রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সিইসি ॥ সবাই নির্বাচনে আসুন

2

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, আমরা আশা করি সবাই নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতন্ত্রকে সুসংহত করবেন। যারা নির্বাচন করবেন তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব কমিশনের। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আমরা সহযোগিতা করব। ভোট আর গণতন্ত্রের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে একটা সমঝোতা সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে।’ সোমবার দুপুরে নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এসব কথা বলেন। চার নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব মোঃ আলমগীর ও আনিছুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রাশেদা সুলতানা এমিলি এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খানও এ সময়তার পাশে ছিলেন। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহ পর নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করল। দুই দিন আগে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ৫ সদস্যের কমিশন বেছে নেয়ার পরদিন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর কাছে শপথ নেন তারা। সোমবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে সিইসি যান আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে। এর আগে ও পরে আসেন অন্য চার কমিশনার। সেখানে যাওয়ার পর নতুন কমিশনকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন নির্বাচন কমিশন সচিব হুমায়ুন কবির খন্দকার। এরপর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে বসে নতুন কমিশন। এরপর গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে আসে নতুন কমিশন।
সংবাদ সম্মেলনে সিইসি বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে দায়িত্বটা রয়েছে, সেটা যদি শেয়ার না করেন, তাহলে নির্বাচন কমিশন এককভাবে যে কাজ করবে সেখানে সীমাবদ্ধতা দেখা দেবে। আমাদের দায়িত্ব আছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে আবদার করা, বিনয় করা, অনুনয় করা। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আমরা সহযোগিতা করব। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সহায়তা না করে, পলিটিক্যাল লিডারশিপের যদি ন্যূনতম সমঝোতা না থাকে।
আমি তো তাদের মুরব্বি হতে পারব না। উনারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী, অনেক বেশি অভিজ্ঞ।
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন এই নতুন ইসির অধীনেই আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। তবে সে সময় আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় থাকে, সেই নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এ বিষয়ে সাংবাদিকরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিইসি বলেন, ‘বিএনপি যদি এমন ঘোষণা দিয়েও থাকে, আমরা কী তাদের চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাব না? কোন কথাই শেষ কথাই নয়।’ সিনিয়র সচিব হিসেবে অবসরে যাওয়া হাবিবুল আউয়াল এই সংবাদ সম্মেলনে ভোট আর গণতন্ত্রের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমানোর ওপর জোর দিয়েছেন বার বার। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে একটা সমঝোতা সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলব না, মাঠে যুদ্ধ করব…। আমরা যদি মুখ ফিরিয়ে থাকি তাহলে কিন্তু দূরত্ব বাড়তে থাকবে। আলোচনা করতে হবে। কাউকে না কাউকে অহঙ্কার পরিত্যাগ করে আলোচনা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের শক্তি অসীম নয়। এটা সবসময় আপেক্ষিক।’
