ভোজ্যতেলের বাজার সিন্ডিকেটের কব্জায়

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
পুরোপুরি সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে গেছে দেশের ভোজ্যতেলের বাজার। ব্যবসায়ীরা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বাজার থেকে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। হাতেগোনা কয়েকটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ভোজ্যতেলের মিলগুলো থেকেই সঙ্কটের উৎপত্তি। মিলাররা সাপ্লাই অর্ডার (এসও) কিংবা ডিমান্ড অর্ডার (ডিও) অনুযায়ী ভোজ্যতেল সরবরাহ করছে না। মিলারদের অগ্রিম এসও বাণিজ্য সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি রোজা সামনে রেখে দাম আরও বাড়াতে উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী বাজারে তেলের সরবরাহ হচ্ছে না। এখন ভোক্তাদের মাসুল গুনতে হচ্ছে। অতিরিক্ত দাম দিয়েও দেশের অনেক স্থানে ক্রেতারা ভোজ্যতেল পাচ্ছেন না। সারাদেশ থেকে উধাও হয়ে গেছে পাঁচ লিটারের বোতলজাত ক্যান। আর খোলা সয়াবিন ও পামওয়েল কিছু পাওয়া গেলেও সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রতিলিটারে প্রায় ৭০-৭৫ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, ভোজ্যতেলের পুরো বাজার এখন নিয়ন্ত্রণের ভার মিল মালিকদের হাতে। সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের নীতিগত সহায়তা বিশেষ করে শুল্ক সুবিধা নিয়ে ক্রুড সয়াবিন-পামওয়েল এবং তেলের বীজ আমদানি করা হয়। বাজারে ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম কমাতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে বেশি কিছু সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে গত অর্থবছরের এই সময়ের তুলনায় ভোজ্যতেলের সব ধরনের কাঁচামাল বেশি আমদানি হয়েছে। বেশি পরিমাণে ঋণপত্র খুলেছেন (এলসি) ব্যবসায়ীরা। যদিও গত অর্থবছরের তুলনায় এলসি নিষ্পক্তি কিছুটা কম হয়েছে। কিন্তু রমজান সামনে রেখে দাম বাড়াতে কয়েক বছর ধরে এ সময়টাতে ভোজ্যতেলের উৎপাদন ও বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পুরো সুযোগটি এবার নিয়েছে মিল মালিকরা। এ কারণে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে ভোজ্যতেলের বাজার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে মিলগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা উচিত। কারণ মিলগুলো থেকে চাহিদা মতো ভোজ্যতেলের সরবরাহ করা হচ্ছে না। আর এ কারণে বাজারে তেলের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হাজী মোঃ আলী ভুট্টো বলেন, এসও এবং ডিও অনুযায়ী নির্দিষ্ট তারিখে তেল আনতে গেলে মিলগুলো সরবরাহ করছে না। খোলা সয়াবিন ও পামওয়েলের সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় বাজারে ভোজ্যতেলের সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়ানো এবং দাম বেশি নেয়া হচ্ছে কিনা তা যাচাইয়ে বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো। ইতোমধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা ও মজুদকৃত ভোজ্যতেল জব্দ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা, ডিজিএফআই, এনএসআই এবং পুলিশসহ সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। কিন্তু মিলগুলোতে অভিযান পরিচালনা এখনও সেভাবে শুরু করা হয়নি। মিলগুলোর কাছে আমদানি, মজুদ এবং সরবরাহের তথ্য চেয়েছে ভোক্তা অধিদফতর। এ প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ভোক্তা অধিদফতর থেকে মিল মালিক ও আমদানিকারকদের ভোজ্যতেল আমদানি ও মজুদ বিষয়ে যাবতীয় তথ্য চাওয়া হয়েছে। তথ্যগুলো পাওয়ার পর সেখানে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হবে। তিনি বলেন, ভোজ্যতেল নিয়ে দেশে কারসাজি হচ্ছে এটা প্রমাণিত। তবে যারা এই কারসাজির সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তি পেতে হবে। ভোক্তাদের জিম্মি করার সুযোগ কারও নেই।
