কাজিরবাজার ডেস্ক :
ইউক্রেনের মারিওপোল ও ভলনোভাখা শহরের বেসামরিক লোকদের দ্রুত নিরাপদে সরে যেতে শহর দুটিতে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে রাশিয়া। এ খবরে শনিবার সকাল থেকেই হাজার হাজার মানুষ অন্যত্র চলে যায়। একই সঙ্গে যুদ্ধের দশম দিন ইউক্রেনের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ এলাকায় আক্রমণ আরও জোরদার করে রুশ বাহিনী। শনিবার দেশটির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র দখলের কাছাকাছি পৌঁছে যান রাশিয়ান সৈন্যরা। তবে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ বলেছে, রাশিয়া যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করেছে। মারিওপোলের মেয়র ভাদিম বোইচেঙ্কো অভিযোগ করেন, শনিবারও রুশরা মারিওপোলে নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করছে। এ বিষয়ে ক্রেমলিনের কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
শুক্রবার যুদ্ধের নবম দিন ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র জেপোরোজিয়া দখলে নেয় রুশরা। এ সময় ছয়টি চুল্লির একটিতে আগুন ধরে যায়। এতে হতাহতের খবর পাওয়া যায়। বর্তমানে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রটির কর্মকা- স্বাভাবিক রয়েছে বলে রাশিয়া দাবি করেছে।
রাশিয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে জিততে এবার ইহুদীদের সহায়তা চেয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। হিব্রু ভাষায় দেয়া এক অনলাইন পোস্টে জেলেনস্কি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইহুদীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেন।
এদিকে জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের পর অন্তত ১২ লাখ মানুষ দেশটি ছেড়ে গেছে। শনিবার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ তড়িঘড়ি করে মারিওপোল, ভলনোভাখা ও কিয়েভ ত্যাগ করে। ইউক্রেনে রুশ আক্রমণ নিয়ে শনিবার ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, গত দুদিন ইউক্রেনে বিমান হামলা কমিয়ে দিয়েছে রাশিয়া। এর মধ্যেই রুশবাহিনী তাদের প্রধান টার্গেট কিয়েভ দখলের দিকে ক্রমে অগ্রসর হচ্ছে। মারিওপোলে সাময়িক যুদ্ধবিরতির খবরে শনিবার সকালে শহরবাসীর উদ্দেশে এক আবেগঘন বক্তৃতা করেন শহটির মেয়র ভাদিম বোইচেঙ্কো। তিনি বলেন, মারিওপোল মানে শুধু সড়ক ও বাড়িঘর নয়। শহর মানে এটির জনগণ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের নিরাপদে চলে যাওয়াই ভাল বিকল্প।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ শনিবার বলেন, ইউক্রেনকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করার কোন অভিপ্রায় রাশিয়ার নেই। তিনি বলেন, রাশিয়া শুধু নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এ অভিযান পরিচালনা করছে। ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানের পর ইউক্রেনের নাৎসি ভাবধারার প্রভাব পড়েছে উল্লেখ করে পেসকভ বলেন, ‘আমরা ইউক্রেনের নিরস্ত্রীকরণ দেখতে চাই, নাৎসি মতাদর্শমুক্ত ইউক্রেন দেখতে চাই। পেসকভ আরও বলেন, ‘আমরা দেখতে চাই, ইউক্রেন যে নিরপেক্ষ তা তাদের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করবে। এমনকি যেসব অস্ত্র ইউরোপে নিরাপত্তা ভারসাম্যকে বদলে দিতে পারে, সেসব অস্ত্র ইউক্রেনে সরবরাহ করা যাবে না। পেসকভ আরও বলেন, যেহেতু দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিককে রাশিয়া স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই তাদের প্রতি বিশেষ করে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মস্কোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ইউক্রেনের জেপোরোজিয়া পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চলছে বলে জানান পেসকভ। বিদ্যুতকেন্দ্রটি এখন রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বিদ্যুতকেন্দ্রটির ‘প্রাণ’ পারমাণবিক চুল্লিতে কোন স্পর্শ লাগেনি বলে জানান পেসকভ। শুক্রবার ভোরে ইউক্রেন তথা ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রটির দখল নিয়ে নেয় রাশিয়া।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তার দেশের আকাশসীমা ‘নো-ফ্লাই জোন’ ঘোষণার বিষয় নাকচ করায় শুক্রবার ন্যাটোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, পশ্চিমা এ সামরিক জোট রাশিয়ার হামলা চালানোর বিষয়টি আগাম জেনে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শুক্রবার সকালে ন্যাটো রাশিয়ার বোমা হামলা বন্ধে ইউক্রেনের আকাশসীমা ‘নো-ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করার ব্যাপারে কিয়েভের অনুরোধ নাকচ করে দেয়। তবে পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো রাশিয়া এ যুদ্ধ বন্ধ না করলে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দেয়।
