মহান একুশে ফেব্রুয়ারি এবার এসেছে একেবারেই ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও আবহ নিয়ে। কোভিড-১৯ বা মহামারী করোনাভাইরাস গ্রাস করেছে প্রায় গোটা বিশ্বকে। ভয়াবহ সংক্রামক ও হন্তারক এই ব্যাধির বিরুদ্ধে মানবসভ্যতাকে লড়াই করতে হচ্ছে সবার মুখে মাস্কসহ স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হলেও করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলতে হবে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে এবার ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির শুরুতে আয়োজন করা সম্ভব হয়নি মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বইমেলা শুরু হয়েছে ১৫ ফেব্রুয়ারি। এবারও অনুষ্ঠিত হবে না প্রভাতফেরি, শহীদ মিনারসহ বাংলা একাডেমি চত্বরে সুবৃহৎ জনসমাবেশ। শহীদ মিনারে ফুল দিতে হবে দুই থেকে পাঁচজন মিলে। সঙ্গে থাকতে হবে টিকা সনদ। তেমন আড়ম্বর-আয়োজনে পালিত হবে না আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের নানা অনুষ্ঠান। বিবিধ অনুষ্ঠানের অয়োজন করা হবে রেডিও-টেলিভিশনসহ ভার্চুয়াল মাধ্যমে। মহান একুশের চিরকালের বেদনাবিধুর পরিবেশ নিশ্চয়ই বিরাজ করবে। সমবেত কণ্ঠে গীতও হবে- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি …। শোকের মাস ফেব্রুয়ারিতে এটুকুই যা সান্ত¦না ও প্রাপ্তি।
একুশ মানে মাথা নত না করা। কথাটির যথার্থতা বার বার প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশে। একুশ শিখিয়েছে অন্যায়, অবিচার ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, প্রতিরোধী হতে। বায়ান্নর সেই ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি ৬৮ বছর পেরিয়ে ৬৯ বছরে পদার্পণ করেছে। অমর একুশের চেতনা আজও অমলিন। দেশের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। বর্তমানে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও পালন করা হয় বিশ্বের দেশে দেশে।
মাতৃভাষার জন্য আত্মদানের এমন নজির বিশ্বে বোধকরি আর নেই। রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে একুশের প্রভাব এতটাই সর্বব্যাপী যে, ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। আত্মপরিচয় বিস্মৃত বাঙালী জাতিকে স্বরূপের সন্ধান দিয়েছে মহান একুশ। জাতি হিসেবে একতাবদ্ধ করেছে যেমন, তেমনি জুগিয়েছে অপরিমেয় শক্তি ও সাহস। অদম্য আত্মবিশ্বাসে করেছে বলীয়ান। একুশের পথ ধরে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি পেয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম ভাষাভিত্তিক একটি দেশ। বাঙালি ও বাংলাদেশ যতদিন থাকবে বিশ্বের বুকে, ততদিন থাকবে অমলিন বাংলা ভাষা ও অমর একুশে। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালিকে একাত্তরের মতো প্রতিবাদী প্রতিরোধী সাহসে শত্রুকে প্রতিহত করার প্রেরণা জোগায়। একুশ মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, দুর্নীতি, নাশকতা, নৃশংসতা ও মাদকের বিরুদ্ধে আপোসহীন লড়াইয়ের প্রেরণা জুগিয়েছে। বাঙালি এই দিনে আবার জেগে ওঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে। গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে সুসংহত করার সুদৃঢ় অঙ্গীকারে।