অগ্রিম এসও বাণিজ্যে সঙ্কট আরও তীব্র : আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও মিল মালিকদের অগ্রিম এসও বাণিজ্য ভোজ্যতেলের চলমান সঙ্কটকে আরও তীব্র করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অগ্রিম এসও বাণিজ্যের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। যারা এসও’র মাধ্যমে অগ্রিম অর্ডার দিয়েছেন তারা এখন ভোজ্যতেল পাচ্ছে না। সূত্র জানায়, নগদ অর্থের প্রয়োজন হলে আমদানির অনেক আগেই বাজারে ভোজ্যতেলের ডিও (বর্তমানে এসও) ছেড়ে অর্থ তুলে নেয় আমদানিকারকরা। এ সময় নিজেদের সক্ষমতার চেয়েও বেশি ডিও বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানগুলো। সাধারণত ১৫ দিনের মধ্যে ডিও ও এসও’র বিপরীতে মিল থেকে পণ্য উত্তোলনের সময়সীমা থাকে। কিন্তু অতি মুনাফার লোভে কেউই সময়মতো পণ্যটি সংগ্রহ করে না। বারবার বিক্রির মাধ্যমে একই ডিও অনেক সময় শতাধিক হাত বদল হতেও দেখা যায়।
তবে এবার ডিও বা এসও নিয়ে মিলগুলোতে যাওয়ার পরও নানা ধরনের গড়িমসি করে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, ডিও কিংবা এসও ব্যবসা বিক্রি পুরনো পদ্ধতি। কিন্তু সঙ্কট হয় তখনই যখন এসও’র বিপরীতে নির্দিষ্ট সময়ে ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হয় না। এবার মিলগুলো থেকে তেল পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা মুখ খুলছে না। কারণ হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তাদের ভোজ্যতেল আনতে হয়। বেশি বাড়াবাড়ি করা হলে মিল মালিকরা পাইকারদের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করারও হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসও এবং ডিও অনুযায়ী সরবরাহটা হচ্ছে কিনা সেটা দেখা সবচেয়ে বেশি জরুরী। ভোজ্যতেলের এই সঙ্কট দূর করতে হলে মিলারদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগটা বেশি থাকতে হবে।
জানা গেছে, গত এক বছর ধরে ভোজ্যতেলের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। কম দামে মার্কেটে ছেড়ে দেয়ার পর দীর্ঘদিন জমে থাকা এসব ডিও’র বিপরীতে পণ্য সরবরাহ দিতে এখন গড়িমসি করছে মিল মালিকরা। অপর দিকে শেষ পর্যায়ে বেশি দামে ক্রয় করা এসব ডিও সংগ্রহে থাকলেও পণ্য সরবরাহ নিতে না পারায় পুঁজি আটকে আছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের ভোজ্যতেলের বাজারে। অভিযোগ ওঠেছে ভোজ্যতেলের এসও- ডিও বিক্রি করে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপসহ দেশের প্রায় প্রতিটি শীর্ষস্থানীয় ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও পরিশোধন মিল মালিকরা এভাবে সক্ষমতার অতিরিক্ত থেকে মূলধন সংগ্রহ করেছে। এ প্রসঙ্গে সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ কুমার বলেন, বাজারে সরবরাহ সঙ্কট আছে। তবে তারা আগের মতোই প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ তেল সরবরাহ করছেন। পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা রমজান সামনে রেখে সয়াবিন মজুদ করছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি জানান, এজন্য বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। কারখানায় বা মিলে কোন সমস্যা নেই। তবে তার এই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, ডিও-এসও বিক্রিতে সরকার নির্ধারিত মূল্য কার্যকর হচ্ছে না। প্রতিটি এসও এখন সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে হাতবদল হচ্ছে। শনিবার বিকেলে এসওতে প্রতিলিটার সয়াবিন ১৪৭ টাকা ৭৫ পয়সায় বিক্রি হয়েছে যা সরকার নির্ধারিত বাজার মূল্যের চেয়ে প্রায় ৫ টাকা বেশি। এছাড়া পামওয়েল বিক্রি হয়েছে ১৪২ টাকা ৫০ পয়সা যা সরকার নির্ধারিত বাজার মূল্যের চেয়ে প্রায় ১০ টাকা বেশি। এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রোজা সামনে রেখে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। আবার কিছু পণ্যের দর কারসাজিতে বেড়েছে। তিনি বলেন, বরাবর দেখা গেছে ব্যবসায়ীরা রমজানে পণ্যের দাম কমই বৃদ্ধি করে। রমজান আসার আগেই তারা দাম বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে মনিটরিংও আগেভাগেই করতে হবে। কঠোর তদারকির মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অনেক পণ্য আছে যা আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মেটাতে হয়। সেসব পণ্যের মূল্য কমাতে আমদানি পণ্যের শুল্ক কমাতে হবে।