এক ভিডিও বার্তায় জেলেনস্কি বলেন, ‘জানা যাচ্ছে যে নতুন বিমান হামলা ও হতাহত অনিবার্য হলেও জেনেশুনে ইউক্রেনের আকাশসীমা বন্ধের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইউক্রেনের মানবিক সঙ্কট নিয়ে আলোচনার জন্য সোমবার জরুরী বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। কূটনৈতিক সূত্রসমূহ শুক্রবার এ কথা জানায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কূটনীতিক জানান, জরুরী এ বৈঠক শেষে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য সম্ভাব্য একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসবে। মেক্সিকো ও ফ্রান্সের প্রস্তাবে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
ওদিকে কিয়েভ ছাড়ার গুঞ্জন উড়িয়ে শুক্রবার একটি ভিডিও প্রকাশ করেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, আমি কিয়েভেই আছি। নিজের ইনস্টাগ্রামে প্রকাশিত ওই ভিডিও বার্তায় জেলেনস্কি বলেন, দুই দিন পরপর তথ্য আসছে আমি কোথাও পালিয়ে গেছি। ইউক্রেনে, কিয়েভ এবং আমরা অফিসেও নেই। আমিও এখনও আমার জায়গায় আছি। নিয়মিত কাজ করছি।
ইসরাইলি যোদ্ধা রিক্রুট করছে ইউক্রেন : ইউক্রেনীয় দূতাবাস রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুদ্ধে সক্ষম ইসরাইলিদের রিক্রুট করতে চায়। টাইমস অফ ইসরাইলির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে মুছে ফেলা এক ফেসবুক পোস্টে ‘রাশিয়ার হামলার বিরুদ্ধে’ লড়াইয়ে অংশগ্রহণের জন্য ইসরাইলিদের আহ্বান জানায় ইসরাইলির ইউক্রেন দূতাবাস। ইসরাইলির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বলছে, তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। পরে ইউক্রেন দূতাবাস পোস্টটি মুছে দেয়। প্রায় ৫ লাখ ইসরাইলির সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর তারা ইসরাইলে ফেরত আসে।
পুতিনের সঙ্গে কথা বলবেন এরদোগান : ইউক্রেন ইস্যুতে রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রবিবার কথা বলবেন তুর্কী প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান। শনিবার তুর্কী প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন এ তথ্য নিশ্চিত করেন। ইব্রাহিম কালিন বলেন, বিদ্যমান সঙ্কটের সমাধানে সহায়তা দিতে আঙ্কারা প্রস্তুত রয়েছে। ইউক্রেন ও রাশিয়া দুই দেশেরই মিত্র হিসেবে পরিচিত তুরস্ক। তবে চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষ নিয়েছে ন্যাটো জোটের সদস্য তুরস্ক।
যুদ্ধ করতে দেশে ফিরেছে ৬৬ হাজার ইউক্রেনীয় : ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকভ জানিয়েছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বিভিন্ন দেশ থেকে ৬৬ হাজার ২২৪ জন ইউক্রেনীয় ফিরে এসেছেন। শনিবার তিনি এই তথ্য জানান। অনলাইনে একটি পোস্টে রেজনিকভ বলেন, এভাবে বিদেশ থেকে আমাদের মানুষেরা ফিরে আসছেন। তারা নিজেদের দেশকে রক্ষায় লড়াই করবেন। এই মানুষদের নিয়ে ১২টি লড়াইয়ের ব্রিগেড তৈরি হবে।
ভুয়া খবরের জন্য কারাদন্ডের বিধান রেখে আইন পাস : রাশিয়ায় সামরিক বাহিনী নিয়ে ভুয়া খবরের জন্য কারাদন্ডের বিধান রেখে আইন পাস করা হয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট পুতিন শুক্রবার এ সংক্রান্ত বিলে স্বাক্ষর করেন। ফলে বিলটি এখন আইনে পরিণত হয়েছে।
এতে সৈন্যদের নিয়ে ভুয়া সংবাদ পরিবেশনের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া পুতিন রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধের ডাক দেয়ার জন্য জরিমানা কিংবা কারাদ-ের বিধান রাখা আরও একটি বিলে স্বাক্ষর করেন।