সিইসি বলেন, নির্বাচন একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ থাকে। সবার আবেগ বুঝতে হয়। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা রয়েছে। নির্বাচনে অনেক কর্মী থাকে সেখানে দায়িত্ব পালন করতে হবে। মাঠ ছেড়ে এলে হবে না, ছেড়ে গেলেও হবে না, থাকতে হবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পালিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিছু ধস্তাধস্তি হয়। আমাদের যে সামর্থ্য, দক্ষতা আছে সে অনুযায়ী আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টার সঙ্গে আমাদের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করব। নির্বাচন কমিশনের প্রধান হিসেবে সামর্থ্য, দক্ষতা ও শক্তির সবটুকু দিয়ে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে যাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নতুন সিইসি। সেই সঙ্গে অন্য সব পক্ষের সহযোগিতাও তিনি চেয়েছেন। ‘মিডিয়া ভালো রোল প্লে করতে পারে। সকলকে সচেতন করার ক্ষেত্রে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, পরের প্রজন্মের জন্য সুশাসনের দিকে এগিয়ে, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটা সংসদ উপহার দেয়ার।’ ‘সকলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে একটি দ্বান্দ্বিক সংসদ গড়ে উঠুক। আমরা সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যমে গুড গবর্নেন্স ও ভাল সংসদ গড়ে তোলার চেষ্টা করব। এদিক থেকে আমাদের কোন কার্পণ্য থাকবে না।’
সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি নতুন কমিশনকে ‘আমলানির্ভর’ আখ্যা দিয়েছে, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমি কী রাতে গিয়ে ভোটবাক্স চুরি করে ওখানে গিয়ে ভোট দেব? নাকি দেখেও না দেখার মতো থাকব। আমি সরকারী কর্মচারী ছিলাম। অতীতে যারা ছিলেন, কে ছিলেন না?। কেউ কেউ বলেন, শামসুল হুদা সাহেবের নির্বাচন ভাল ছিল, কেউ বলে সাহাবুদ্দীন সাহেবেরটা ভাল ছিল। এগুলো আপেক্ষিক।’ আবারও রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্বের দিকগুলো মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে দায়িত্বটা রয়েছে, সেটা যদি শেয়ার না করেন, তাহলে নির্বাচন কমিশন এককভাবে যে কাজ করবে, সেখানে সীমাবদ্ধতা দেখা দেবে। ভোট কেন্দ্রে গিয়ে যারা ভোট দেন, সেটা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশাবাদী। আমাদের ওপর আস্থা রাখেন।’ বিএনপির নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি নিয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘নির্বাচন সরকার করে না। নির্বাচনের সময় একটা সরকার থাকে। কোন না কোন সরকার থাকবেই। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ছিল, নির্দলীয় সরকার ছিল। এখন যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা আছে, সেটা মেনেই আমরা চেষ্টা করব, ভোটাররা যাতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সেটা বড় চ্যালেঞ্জ।’
সংবাদ সম্মেলনে সিইসি জানান, দায়িত্ব নেয়ার পর কমিশনের প্রথম দিনের বৈঠক ছিল মূলত নিজেদের মধ্যে পরিচিতি পর্ব। কমিশনের কর্মপরিধি সম্পর্কে সচিব আমাদের অবহিত করেছেন। আমরা খুব অভিজ্ঞ নই। আমি একেবারেই নতুন, তবে গণমাধ্যমে নির্বাচনের খবর দেখেছি। নির্বাচন ঘরে বসে পর্যবেক্ষণ করেছি। কিছুটা অস্বচ্ছ হলেও ধারণা আছে। আমরা প্রত্যাশা করি, সকলে নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতন্ত্রকে সুসংহত করবেন। যারা নির্বাচন করবেন তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব কমিশনের রয়েছে। কর্মপদ্ধতি কী হবে সেটি ঠিক করিনি। তবে জানতে কিছু জ্ঞান আহরণ করেছি।’
নির্বাচনকে একটি ‘বিশাল কর্মযজ্ঞ’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের আগ্রহ থাকে, সবার আবেগ বুঝতে হয়। আমরা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নির্বাচন বিষয়ে দায়িত্ব পালন করব। আমরা কতটা সৎ ছিলাম, দায়িত্ব পালন করেছি, সেটি পরে মূল্যয়ন করতে পারবেন।’ ইভিএম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইভিএম নিয়ে কি সিদ্ধান্ত হবে সেটি এখনই নিতে পারব না। আমরা আলোচনা করব। ইভিএমের ভাল-মন্দ আলোচনা করব। আমি নিজেও ইভিএম ভাল করে বুঝি না। ব্যালটের ভাল-মন্দটাও হয়ত বসে দেখব। পরে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট আইনগুলোও পর্যাপ্ত কিনা আমরা সেটি দেখব। নির্বাচন পরিচালনায় আমরা গুরুত্ব দেব। আমরা সেনসেটাইজ করব। পর্যবেক্ষণও করব। আগের কমিশনের প্রসঙ্গ টেনে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আগের কমিশনের ব্যর্থতা, সফলতা মূল্যায়নের প্রশ্ন আসবে। কিন্তু এ মুহূর্তে আগের কমিশনের দোষ-ত্রুটি নিয়ে বলতে চাইছি না। তবে শিক্ষণীয় কোন বিষয় থাকলে সেটি আমরা সংশোধন করে কাজ করব।