে ভ্যাট নয়; আরডি কমানো হতে পারে। তেলের জন্য ভ্যাট আছে। এজন্য ভ্যাট কমানো হতে পারে। তেলের আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট- এটা সবাইকেই দিতে হচ্ছে। তারপরে যখন প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়, সেখানে যেটুকু ভ্যালু এ্যাডিশন হয়, সেটুকুর ওপর ১৫ শতাংশ, টোটাল ভ্যালুর ওপরে নয়। আগে যেটা দেয়া আছে, সেটার সঙ্গে এটা এ্যাডজাস্ট হয়। তাহলে ১৫ + ১৫ + ৫ হিসাবে যেটা বলা হয়, আসলে ব্যাপারটা সে রকম নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার টাস্কফোর্স নামানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সাপ্লাই চেইন যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য উৎস পর্যায়ে নজরদারি করবে এই টাস্কফোর্স। র্যাব, পুলিশ, জেলা প্রশাসক ও ভোক্তা অধিকার কর্মকর্তারা এই পর্যায়ে ভূমিকা রাখবেন।’
সরবরাহ ব্যবস্থায় ‘অসাধু উপায়ে’ যে দাম বাড়ানো হয়, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘একজনের হাতে এসও (সাপ্লাই অর্ডার) দেয়া হচ্ছে, সে সেটা নিয়ে বসে আছে। কখন দাম বাড়বে সেই আশায়। অথবা সে একটা সার্টেইন প্রাইসে আরেকজনকে দিল, সে আবার আরেকজনকে দিল। এভাবে দাম বাড়াতে থাকল। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে যেদিন এটা কিনবে তার সাতদিন বা সার্টেইন টাইমের মধ্যে সাপ্লাই নিতে হবে। অন্যথায় এটা বাতিল হয়ে যাবে।’